শূন্যদর্শন

আহমেদ ফিরোজ
Published : 16 Jan 2012, 02:25 PM
Updated : 16 Jan 2012, 02:25 PM

প্রথম ভাগ
পৃথিবী গ্রহের প্রাণী ও জীবকুলের জন্য নিরাপদ আবাসভূমির অনিশ্চয়তায় ক্ষত-বিক্ষত আমরা সবাই। এই আমরা মানুষেরা একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ প্রতিনিয়ত কল্পনা করি। আমাদের চিন্তাচেতনা ও বাহ্যিক জ্ঞানের বিকাশ এসবের পক্ষেই। আমরা আমাদের প্রত্যাশিত স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে চাই। স্বপ্নগুলো খেলা করে, কখনো মাতিয়ে তোলে অপরিসীম বিশ্বাসে। শূন্যযাত্রা বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ সুন্দর একটি দেশ ও পৃথিবীর পথে ক্রমাগ্রসরমান। সে-যাত্রায় যাত্রী আমরা সবাই–গ্রহবাসী।

তার পরও দশ দিকে হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ ও চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব; কিছু নেই, কিছু চাই, কিছু পাই, কিছু পাই না–এই দ্যোতনা অনন্তকালের। এই যে নেই অর্থাৎ শূন্য বা ফাঁকা এই-ই আমাদের শক্তি। কেননা নেই যখন, তখন হবে। এর নাম স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন সার্থক করে তোলা। এই যে নেই–এই নেইকে সুষ্ঠু ও সুষমভাবে কাজে লাগাতে পারাটাই হলো সফলতার সিঁড়ি।

তা ছাড়া শূন্যের মতাও অনেক। নিজেকে নিরাকারে বিকশিত করে আকারকে প্রকাশ করে। শূন্যের মহামতিতলে জগতের সকল কল্যাণ ও মুনিঋষিগণ ধ্যানযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন। এভাবে শূন্য তার প্রচলিত ভাবনার বাইরে এসে এক বড় মহত্তকে ধারণ করেছে। শূন্যের এই যাত্রাপথ নানা দিক থেকে অর্থপূর্ণ এবং গভীর ভাবের সম্মিলন। সে-কারণে আমরা যেমন প্রেমমুক্ত হতে পারি না, তেমনি শূন্যালোক ও শূন্যাধার অতিক্রম করতে পারি না। এভাবে আমরা শূন্যমায়ায় বাঁধা পড়ি। সীমা এবং অসীমের সসীমরূপ হলো শূন্য। এই তথ্যোদ্ধারই জগৎজ্ঞান ও আত্মশুদ্ধি অর্জন। এখানেই মুক্তি, এখানেই শক্তি, এখানেই জগতের মহামায়া লুক্কায়িত।

আবার সংখ্যাতত্ত্বে শূন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যে-কোনো সংখ্যার ডানে বসলে তা দশগুণ বেড়ে যায়, তেমনিভাবে বামে বসলে মান কমে যায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ব্যবহারের ওপর এর মান বা গুণ বেড়ে যাচ্ছে। 'ব্যবহার' এখানে মুখ্য। সে-কারণে সর্বক্ষেত্রে সুষম ব্যবহারের নিশ্চয়তা অত্যধিক।

