না-গল্প না-কবিতা
না-গল্প না-কবিতার সূত্রপাত আদি-গীতবলয়ের কাল থেকেই ধরে নেয়া হয়। যখন পর্যন্ত গদ্যের উৎপত্তি হয়নি বা চিহ্নিতকরণ করা হয়ে ওঠেনি। উৎপত্তি-অর্থে, গদ্যের যাত্রা–যা সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে আঠারো শতকের শুরুর কাল পর্যন্ত বিবেচনা করা যেতে পারে। পূর্বকালের রচনা বা সৃষ্টি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য। না-গল্প না-কবিতার এই কালের সঙ্গে একটা সম্পর্ক চিরকালীন বিস্তৃত ও অর্থপূর্ণ। কেননা আধুনিককালে এসে (এ-কালকে অনেকে উত্তরাধুনিক কাল হিসেবেও চিহ্নিত করতে চেয়েছেন) গদ্য-পদ্য অথবা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা অন্য যেসব সাহিত্যের ব্যাকরণিক চিহ্নিতকরণের উপাদান বা শাখা দাঁড়িয়েছে স্বকাল পর্যন্ত, সে-কালে দাঁড়িয়েই ল্যযোগ্য–এসব চিহ্নিতকরণের শাখা-উপশাখার বাইরে এসে সৃষ্টিমন দাঁড়িয়ে গেছে অন্য একটি বিশেষ নির্মাণবৈশিষ্ট্যের রাজসিক আসনে–যা টেকস্ট বা মূলভাব হিসেবে উল্লিখিত। ব্যক্তিগত রচনা বলে এই টেকস্ট যাত্রাকে বর্ণনায়িত করা বা চালিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। কারণ এখানে লেখকের মর্মযন্ত্রণার সেইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাল ও সময় উঠে এসেছে অথবা ধরা পড়েছে, যার সঙ্গে ভাবের (ভাবনার) একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং যেখানে চিন্তার স্বাধীনতাও অবিন্যস্ত থাকে। তাকে একটি রীতি বা চিহ্নিতকরণের উপাদান-কাঠামোয় আবদ্ধ করে কিংবা মূলভাব থেকে সরিয়ে দিয়ে ভেঙে-চুরে বা কেটে-ছেঁটে আংশিক অথবা সম্পাদিত ও পরিমার্জিত উপস্থাপনের দিকে ঠেলে দিয়ে খোঁয়াড়বন্দি করে ফেলা ঠিক হবে না। এই খোঁয়াড়বন্দিকরণের ফলে শিল্পরার দায়দায়িত্বও বিদ্যমান থাকে না স্রষ্টা বা লেখকের ওপর–যা চলে যায় সংজ্ঞা অথবা ব্যাকরণিক বিশ্লেষক বা নির্মাতাদের হাতে, যেখানে সৃষ্টিকর্ম তৈরি হলেও সৃষ্টির আনন্দ অনুপস্থিত থাকে; সেখানে স্রষ্টাকেও দ্বিখণ্ডিত হতে হয় আইনি কাঠামোয় পড়ে, অর্থাৎ চেতনা বা ভাবনার ওপর কাঁচি চালানোর বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়ায়। সে ক্ষেত্রে বারবার লােল্লেখ করা, ঘর এঁকে, ছক দিয়ে; অথবা এইভাবে লিখতে হবে, ঐভাবে কলমাবদ্ধ হতে হবে; এইভাবে লিখলে এটাকে সেটা বলে–এইসব সীমাবদ্ধতা থেকে লেখকমন, মুক্তপ্রাণ মানুষ মুক্তির ঘণ্টা বাজিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। আর এই মুক্তির যাত্রা টেকস্টে রূপবদ্ধ, আবার এখান থেকেও মন উড়ে যায় মুক্তবিহঙ্গের গতির পাখায়–যেখানে মূলভাবকে কাটছাঁট করতে হয় না ব্যাকরণিক বা প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা-বিশ্লেষণের