কাসেম সোলেমানির মৃত্যু: পাল্টাপাল্টির বলি, নাকি নতুন যুদ্ধের দামামা

মীর মোশাররফ হোসেনমীর মোশাররফ হোসেন
Published : 5 Jan 2012, 09:11 AM
Updated : 3 Jan 2020, 03:45 PM

২০১৯ সালেই ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ৪০ বছর পূরণ হলো। এ চার দশকের অসংখ্য বছর দেশটিকে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়তে হয়েছে, হচ্ছে। দেশটির আশপাশজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা প্রচুর; আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে ইসরায়েল আর সৌদি আরবের মতো মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও 'দা-কুমড়া'।

এত কিছুর পরও বিশেষ করে গত দুই দশকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিই মধ্যপ্রাচ্যে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। বিশ্ব রাজনীতির খানিক বাঁক বদলের ফলে আর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে 'ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব' অক্ষবিরোধীদের একত্রিত করার চেষ্টায় তেহরান এই মুহূর্তে উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে 'ঝানু খেলোয়াড়ে' পরিণত হয়েছে।

খালি চোখেই ব্যাপারটা এরকম- ইরানকে ঘিরে রেখেছে মার্কিন ঘাঁটি; সেসব ঘাঁটি, সঙ্গে রিয়াদ আর তেল আবিবকে নিয়মিত অস্বস্তি দিচ্ছে ইরানের 'বন্ধু' হিজবুল্লাহ, হুতি, হামাস, ইসলামিক জেহাদ, আমাল মুভমেন্ট, ফাতেমিয়ুন, জায়নাবিয়ুন, পপুলার ফোর্স মুভমেন্টের মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলো। আর এ সংগঠনগুলোকে এক ছাতার নিচে রেখে ক্রমাগত সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছে কুদস ফোর্স, ইরানের ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ডের 'ফরেন উইং'। একধাপ এগিয়ে অনেকে এও মনে করেন যে, এ পুরো পরিকল্পনাই আদতে কুদস ফোর্সের প্রধান ইরানি কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেমানির 'ব্রেন চাইল্ড'। তিনিই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে 'প্রক্সি ওয়ারের' প্রধান সেনাপতি।

পেন্টাগন-মোসাদের 'হিট লিস্টে' থাকা এ জেনারেল ৩ জানুয়ারি ভোরের দিকে মার্কিন হামলায় নিহত হয়েছেন। তার পর থেকে শুরু হয়েছে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার প্রহর গণনা। কী হবে মধ্যপ্রাচ্যের? আরেকটি নতুন যুদ্ধ কী আসন্ন? প্রায় সব পরাশক্তিই তো মাঠে, তাহলে কী আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে?

এসবের উত্তর পাওয়া সহজ নয়। আমরা বরং একটু পিছিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ও পরাশক্তিগুলোর সম্পর্ককে ধরার চেষ্টা করি।

খেয়াল করুন, ইরাকে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সে হামলায় নিহত ব্যক্তি আবার ইরানি, উপসাগরের সব দেশ মিলিয়ে যে ক'জনকে 'টপ মোস্ট' প্রভাবশালী মনে করা হয়, তাদের একজন। সে-ই ইরাক, যেখানে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছিল। অপরাধ- 'সাদ্দামের কাছে এমন ভয়াবহ মারণাস্ত্র আছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি'; ইরাক দখল করেছিল তারা, হত্যা করেছিল সাদ্দামকেও। দেড় দশক পর একই দেশে 'মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি' বিবেচনায় সোলেমানির লাশ পড়ল।

অনেক বিশ্লেষকেরই ধারণা, সাদ্দাম মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাববলয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দেয়াল ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র সে দেয়াল গুড়িয়ে দেয়ায় দেশে দেশে 'পপুলার রেজিস্ট্যান্স' ফোর্সের বিকাশে তেহরানকে আর বেগ পেতে হয়নি। সাদ্দামের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র-গোষ্ঠী আর নানামাত্রিক দ্বন্দ্বে ঘি ঢেলে দেয়; যার সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্থান ঘটে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের। সুন্নি এই জঙ্গিগোষ্ঠী ইরানের 'বন্ধু'দের বেশ নাজেহালই করে দিয়েছিল। যা স্পষ্টতই সুবিধা করে দিচ্ছিল সৌদি আরব আর ইসরায়েলকে।