তা ছাড়া '১' যখন অর্থ প্রকাশ করে, তখন প্রশ্ন জাগে তার আগের সংখ্যাটি কি তাহলে? '০'-ই অঙ্কতত্ত্বের প্রথম সংখ্যা এবং ০ যখন প্রচলিত আর কোনো অর্থ প্রকাশ করে না, তখন তা হয়ে যায় ভিত্তিভূমি বা ভিত্তিপ্রস্তরের সঙ্গে তুলনীয়। সে অর্থে ভিত্তি হিসেবে শূন্য ব্যবহৃত। '১'-এর ভিত্তি যেমন ০, তেমনি ১, ২, ৩ করে ৯-এ গিয়ে আবার ০-এর ব্যবহার। দেখা যাচ্ছে, এভাবে প্রতিটি দশমিকের ঘরে গিয়ে ০ অস্তিত্ব প্রমাণ করছে; যেখানে ব্যাকরণবিদগণ শূন্যকে অস্তিত্বহীনতায় পর্যবসিত করেছে। আবার ইংরেজিতে Zero অর্থে শূন্যাঙ্ক, অনস্তিত্ব বলে উল্লিখিত হলেও Zero + in (on)–কোনোকিছুতে মনোযোগ দান করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানেও মনোযোগ আকর্ষণার্থে ইতিবাচকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আমাদের বসবাসের এই পৃথিবীটাই একটি শূন্য। আবার পুরো জগৎটাই একটি শূন্য বা গোলকধাঁধা। পৃথিবীটা যখন শূন্যের ওপর ভেসে আছে, অন্য গ্রহ-উপগ্রহসমূহসহ, তখন শূন্য বা অদৃশ্য বা মায়াবাঁধনে আটকে থাকলেও শূন্য তার অবস্থানকে প্রমাণ করছে, অস্তিত্বকেও। যদিও তা ছোঁয়া যায় না, কিন্তু বোঝা যায়, অনুমিত হয় বা নির্দিষ্টতা প্রমাণ করে। সেহেতু শূন্য একটি বিশালত্বকে ধারণ করে এবং প্রমাণ করে সে তার নির্দিষ্ট অবস্থানে দীপ্যমান এবং পৃথিবী ও সৌরমণ্ডলীর সমস্তকিছুকে ধারণ করছে। অতএব এ-কথা প্রমাণের অপো রাখে না যে, শূন্য মানে নেই অথবা অস্তিত্বহীনতার স্যা নয়, বরং ব্যাকরণবিদগণের মুখে ছাইকালি মাখিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবেই সে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে।

এ ছাড়া আকাশ অর্থেও শূন্য ব্যবহৃত। আবার শূন্যবাদে–শূন্যই একমাত্র সত্য এবং তা থেকেই উৎপত্তি ও বিনাশ; এই মত। Nothing অর্থে যখন কিছু-না বা কিছুই না, তখনই প্রশ্ন জাগে–কিছুই না যখন তখন কিছু একটা। এই কিছুর খোঁজ সন্ধানই হলো অবস্তুগত দর্শন বা শূন্যদর্শন। মোটকথা তথাকথিতের বাইরে এসে শূন্য তার অস্তিত্বার্থের সঙ্গে বৃহৎকে ধারণ করে আছে।

অঙ্কতত্ত্বের বাইরে এসেও দেখা যায় শূন্য সর্বক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন সংখ্যা বা শক্তিকে সংযোগ-সংগ্রথিত করে জোড়া লাগায় বা সম্পর্ক তৈরি করে অথবা অর্থ প্রকাশ করে। এ ছাড়া শূন্য ব্যতীত অর্থাৎ ভিত্তি ব্যতীত ১, ২, ৩, ৪ করে বেড়ে ওঠা একটা ভিত্তি বা সম্পর্ক অথবা পাটাতন ছাড়া সিঁড়িতে পরিণত করে। এটা অনেকটা ঝুলন্ত সিঁড়ির রূপক। ফলে শূন্যই একমাত্র মানুষের বিচ্ছিন্ন সত্তাকে জোড়া লাগায় আর ভিত্তিভূমিকে করে কর্ষিত ও পবিত্র, সে-অর্থে শূন্যযাত্রা মায়ার খেলা হলেও, একবার যার মোহমুক্তি ঘটেছে–তার পুণ্যতাপ্রাপ্তি যুক্ত হয়েছে জীবনের গ্রন্থস্বত্বে। এর ফলে সুষম ভিত্তি রচনা ও উর্বরাবাদি ভূমি পেরিয়ে মানুষ যখন ১, ২ করে উপরে উঠতে থাকে, তখন তা হয় নিয়মিত, সংগ্রথিত, আর প্রকৃতোন্নয়ন। প্রকৃতোন্নয়ন ঘটলেই আসে মুক্তি বা বিকাশপর্ব যাত্রা। এ-যাত্রায় মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে, সফল হয়েছে এবং জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে।