করাতে; লেখকমন আহত হয় না, বাধাগ্রস্ত হতে হয় না–যে-কোনো ধর্ম-রাষ্ট্র-রাজনীতি, সমাজ-সংবিধান দ্বারা, শ্লীল-অশ্লীলের মন্ত্রণায়, বাহাস পুরস্কার-উপঢৌকনে। বাংলায় আমরা (আমি) এই ধারা বা নতুন শাখাটিকে না-গল্প না-কবিতা নাম-বিশেষই মনে করছি। এর মধ্য দিয়ে প্রচলধারা বা শাখাগুলো স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যেমন, ঠিক একই পথে নতুন আরেকটি ধারা বা শাখা যুক্ত হলো–যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সুখপাঠ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে নিশ্চয়ই। না-গল্প না-কবিতার আর-সব বিস্তৃত আলোচনা পাঠপর্ব প্রবেশেই অনুভূত, সেখানে পাঠকের স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ন রয়েছে–লেখকের ইচ্ছা বা শ্রমে নয়, আপনার প্রাপ্য অধিকারে অথবা মানুষ হিসেবে আপনার চিরন্তন সত্যের জ্ঞানানুশীলনে। সেখানে আপনিও মুক্ত, লেখকও মুক্ত। এই মুক্তচিন্তার যাত্রাই না-গল্প না-কবিতা–যার সঙ্গে আপনার আত্মীয়তা আছে, ছিল, থাকবে। শুধু দেহ ও মন অথবা মন ও দেহ নয়, আত্মার একটি বিশেষ সম্পর্ক এখানে পরম জ্ঞানবিস্তারের ধারায় অস্তিত্বমান; এ-যাত্রায় আপনাকে স্বাগত।
না-গল্প না-কবিতা বিষয়ক প্রথম আলাদা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে লেখা মুদ্রিত হয় ২০০৬ সালে গ্রন্থাকারে। সে যাত্রাপথ পরবর্তীকালে বিস্তৃত হয়েছে–নতুন লেখায়, নবীন-প্রবীণ লেখকের নানামুখী চিন্তা-বিকাশে ও লেখনীকর্মে। এই পরিপ্রেক্ষিতে না-গল্প না-কবিতা অথবা না-কবিতা না-গল্প আবিষ্কারপ্রবণ যাত্রার একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বা ঘটনা। ঘটনা ঘটন-অঘটনের বাস্তব সত্যকে ছাড়িয়ে বিশেষ ঘটনার্থে, সংযোজন বিকাশার্থে। এ-বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল বা ল করলে দেখা যাবে, কী নিবিড় আবিষ্কারপ্রবণতার মায়াবী জাল ভেদ করে কাঠখোট্টা বাজারিজীবন বা দূষিত ঢাকাবাস বেরিয়ে এসেছে মুখোজ্জ্বলতায় হৃদয়-মন ও আত্মার সংশ্লেষে। এর যে অভীপ্সা তা শূন্য থেকেই, এর প্রকাশ, বিস্তার ও বিকাশে। যে-কারণে না-গল্প না-কবিতা থেকে জন্মোত্তরযাত্রার কথামালা উঠে এসেছে বর্ণনা-ব্যাখ্যায় ও ভাববিশ্লেষণে–সংজ্ঞা, উৎস ও ভবিষ্যতের চোখে। যেখানে নতুনকালের কবি-সাহিত্যিক ও পাঠক একটি ভিন্ন জগতের আবহ ও স্বাদ পাবে–ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্মের ঊর্ধ্বে লৌকিক অতীন্দ্রিয়তায়, ফেরা ইন্দ্রিয়ের কাছে, অপার অসীম পরমানন্দ ও কল্যাণের পথে। সেই ভাবনাবিস্তারকাল সম্পন্নতার গ্রন্থভুক্তির যুক্তি খুঁজে ফেরা, লক্ষ্যপথ কোনোভাবেই অনির্বচনীয় নয়।
তারিখ : ২৩ ডিসেম্বর ২০১১