শূন্যদর্শন : প্রাককথন ২

আহমেদ ফিরোজ
Published : 21 Dec 2011, 08:54 AM
Updated : 21 Dec 2011, 08:54 AM

সবকিছু ভেঙে পড়ে
ভেঙে পড়ার গল্প পুরনো, ভেঙে পড়াবার গল্পও পুরনো; নতুন আবিষ্কারে, পরিবর্তন কিংবা ব্যতিক্রমে নয়। কী মানবজীবনে, কী বস্তুশাসনে। মানুষের সম্পর্ক এবং বস্তুর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যভাবে ক্রিয়মাণ। আলাদা করতে গেলেই নতুন করে ভেঙে পড়ার শব্দ ভেসে আসে–ধ্বনিত হয়, আবার অটুটেও শব্দহীন নয়–যা চলমান, তা কি সময় নাকি নিয়ম? নিয়ম গ্রন্থভুক্ত থাকে না, সময় কারো ধার ধারে না। নিয়ম আইন নয়, সময় অন্তরীণ নয়। মৃদু ও উচ্চ যাই হোক না কেন–প্রতিনিয়তই ভেঙে পড়ার শব্দ নিয়মে চলছে, সময় শুধু দেখছে। নিয়ম ও সময়ের সঙ্গে মানুষ ও বস্তুর সম্পর্ক; প্রাণ ও প্রাণীর সমসঙ্গে, সমরঙে, সমব্যথায়। সে সম্পর্কের কথাই নানাভাবে উঠে এসেছে বর্ণনায়, কখনো ছোটার্থে, কখনো বড়ার্থে। ছোট বড় মাঝারি অথবা যে আকারেরই রূপচিহ্ন হোক না কেন–সবই পৃথিবীর অংশ, বিস্তৃতার্থে সৌরমণ্ডলী ও সৃষ্টিজগতের অংশপ্রাণ। সৃষ্টির সঙ্গে ধ্বংসের যে সম্পর্ক, প্রাণের সঙ্গে প্রাণপাতের সে সম্পর্ক। সম্পর্ক কোথায় নেই, সবখানেই আছে; আবার সর্বত্রই ভেঙে পড়ার শব্দ সপ্রতিভ। ভয় আছে, ভাবনা আছে, বিস্তার-বিকাশ পর্বের দেখা না-দেখার, চেনা না-চেনার, জানা না-জানার ধূম্রজাল বা মায়া আছে–সেই মায়ায়ও ভেঙে পড়ার শব্দ আছে, আশঙ্কা আছে, আছে সৃষ্টি, আছে মৃত্যু, আছে নতুন প্রাণ-সঞ্চারণী রস ও রসের ব্যবহার; ব্যবহার বিশেষে কায়া উজ্জ্বল, মায়া অনুজ্জ্বল, আবার কায়া-মায়া একীভূত সৃষ্টিরহস্য গল্পে; যেখানেও ভেঙে পড়ার শব্দ আছে, আছে সৃষ্টি-উন্মাদনা এবং চিন্তা-প্রাণ ও নতুন পৃথিবীর গল্প, মঙ্গলযাত্রার কথা, আছে গ্রহান্তর ধারণা ও সৃষ্টিতাপ–সেখানকার ভাঙা-গড়ার শব্দ আবিষ্কারপ্রবণতায় কিছুটা অনাবিষ্কৃত মনে হলেও, তাও ভাঙা-গড়া সৃষ্টিমন্ত্রে ক্রিয়মাণ এবং সৌরযাত্রা মহিমামণ্ডিত করে, জ্ঞানদর্শনের পথকে বাড়িয়ে দেয় নতুন সম্ভাবনায়। সেখানে ভাঙা-গড়া খেলা চলছে, চলবে কালভেদে, কালান্তরে। সে-প্রেক্ষিতে ভেঙে পড়ার ছন্দো-বিশ্লেষণের সঙ্গে বস্তু-অবস্তুর সম্পর্ক অবর্তমান নয়। সবকিছু ভেঙে পড়ে–সবকিছু চিরকালীন নয় বলে। তাহলে কি কিছুই টিকছে না? টিকছে আয়ুষ্কাল বা গঠননির্মাণের মধ্যে। প্রাণ ও বস্তুর এখানেই সবচেয়ে বড় মিল ও অমিল। মিল নিয়ম ও সময়ের কাছে নিয়ন্ত্রিত, অমিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসে। বিশ্বাস অন্ধ, অবিশ্বাসের চোখ খোলা। বিশ্বাস তবে কি থাকবে না? থাকবে, যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে, প্রাণ থাকে, শ্রুতি থাকে এবং গতি-অন্বেষার সৃষ্টি-বেদনা থাকে। খোলা চোখেও মানুষ বাঁচবে। তাহলে বেঁচে থাকার সঙ্গেও ভেঙে পড়ার একটা ভয়ঙ্কর সম্পর্ক আছে, ভয়ঙ্করার্থে আতঙ্কিত অর্থের ভয় নয়–ভয়ের ত্যাগধর্ম বা নিঃশর্ত সম্পর্ক। এই সমস্ত সম্পর্ক নিয়েই সবকিছু ভেঙে পড়ের যাত্রাপথ অবারিত–অনিঃশেষ। প্রবেশেই মুক্তি নয়, মুক্তির সন্ধান লাভ বা মন্ত্রণাপ্রাপ্তির যাত্রাপথ উন্মোচিত হয়। লাভের সঙ্গে ভালোলাগা ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলে খুবই ভালো, না-হলে নতুন করে দুঃখক্রয় বিভ্রাট তৈরি হবার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সেখানে যে ভেঙে পড়ার গল্প উচ্চারিত, লেখাতে তারই কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত, প্রতীকায়িত। মনে রাখতে হয়, সবকিছু সম্পূর্ণ নয়, সম্পন্নের রূপ মাত্র। রূপের সঙ্গে অরূপের যে সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে বস্তুর সম্পর্কও সে পর্যায়ে উল্লেখনীয়। এভাবেই বিস্তৃত, পথ-বিকাশ ও শেষ। আবার শেষ বলেও কিছু নেই, তার পরেই সৃষ্টি, সৃষ্টির অপেক্ষা। এই দ্বন্দ্বমুখরতায় যাপিত আয়ুষ্কাল : ভাঙা-গড়া খেলা এবং সবকিছু ভেঙে পড়ে, পড়ে কি?