বৌদ্ধতন্ত্রে শূন্যতাপ্রাপ্তি অর্থাৎ নির্বাণপ্রাপ্তি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বা মুক্তিলাভ, যেখানে ত্যাগের মহিমা এবং জীবকুলের জন্য পরম ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। পৃথিবী-বিখ্যাত মনীষীগণ বিভিন্নভাবে নানা ছত্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে শূন্য এবং শূন্যতত্ত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। এভাবে ধর্ম নয়, ভাষা নয়, বর্ণ নয়, রাষ্ট্র নয়–পৃথিবীজুড়ে মুক্তির সনদ নিয়ে এসেছে এই শূন্য বা ত্যাগের মহিমা। আবার বলা হয়, নিজেকে শূন্য করতে না-পারলে গ্রহণ করা যাবে কীভাবে? অর্থাৎ শূন্য করতে পারলেই তো গ্রহণ করা যায়, অর্থাৎ গ্রহণ করার জায়গা তো লাগবে। শূন্য এখানে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। যেমন গভীর সমুদ্রে মায়াবী অথচ স্পষ্ট চেনা বাতিঘর জাহাজকে কূলের দিশা দেয়।

এভাবে নিজেকে শূন্য করার মধ্য দিয়ে অপরের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং এটা পরীতি ও প্রমাণিত যে, অপরের কল্যাণ নিশ্চিত হলে নিজের কল্যাণ আপনাতেই নিঃসংশয় হয়। এই যে ত্যাগ, এর নামই প্রকৃত ধর্ম ও শিক্ষা এবং নিজের বিকাশোপলব্ধি ও বিকাশপর্ব-জীবনে আনন্দপূর্ণ কাল উপভোগ করা। পৃথিবীতে যে যত বেশি ত্যাগ করতে পেরেছে, সে তত বেশি মহৎ হয়েছে। তাই মহত্তের অপর নাম ত্যাগ।
দেখা যাচ্ছে, নিজেকে শূন্য করা বা খালি করার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করার অপরিমেয় শক্তি জেগে ওঠে বা অর্জিত হয়। কেননা খালি বা শূন্য না-করলে গ্রহণ করা যাবে না। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে মানসিক, শারীরিক ও আত্মিকভাবে আদর্শিত হওয়া–জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারে এবং গবেষণালব্ধ তত্ত্ব দ্বারা নিজেকে সম্পূর্ণ মানুষ করা। তত্ত্ব বলতে, যে তত্ত্ব আপনাকে সমৃদ্ধ করবে। এই আদর্শই শূন্যদর্শনের পথচলা।


অতীন্দ্রিয়, অলৌকিক এবং আধ্যাত্মিকতা–সবকিছুর উৎস শূন্যে। কোথায় নেই শূন্য! সবখানেই শূন্য এবং অদৃশ্য এক শক্তির পূজা চলছে সর্বকালজুড়ে। সৌরমণ্ডলীর জন্ম এবং প্রথম পুরুষ ও নারীর মিলন থেকে ছয়শো কোটি মানুষ ও ল-কোটি জীবকুলের এই জগৎ, সেখানেও এই শূন্যের খেলা অনন্তকালের করতলে ক্রিয়মাণ। সে-কারণে মানুষ ইচ্ছা করলেই শূন্যমুক্ত হতে পারে না, যেমন পারে না প্রেমমুক্ত থাকতে। প্রেমের উৎসও শূন্যে। আমাদের বেঁচে থাকা–বায়ু (অক্সিজেন) ও প্রাকৃতিক আর যা কিছু, এমনকি সমুদ্রের অতলে লুকিয়ে যে রহস্য যুগের পর যুগ আবিষ্কৃত হয়ে উন্মোচন করবে নতুন দিগন্ত; সেই দিগন্তের উৎসমূলে শূন্যের মায়াবী পরশ। ফরসা নারীর মুখ (হোক সে ত্বকে কালো-ফরসা-শ্যামলা, মনের রঙে যার উজ্জ্বলতা প্রস্ফুটিত) এবং ঠোঁটের স্পর্শে যে শূন্যতা–সেখানে প্রেম এবং বিরহ দুই-ই মিলেমিশে আছে নতুন এক শূন্যাশার শূন্যজলে। এর নাম ধর্ম–প্রেমধর্ম–যা জগৎকে টিকিয়ে রেখেছে, যাজকীয় সকল ধর্মকে তুচ্ছজ্ঞান করে।

