অ্যাডমিশন ফিল্টারে ধরা পড়ছে শিক্ষার মান

আহমদ আল হুসাইন
Published : 26 Sept 2014, 07:57 AM
Updated : 26 Sept 2014, 07:57 AM

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ছিল একটি পরীক্ষা নীতি । শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলেও এই মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য এই শিক্ষানীতিই যথেষ্ট। তাৎক্ষনিক ভাবে এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেছিলেন অনেক শিক্ষাবিদ, গবেষক, শিক্ষক এবং সুশীল সমাজ । সরকার কারো কথাতেই কান দেইনি। প্রয়োজন মনে করেনি। কারণ সরকারের উপরে আর কোন শিক্ষাবিদ থাকতে পারে না । মাত্র চার বছরের ব্যাবধানে এই শিক্ষানীতির কালো থাবা পড়তে শুরু করেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ।

সাফল্যই তো সব। তাই সরকারের দরকার সাফল্য । এই সাফল্য অর্জনে শিক্ষার মান কমলো না বাড়ল এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বা সরকারের কোন মাথা ব্যথা না থাকার ই কথা । সাফল্যই যেহেতু সব কিছু তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য আসলে এমনিতেই শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে । কিন্তু ব্যাপার টা যে উল্টোও হতে পারে এটা তাদের ভাবনায় আসে নি ।

২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় বেশ কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে সংঘটিত নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন মনে করি না। ১০ এপ্রিলের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর জানার পর আগের দিনই পরীক্ষাটি স্থগিত করা হয় । গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পেলেও এর কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভাবত দেশ কে ডিজিটাল করার অংশ হিসেবেই হয় তো প্রশ্নপত্র ফেসবুকে আপলোড করা হয়েছিলো। শিক্ষার্থীরা যেন ঘরে বসে সহজেই প্রশ্নপত্র পেয়ে যায় । ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে সরকার সেটা করতে পারে নি কিন্তু ঘরে ঘরে প্রশ্নপত্র দিতে পেরেছে। তারপরেও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বাগাড়ম্বর থামে নি । এইচএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পর এতো বিপুল সংখ্যক গোল্ডেন আর এ প্লাস এ শিক্ষামন্ত্রী, অবিভাবক, শিক্ষক সবাই খুশি । শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ''রেজাল্টে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন প্রভাব পরেনি '' ।

রেজাল্টে প্রভাব না পড়ারই কথা । কারণ মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রির কাছে আছে আলাদীনের চেরাগ বা জিপিও- ৫ মেকার মেশিন । পরীক্ষার্থীদের এই ''জিপিএ- ৫ মেকার মেশিন'' এ প্রবেশ করালেই তারা জিপিও- ৫, গোল্ডেন আর ডায়মন্ড হয়েই বের হয়ে আসে । আর সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে এই জিপিএ- ৫, গোল্ডেন আর ডায়মন্ড এর সংখ্যা দিয়ে জনগণ কে বোকা বানায় । সরকার বুঝাতে সক্ষম হয় তারা জনগণের জন্য কাজ করছে। অবিভাবকরাও তাদের প্রিয় সন্তানদের গোল্ডেন আর ডায়মন্ড বনে যাওয়ায় খুশি হন । কিন্তু এই গোল্ডেন আর ডায়মন্ড সন্তানরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় যখন পাস করতে ই পারে না তখন অবিভাবক আর সে সন্তানদের মানসিক অবস্থাটা কি ? নিজের প্রিয় সন্তানের জিপিও- ৫ আর গোল্ডেন পাওয়ার গল্প মা বাবা আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশিদের কাছে গর্বের সাথে করেন । কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তো সে গল্প গল্পই থেকে যায় । কিন্তু কেন ?

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে বা নাম্বার বেশি দিয়ে জিপিএ- ৫ আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়ানো যায় কিন্তু অ্যাডমিশন ফিল্টারে সব ধরা পরে যায় । ২০১৪ সালের এইচএসসি-সমমান পরীক্ষায় পাশের হার ৭৮.৩৩ শতাংশ । আর ফেলের হার ২১.৬৭ । কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের সম্মান প্রথম বর্ষ 'ক', 'খ' ও 'গ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে ৮৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী । পাস করেছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী । অর্থাৎ এইচএসসি
পরিক্ষার ফেলের হার ২১.৬৭ কেও ছুঁতে পারে নি ঢাবির ভর্তি পরিক্ষার পাশের হার ১৭ । আলাদা ভাবে বলতে গেলে 'ক' ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০, 'খ' ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ এবং 'গ' ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ। আর এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ই জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। সবেচেয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে মঙ্গলবার প্রকাশিত ঢাবির 'বি' ইউনিটের ফল। সেখানে পাসের হার ৯.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ পাস করতে পারেনি ৯১ ভাগ শিক্ষার্থী। আর ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্য মাত্র দুইজন ।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ''রেজাল্টে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন প্রভাব পরে নি"। ঠিক তো! রেজাল্টে কোন প্রভাব পরেনি। কিন্তু প্রভাবটা কোথায় পড়েছে এবার যদি একটু বুঝতে পারেন । এই শিক্ষামন্ত্রীই এক সময় বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অযৌক্তিক ।  শিক্ষামন্ত্রী কেন বলেছিলেন এবার ঠিক বুঝতে পারছি । এই ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষা ক্ষেত্রে আপনার সাফল্যের অনেক কিছু উন্মোচন করে দিচ্ছে । এবারের এইচএসটি পরীক্ষায় মোট ৫ লাখ ৮৫ হাজার জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাশ করেছে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্য মাত্র দুইজন। ব্যাপারটা সত্যিই খুব হাস্যকর ।

শিক্ষা যখন পণ্য বা রাজনৈতিক অস্ত্র তখন শিক্ষা ব্যবস্থার এমন দুর্দশা হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাশের হার বাড়লেই বা জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানেই শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাওয়া হয় না ।  জিপিএ-৫ মেকার মেশিন ছুঁড়ে ফেলে কিভাবে শিক্ষার মান বাড়ে সে দিকে এখন মনোযোগ দিতে হবে ।