এর মধ্যে সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে রক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে ২০১৫ সালে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার আবির্ভাব তেহরানের জন্য শাপেবর হয়ে ওঠে। নিজেদের বন্ধুদের আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি 'শত্রুর শত্রু, আপাত মিত্র' কৌশল নিয়ে ইরান হাত বাড়িয়ে দেয় তুরস্ক আর কাতারের দিকেও। যার সর্বশেষ নিদর্শন আমরা দেখবো গত মাসের কুয়ালা লামপুর সামিটে কাতার-ইরান-তুরস্ক-মালয়েশিয়ার 'ডলার এম্পায়ার' রুখতে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন কিংবা প্রয়োজন পড়লে মুদ্রা ব্যতিরেকে পণ্য বিনিময়ের সমঝোতার ভেতর।

সিরিয়ায় বাশারের কর্তৃত্ব ফিরে এসেছে; লেবাননে হিজবুল্লাহরা এখন ব্যাপক ক্ষমতাধর, ইয়েমেনে হুতিদের হাতে নাকাল সৌদি নেতৃত্বাধীন 'সুন্নি নেটো', রিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা চালিয়ে নিজেদের সক্ষমতারও জানান দিয়েছে তারা, ইরাকে শিয়ারা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে; তেহরানের প্রভাব বাড়ছে কুয়েত, বাহরাইন, জর্ডানে। হরমুজকে করায়ত্ব রাখতে যে তারা পিছপা হবে না তা পাল্টাপাল্টি জাহাজ জব্দে বোঝা গেছে; উপসাগরে এত এত মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেই গত ডিসেম্বরে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়াও করেছে।

এ সব কিছুই ইরানের প্রভাববলয় বৃদ্ধির প্রকাশ্য ঘোষণা, যা ক্রমাগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলেছিল। কাসেম সোলেমানিকে 'শেষ করে দেওয়া' সেই উদ্বেগে খানিকটা যে স্বস্তি এনে দেবে, তা বলাই বাহুল্য।

কুদস চিফের নিহত হওয়ার খবর কাদেরকে তৃপ্ত করবে? ইসরায়েল, সৌদি আরব এবং অতি অবশ্যই মৃতপ্রায় আইএসকে। আইএসবিরোধী লড়াইয়ে সোলেমানি ছিলেন অন্যতম প্রধান 'আর্কিটেক্ট'। সামনের দিনগুলোতে ইরাকের বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোন হামলার ঘটনা বাগদাদ ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলবে। বিক্ষোভে এমনিতেই জেরবার ইরাক, সোলেমানির মৃত্যু শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকেও খানিকটা হতদ্যম করে দেবে, যার ফায়দা তুলবে আইএস। এমনিতেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশটির বেশকিছু অঞ্চলে জঙ্গিদের ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার লক্ষণ মিলছিল।

'প্রধানতম শত্রুর' অন্যতম শীর্ষ কমান্ডারের মৃত্যুতে খানিকটা চাপে থাকা সৌদি আরব পেতে পারে আমোদ; কুদস এবং তার বন্ধু সংগঠনগুলোর 'ডিফেন্সিভ স্ট্যান্স' লেবানন-ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের শক্তি প্রয়োগের মাত্রাও বাড়িয়ে দিতে পারে।

ইরান কিভাবে প্রতিশোধ নেবে, তা নিয়েও নানান জল্পনা কল্পনা চলছে। ভুলে গেলে চলবে না, ওয়াশিংটন-তেহরানের এ দফার চাপান-উতোরের মেয়াদও কমদিনের নয়। ট্রাম্প ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে আগের সব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে এ উত্তেজনার শুরু করেছিলেন। ওই ঘটনা ইউরোপের মিত্রদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দূরত্ব বাড়িয়েছে; অন্যদিকে ইরানও ধীরে ধীরে তার ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কর্মসূচির মাত্রা বাড়াচ্ছে। হরমুজে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত নিয়ে দুই পক্ষ এর আগেও একবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সুতরাং সব পক্ষই যে যুদ্ধের জন্য 'প্রস্তুত', তা বলা যাবে। গত বছর থেকে পেন্টাগন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনার পরিমাণও দফায় দফায় বাড়াচ্ছে। সোলেমানির ওপর হামলার দিন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন রণতরী আর ঘাঁটিগুলোর অবস্থাও তাহলে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।