আবার শূন্যতে এসেই মনের বাড়ি স্থিত হয়। শূন্যায়নের অনুশীলন মনকে লক্ষ্যস্থির, মনোযোগ সৃষ্টি, সময়ের সদ্ব্যবহার ও প্রশান্ত করে। যে-কোনো বিষয়ে মনোযোগ সৃষ্টিতে শূন্যায়নের গুরুত্ব তাই অত্যধিক।


শূন্য হলো পরম মায়ার আসন। যেখান থেকে সহজে ফেরা যায় না, ফেরা গেলেও এতো দেরি হয়ে যায় যে, সামনে আরো অনেক দূর যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য জন্ম থেকেই শূন্যযাত্রা হলে ভিত বা সৌম্যযাত্রা আনন্দময় ও শক্তিশালী এবং অনন্যগ্রাহ্যতা পায়।

শিশু বয়সে শূন্যের মায়াসন অতটা প্রভাব না-ফেলায় দ্রুত অগ্রগামী হওয়া সহজ হয়। কারণ সে-বয়সে আবেগ এবং যুক্তিগ্রাহ্যতা কম থাকে। তা ছাড়া যে-কারণে মানুষ জন্মগতভাবেই অসুখী–সেই বাসনা ও স্বার্থপরতা তখন থাকে না।

মানুষের জন্ম '১' এবং '০'-এর ঠিক মাঝামাঝি বিন্দুতে। সে-কারণে মানুষ সামনে ১ (উচ্চাশা) দেখে পেছনে শূন্যের মায়া ভুলে যায়, ফলে যা হবার তাই অবধারিতভাবে ঘটে, আর তা-হলো ভিত্তিছাড়া ঝুলন্ত পথপরিক্রমা অর্থাৎ মাটিস্পর্শহীন গন্তব্য খোঁজা–যা খুঁজতে গিয়ে কিছু একটা মেলে (পথও তো একটা কিছু), কিন্তু প্রকৃত যাত্রা স্বভাবতই ব্যাহত হয়। ফলে মানুষ অল্পতেই আশাহীন ও ভেঙে পড়ে। এর কারণ যাত্রাপথ যদি সংগঠিত না-হয়, তবে ক্ষণে ক্ষণে বিপদগ্রস্ত বা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের জীবনের অপরিকল্পিত বেড়ে ওঠা সরু লম্বা গাছের মতো–যা সহজেই সামান্য বাতাসে ভেঙে পড়ে, লেপ্টে যায়, অস্তিত্বহারা হয়ে ঘোরে পথে-ঘাটে। যে-কোনো পথ, ল্যযোগ উদ্দেশ্যে তার কর্মফলের কাছাকাছি করে আর কার্যক্রম সুফল ফলিয়ে ছাড়ে, আর তাতে যদি স্বপ্ন থাকে–vission, তবে তা হয়ে পড়ে দিকচিহ্নবান। শূন্য সে কাজটিই করে, পথিককে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ধাবিত করে, আর পথকে করে সংগ্রথিত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমন–যে-কোনো বিল্ডিং-এর ভিত্তিপ্রস্তর গাঁথুনি তার ল্য নির্ধারণ ও আয়ুষ্কাল চিহ্নিত করে।