সবকিছু ভেঙে পড়ে চিন্তাগ্রন্থটি ২০০৫ সালে ছোটাকারে প্রকাশিত হলেও, অন্তরযাত্রায় তার বড়ত্ব ছিল চিন্তার বহুমুখিতায়। বহুমুখী গুণ দ্বারা সংবিধিবদ্ধ, প্রচলার্থের বহুগামিতা নয়। সেখানে ভেঙে পড়ার বিভিন্ন অনুষঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে এসে গেছে অন্তরবিস্তারের নানা কথা, নানা মত এবং দেহ-মনের সম্পর্ক ও আত্মার অবস্থান-অবস্থিতি সম্পর্কও। আর এসব যাত্রা কোনো-না-কোনোভাবে শূন্যযাত্রাকে সমর্থন করে; বলা যায়, মেনে চলে–ভাঙা-গড়ার বহু চিত্র-বিচিত্র বিক্রিয়ার সমূহ সন্দর্শনে সমাসন্ন হয়ে শূন্যদর্শনের জাগরণের অস্তিত্বকে জাগিয়ে তুলেছে। এ পর্বে আশা করি, পাঠক তার অনেক না-জানা অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হবে এবং জ্ঞানসম্পদের বিস্তৃতিকালকে চিনে উঠতে পারবে। সে যাত্রা, বিশেষ করে মানবজীবনের যে-কোনো যাত্রাই সফল হোক–নেতিবাচকতাকে ছাড়িয়ে দেহ-মনের ঔজ্জ্বল্যে, আত্মার সৌন্দর্যে–এ প্রত্যাশা অপরিমেয় আনন্দের, আন্তর-বিশ্বাসের।

তারিখ : ২০ ডিসেম্বর ২০১১