বড় ভাই এবং সালামের সেঞ্চুরি

আহমদ আল হুসাইন
Published : 10 Jan 2013, 07:51 PM
Updated : 10 Jan 2013, 07:51 PM

উঠতে সালাম । বসতে সালাম । বড় ভাই । ছোট ভাই । হলের ভাই । ডিপার্টমেনটের ভাই । সংগঠনের ভাই । ক্যাম্পাস জুড়ে এই ভাইয়ের ছড়াছড়ি । দেখা হলেই সালাম । মুখমুখি হলেই সালাম । সিঁড়িতেও সালাম । টয়লেটের গেটেও সালাম । এ সব সালামে শ্রদ্ধার ছিটে ফোটা আছে কিনা তাতেও আছে ঢের সন্দেহ । ভয়ের মোড়কে জড়ানো এসব সালাম রাজনৈতিক সালামের প্রতিবিম্ব । আর এসব সালাম হলের সিট রক্ষার জন্য ভালো একটা তাবিজ । অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার উত্তম হোমিও প্যাথ ।

২০১১ সাল । জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষা । ডেইরি গেটে নামলাম । জীবনের এই প্রথম জাবির ক্যাম্পাসে আসা । অসাধারণ একটা ক্যাম্পাস । ভিতরে ঢুকতেই এখানে পড়ার ইচ্ছে বেড়ে গেল আরও দিগুন । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম চাদরে জড়ানো চারপাশ । উঠলাম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি হলে । ২৪০ নাম্বর রুম । রেফারেন্স আমার এক বন্ধুর নাহিদের কাজিন । মাস্টার্সের ছাত্র । রুম টা ফাঁকাই ছিল । তারা ছিল দুই জন আর আমরা দুই জন ।

হলে থাকার নিয়ম কাননের উপর দশ বার মিনিটের একটা ক্লাস নিলেন সজল ভাই । লুঙ্গি পড়ে টয়লেটে যাওয়া যাবে না । রুম থেকে বের হওয়ার পরে যার সাথে দেখা হবে সালাম দিতে হবে । এখানে বসা যাবে না । অখানে দাঁড়ান যাবে না । বারান্দায় দাড়িয়ে মোবাইলে কথা বলা যাবে না । র্যাাগ দিলে সহজে হজম করা অত্যাবশ্যক । ইত্যাদি

পরের দিন জ ইউনিটের পরিক্ষা । অসাধারণ জ্ঞান "নতুন বিশ্বে" সাঁতার কাটছি আমরা দুই জন । রুমে আর কেউ নেই । কিছুক্ষণ পর পর দু চার জনের একটা গ্রুপ আসছে । আমরা নাট্যকলা থেকে আসেছি । এই আমাদের ক্যালেন্ডার । মূল্য পঞ্চাশ টাকা । হাতে ধরিয়ে দিল । উপায় নেই । সুরসুর করে মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলাম । আমরা উমুক সংগঠন । এই আমাদের প্রসপেকটাস । বিশ টাকা । আবার দিলাম । এভাবে দুই দিনে খোয়ালাম দুই তিনশর মত । সালাম দিতে দিতে কতবার সেঞ্চুরি করেছিলাম ঠিক মনে নেই ।

পরের দিন রাত সাড়ে বারোটা । আমরা দুই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি । হটাত দরজায় লাঠি সোটা দিয়ে পেটানোর ধুপ ধাপ আওয়াজ । ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম । দশ বার জন । হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প । অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলো । এই শুওরের বাচ্চা কইছিনা বারটার ভিতরে নিচে যাবি । মিছিল আছে । কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম ভাইয়া আমরা পরিক্ষা দিতে এসেছি । একজনের দয়া হল । বলল ঠিক আছে তোমরা ঘুমাও । সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম । মনে মনে কি যেন একটা তওবাও পড়েছিলাম ।

কলেজ ফ্রেন্ড শাকিলও উঠেছে ভাসানি হলে । নিচ তলায় । গণরুমে । রুমের সবাই পরীক্ষার্থী । সকালে এক সাথে নাস্তা খাওয়ার জন্য তাকে ডাকতে গেলাম । রুমের দরজা খুলতেই সবাই আমাকে সালাম দিতে লাগলো । ভাইয়া আসসালামু আলাইকুম । ভাইয়া আসসালামু আলাইকুম । শাকিল আছে ? জিজ্ঞাস করলাম । না ভাইয়া নেই । এই তো একটু আগে বের হল । ভাইয়া , ও আসলে কিছু বলতে হবে । বললাম না । ওরা ঠিক ধরে নিয়েছিল আমি বড় ভাই । মনে মনে হাসলাম । দাঁড়ালাম শাকিলের সেই রুমের সামনে । সামনে দিয়ে যেই যায় , আসে আমাকে সালাম দেয় সবাই। আমি মনে মনে হাসি । হায়রে সালাম । শেষ পর্যন্ত ভাবলাম এখানে দাঁড়ানোও নিরাপদ নয় । তাই দ্রুত কেটে পরলাম সেই রুমের সামনে থেকে ।

এখন আর উঠতে বসতে সালাম দিতে হয় না । সালামের তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে রাখতেও হয় না । প্রকৃত পক্ষে যাকে শ্রদ্ধা করে তাকেই সালাম দিই ।