১ থাকে সামনে ০ পেছনে, অন্যার্থে ১ থাকে বামে, ০ থাকে ডানে। মানুষ বামের মোহে পড়ে ডানপন্থি অর্থাৎ সৎপন্থি হতে পারে না, ফলে পিছিয়ে পড়ে। সৎ-এর উৎস দুইভাবে–এক. ভেতর থেকে (ডান); দুই. বাইরে থেকে (বাম)।

শুরুতে শূন্য থেকে যাত্রা করলে দেখে-শুনে ১-২ হয়ে পথ পাড়ি দেয়া যায়, তাতে গন্তব্য সহজ আর নির্ভুল হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শূন্য হয়ে ১, ২ করে মনে করুন ১১ পর্যন্ত গিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম শূন্য থেকে শীর্ষবিন্দু হয়ে ফিরতে চেয়েছেন, ফলে অনির্দিষ্ট সম্ভাবনা ও আত্মিক জলপ্রমোদ তাঁকে মুক্ত করেছে বধির করে, কেননা উনি এতোদূর গিয়ে ফিরতে গিয়েছেন যেখানের ভাষা আধ্যাত্মিকতার চরম বিন্দু ছুঁয়ে ফেলেছে–যা অব্যক্ত (মারফত), লোকমুখে বা সাধারণ পর্যায়ে প্রচারযোগ্য নয় এবং যা লিখিতভাবে বলতে নেই।

আমরা পরবর্তী পৃষ্ঠার চিত্র-১ থেকে দেখতে পাচ্ছি '০' অর্থাৎ ভিত্তিভূমি পেছনে ফেলে কীভাবে একজন মানুষ '১' থেকে যাত্রা করছে। কোয়ান্টাম মেথড বা মেডিটেশন সায়েন্সের বক্তব্যানুযায়ী যেহেতু সাধারণ মানুষ তার মস্তিষ্কের ১০০ ভাগ মতার মাত্র ৫-৬-এর ওপরে যেতে পারে না বা ব্যবহার করতে পারে না, সেহেতু এখানে ১-৬ পর্যন্ত সিঁড়ির ধাপ গণনা দেখানো হলো। চিত্র-২ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ১ থেকে যাত্রা করলে অর্থাৎ ০ ভিত্তিভূমি ফেলে আসলে যাত্রাপথটা কেমন করে ঝুলন্ত হয়ে পড়ে, ঝুলন্ত সিঁড়িতে উপরে ওঠা যায়, তবে যে-কোনো মুহূর্তে ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ওপর আর তখন মাটিস্পর্শহীনকে ধরে রাখতে পারে না।

এর ফলে দেখা যায়, আমাদের সমাজে এই রাজা–এই ফকির; অর্থাৎ অন্যায় করে, ঠকবাজি করে, চাঁদাবাজি করে অথবা টেন্ডারবাজি করে এই বড়লোক (ধনী), পাঁচ-ছয় বছর পর আবারও ফকির–যে-পথে উন্নয়ন সেই পথেই অধঃপতন। যে দু-একজন টিকে থাকছে–রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায়, তাদের অবস্থানও ক্ষণস্থায়ী। কেননা সত্যকে যেমন চাপা দেয়া যায় না, তেমনি ঘুষখোরের অবৈধোপার্জন (টাকা-পয়সা) অপথে-বেপথেই ব্যয় হয় এবং তার সর্বোচ্চ মূল্য দেয় তাদের সন্তানরা (এই নিয়ে একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে, বলা হয়–চৌদ্দপুরুষের পাপ বহন অর্থাৎ গত চৌদ্দপুরুষের দায়ভার বহন। এমন উদাহরণ সমাজে বিরল নয়)। এ ছাড়া ঝুলন্ত সিঁড়িতে ওপরে ওঠা যায়, কিন্তু দেখে-শুনে নয়–অন্ধের মতো। কারণ দেখার কোনো সুযোগই থাকে না, হাতড়িয়ে আর কতদূর ওঠা যায়! ফলে সেখানে প্রাপ্তির আনন্দের চেয়ে বিস্ময় ও বিচ্ছেদ জড়িত থাকে বেশি।