এবার সোলেমানি ইরানের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার ওপর আলো ফেলা যাক। কুদস ফোর্স ইরানি সেনাবাহিনীর অংশ হলেও এটি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লার অধীন। কুদস বাহিনীর প্রধান সরাসরি খামেনির কাছে জবাবদিহি করেন। কুদস ফোর্সের কর্মপরিকল্পনা, ছক সবই খুবই গোপন থাকে; এর কৌশলও জানেন অল্প ক'জনই। মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে পরিস্থিতিতে প্রতিমুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়; কৌশল ঠিক করতে হয়; আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে সোলেমানির নেতৃত্বে অসাধারণ দক্ষতাতেই এগুলো সামলেছে কুদস ফোর্স। এবার? ইসমাইল ঘানি দীর্ঘদিন ধরে সোলেমানির ডেপুটি ছিলেন, কুদসের নতুন প্রধান হিসেবে তাই আগের কাজগুলো চালিয়ে নিতে তার খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সোলেমানির রিপ্লেস হিসেবে তিনি অতখানি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন কিনা, তাই এখন দেখার অপেক্ষা।

সোলেমানি নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মার্কিন চিত্র পরিচালক মাইকেল মুর তার ফেইসবুক পোস্টে ট্রাম্পের বেশ কয়েকবছর পুরনো একটি টুইটের ছবি শেয়ার করেছেন। ওই টুইটে ট্রাম্প বারাক ওবামাকে অভিযুক্ত করে বলছেন, নির্বাচনে জিততে ওবামা ইরানের বিরুদ্ধে নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। অনেক সংবাদমাধ্যমে ক্লিনটনের ইমপিচমেন্ট শুনানির সময়কালের ঘটনা তুলে আনছেন; সেসময়ও মধ্যপ্রাচ্যে 'নতুন উত্তেজনার' খবর খুব চাউর হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা করেছিল। ইতিহাস তার অক্ষরেখা ঘুরে আবারও একই স্থানে এসে পৌঁছেছে বোধহয়। কারণ, এবছরও যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচন; এবং ট্রাম্পকে সিনেটে ইমপিচমেন্ট শুনানির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী জোয়ার উসকে দিয়ে জনমত নিজের পক্ষে নিতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন সেনাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছেন বলে ডেমোক্রেটদের দিক থেকে অভিযোগ চলেও এসেছে।

সমর বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, এতদিন উপসাগর আর মধ্যপ্রাচ্যের স্থানে স্থানে প্রক্সি ওয়ার চললেও সোলেমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র অনানুষ্ঠানিক একটি যুদ্ধই শুরু করেছে। ইরানের কাছ থেকে পাল্টা জবাবও অনুমিত। তবে তাকে পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। এখানে ধর্মীয় ভেদাভেদ বিদ্যমান, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, অঞ্চল ভেদ সবই উপস্থিত। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তো এমন এক দামামা বাজছে, যেখানে সুদূর কল্পনাতে থাকা যে কোনো কিছুও মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে যেতে পারে। যেমনটা এমনকি সোলেমানির ওপর হামলার কথাতেও বলা যায়। আঞ্চলিক ও ক্রিয়াশীল পরাশক্তিগুলোর অনেকের হাতেই যেহেতু পারমাণবিক অস্ত্র আছে, ফলত, মুখোমুখি যুদ্ধে নেমে যাওয়ার চিন্তা বাতিল করতেই হবে। তাই কথার লড়াইয়ে তেহরান প্রায়ই 'মধ্যপ্রাচ্যের সব মার্কিন নৌযান ও স্থাপনা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় আছে' বলে হুংকার ছাড়লেও, সত্যিই তারা সোলেমানির মৃত্যুর পাল্টায় এমন কিছু করে দেখাবে বলে মনে হচ্ছে না। কিংবা সেটা করলেও আরেকটু সময় নিয়ে। ছদ্মযুদ্ধে এতদিন তারা বন্ধু এবং তাৎক্ষণিক কৌশলের ওপর ভর করে সাফল্য পেয়েছিল; মুখোমুখি যুদ্ধে অনেকগুলো ফ্রন্টের লড়াইয়ে সে সুযোগ নেই। সম্ভবত, এ কারণেই, তারা যেটা করতে পারে, তা হলো সুযোগের অপেক্ষা; পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বন্ধু ও অংশীদারদের অগ্রযাত্রাকে শানিত করা। এক্ষেত্রে সোলেমানি হত্যাকাণ্ডের 'প্রতিশোধে' ভয় বেশি পাওয়ার কথা মধ্যপ্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদেরই।

২০২০ সালের শুরুটা যে ওই অঞ্চলে শান্তির দূরবর্তী সম্ভাবনাকে আরও অনেকগুলো কদম পিছিয়ে দিল, তা বোধহয় চোখ বন্ধ করেই বলে ফেলা যায়।