ওপরের ৩ নং চিত্রে দেখানো হয়েছে কীভাবে একজন মানুষ ০ অর্থাৎ ভিত্তিভূমি থেকে যাত্রা করছে এবং বেড়ে ওঠা অবস্থানও কীভাবে ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে, প্রশস্ত হচ্ছে সিঁড়িপথ। এটা ভেঙে পড়বে না বা ব্যর্থ হবে না। তবে 'সবকিছু ভেঙে পড়ে' যেমন, তেমনি এ-ও হয়তো একদিন ভেঙে পড়বে; তবে দীর্ঘদিন পর বা নির্দিষ্ট সময়ান্তরে। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, যার গাঁথুনি ও ভিত রচনা যত শক্ত হবে–পথপরিক্রমাও ততই টেকসই হবে। মানুষ যে-আশায় বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে, এটা সেই আশা বা স্বপ্নের সর্বোচ্চ অবস্থানকে ধারণ করে আছে।


সীমা, সীমানা নির্দেশ করে। সবখানেই একধরনের সীমাবদ্ধতা বা সীমাঙ্ক লক্ষণীয়, সে-ক্ষেত্রে প্রথমেই সীমাকে বুঝে উঠতে হবে তার কালপরিধি। সীমা থাকবেই, যেভাবে ১ থেকে ১০০ এবং তারও অধিক বাড়তে থাকে–সংখ্যাগত থেকে পরিমাণগত; তদ্রুপ সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না, তবে সীমার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।

বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যাবার সুযোগ থাকবে এবং ক্রমশ নতুন নতুন বৃত্ত তৈরি হবে, সঙ্কুচিত-প্রসারিত দুই-ই হবে কর্ম-প্রয়াস ও সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর ভিত্তি করে; কখনো-বা ভেঙে বেরিয়ে যাবে–যা নবালোকচ্ছটায় বিকশিত হবে। অলস মূর্খেরা এই বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে না, অথবা নতুন বৃত্ত তৈরি, প্রসার ও ঊর্ধ্বে উঠতে বা যেতে পারে না; সে জন্য প্রয়োজন সুষম জ্ঞানচর্চা ও তার বিকাশ। যার ফলে এক সীমা থেকে বের হয়ে আরেক সীমায় পদার্পণ করা যায়, আঁকা যায় বা যাওয়া যায়। আর তা যেন হয় নবম (৯) থেকে দশমে (১০) ওঠার মতো বৃত্ত-ভাঙা বা সিঁড়িঘর পেরোনো। দশম (১০) থেকে একাদশে (১১) এভাবে যতদূর…, শুরু যদিও ঐ শূন্য থেকেই।

সীমা ভেঙে বেরিয়ে আসা এবং শুরু অর্থাৎ ভিত রচনা খুঁতহীন করার আদর্শই শূন্য কনসেপ্ট বা ধারণার মূলকথা। বলা হচ্ছে, শূন্যতাপ্রাপ্তি অর্থাৎ নির্বাণপ্রাপ্তি বা মুক্তিলাভ। নিজেকে শূন্য করতে পারা এবং গ্রহণ করা। কী গ্রহণ করবে? বিজ্ঞান এবং মানুষের অংশগ্রহণমূলক জ্ঞান ও গবেষণালব্ধ তথ্য ও তত্ত্বশাস্ত্র। কোনোকিছু করতে হলে একটি আদর্শকে সামনে রেখেই করা উচিত ইতিবাচকার্থেই, শূন্যদর্শনের প্রয়োজন এখানেই। শূন্য বা অদৃশ্যকে জানা এবং এগিয়ে যাওয়া? কীভাবে? তিনটি শক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে, যেখানে–১. চিন্তাশক্তি, ২. ইচ্ছাশক্তি এবং ৩. দৈহিকশক্তি বা শ্রমশক্তির মেলবন্ধন থাকবে।
আবার সীমা যেন ধর্মের মতো না-হয়ে যায় যে–এর বাইরে আর যাওয়া যাবে না।

ধর্মের গণ্ডিবদ্ধতা এরূপই আঁটসাঁট, যেখান থেকে বেরোনো যায় না। পৃথক চিন্তা করার সুযোগও থাকে না এবং যাজকেরা কূটকৌশলে স্বর্গ-দোজখ দেখিয়ে কিনে নেয় মানুষের বিবেক ও বুদ্ধি-বিবেচনা। তখনই আর মুক্তি সম্ভব হয় না। স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়ে নেমে আসে অধীনতা, সীমা বা তৈরি হয় দাসপ্রথা। ফলে আমরা সাফল্যের বিপরীতে এসে হাতড়ে ফিরি চারপাশ। অথচ একটু আগালেই অথবা বৃত্ত ভাঙলেই হয়তো প্রত্যাশিত সাফল্যের কাছাকাছি যাওয়া যেত।

এ ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে বলা যায়–আমরা সবাই তোষামোদ বা ঘুষ খেতে বা পেতে ভালোবাসি অথবা প্রশংসার মুড়িঘণ্ট ভরাপেট; এমনকি সৃষ্টিকর্তা পর্যন্তও, যিনি বেশি বেশি ইবাদত চেয়েছেন। অর্থাৎ যে যত দিতে পেরেছে সে তত তার দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাক আর না-পাক সে প্রক্রিয়ায় বেশি এগিয়েছে। জগতেও এমনই ঘটছে।

এ তো গেল ধর্মের কথা। এবার বৃত্ত ভাঙার আরেকটি গল্প বলি। এটা আসলে গল্প নয়, বিন্দুর খেলা (নয় বিন্দুর খেলা) বা বিন্দু ছোঁয়ার সরলাঙ্ক।

এ-কর্মটি করতে শুরুতে যে শর্তগুলো ছিল, তা হলো :
১. চারটি সরলরেখা দিয়ে বিন্দুগুলো ছেদ করতে হবে বা ছুঁতে হবে।
২. পেন্সিল বা কলম তোলা কিংবা রি-ড্র (re-draw) করা যাবে না।
৩. তবে সরলরেখা ক্রস (cross) করা যাবে।

সীমার বাইরে যাওয়া যাবে না, এ-কথাটি শর্তের কোথাও বলা ছিল না। ফলে নয় বিন্দুর মস্তিষ্ক ডিস্কে বহন করা চতুষ্কোণ ভেঙে যখন বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে তখনই খেলাটি সুসম্পন্ন হয়েছে বা লক্ষের দিকে এগিয়েছে। এটা যদিও একটা খেলা তবু এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতার্থেই আমাদের তথাকথিত আইডিয়াকে উতরানোর একটি পদ্ধতি-উদাহরণ হতে পারে। সেভাবে আমরা যদি সাফল্যের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলতে বা দেখতে চাই, তবে আমাদের তথাকথিত সকল সীমা ভেঙে ফেলতে হবে এবং বেরিয়ে যাবার পথ রাখতে প্রতিনিয়ত নতুন বৃত্তে প্রবেশের ও ভেঙে ফেলার দ্বার উন্মোচন করতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য বা উন্নয়নের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভবপর হবে।
বৃত্ত বা সীমা ভাঙার প্রসঙ্গটি মূলত শূন্য থেকেই এসেছে। কেননা এগুলোও বিন্দু-আকৃতির একপ্রকার শূন্যের শামিল। কিন্তু শূন্য (তথাকথিতার্থে) বা বৃত্ত বা সীমা আমাদের প্রত্যাশা নয়।


আমার বাবাই হলেন সকল অযাচিত প্রশ্ন এবং উত্তরের পাশে একজন জ্ঞানপাপী মূর্খ এবং সংজ্ঞাপ্রাপ্ত জ্ঞানী, যিনি ডুবিয়ে শিখিয়েছেন আবার ভাসিয়েছেন ভাসানে। জোয়ার-ভাঁটা দুই-ই স্পর্শকাতর। কিন্তু আমার বাবা সঙ্গমবুদ্ধ পুরুষের মতোই পুরুষ এবং মানুষ। আমি যদিও এখন পর্যন্ত আমাকে এবং আমার বাবাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে দাবি করি না। কেননা তিনি শয়তান এবং ঈশ্বর উপাসক; আমার দুটোতেই বিশ্বাস নেই।
যা-হোক বাবার সান্নিধ্যের একটা আলাপ-পর্বের উল্লেখ করছি। তিনি একদিন রাত্রে, খাবারের শেষে আমার চার বোনসহ মা-র উপস্থিতিতে একটি প্রশ্ন ছুড়লেন সকলকে উদ্দেশ করে; যদিও তার মূল টার্গেট ছিলাম আমরা ভাই-বোন। তিনি বললেন, বলতো '১'-এর পূর্বের সংখ্যাটি কী? আমার বড় তিন বোন, ছোটজন সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। কারো কোনো জবাব নেই। মা বললেন, বিটকিলি প্রশ্ন–'১'-এর আগে আবার কিছু থাকে নাকি? বলে তিনি অন্য কাজে গেলেন। বাবা বললেন, আছে। আমরা সবাই ছানাবড়া চোখে বাবার দিকে তাকালাম! তিনি বললেন '০'।
এই শূন্যের মাহাত্ম্য এবং আদ্যপান্ত আর কিছু না-জেনেই উঠে পড়া। এরপর অনেকদিন। পরবর্তী সময়ে উনি একবার বলেছিলেন, আমরা সবাই ১-কে প্রথম সংখ্যা ভেবে–এক থেকে যাত্রা করি এবং ভুল করি পেছনে একটি সংখ্যা ফেলে রেখে এসে এবং ১, ২, ৩, ৪ করে ধরো ৫ অথবা ৬-এ পৌঁছে গেছি। এবার ভাবো পেছনে আরো একটা সংখ্যা ফেলে এসেছো–যা ছিল ভিত্তিপ্রস্তরের মতোই আদিঅস্থিমজ্জারূপ।
তা ছাড়া গণিতশাস্ত্রেও এই একটি সংখ্যাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ–যা আগে বসলে তার গুণফল, যোগফল, ভাগফল, বিয়োগফল–নিজেই শূন্যগর্ভে* নিয়ে যায়; আবার পরে বসলে সকল সংখ্যাতত্ত্বের গূঢ়ার্থ অর্থাৎ মান নিরূপণ করে বা পরিমাপাঙ্ক মূল্যাঙ্গে পৌঁছে যায়; যেমন টাকা। মনে করো, আমরা যারা ১ থেকে শুরু করে ৬-এ পৌঁছেছি–এখন আমার বয়স ৪২। এ-বয়সে এসে কত বছরে ফেলে আসা শূন্যে (ভিত্তিমূলে) যাওয়া যাবে, আবার ফেরা? তা ছাড়া আমাদের গড়ায়ু মাত্র ৫৭ বছর। তাতে ফিরে গিয়ে পূর্বস্থলে ফিরে আসা কি সম্ভব? গড়ায়ু অনুসারে বাকি ১৫ বছর।
তা ছাড়া আমি কি ফিরে যাবো? নাকি ভিত্তিপ্রস্তর ফেলে যেভাবে এসেছি এতোদিন সেভাবেই সামনে আগাব? কী হবে আমার সিদ্ধান্ত? তা ছাড়া শুনেছি শূন্যের নাকি এক অপরিসীম মায়ার বাঁধন-বেষ্টনী, ফিরলে আবার সেখান থেকে ফেরাও দুঃসাধ্য। তা ছাড়া সামনে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ১ থেকে ৬ এবং বাকি মাত্র ১৫ বছর। কী করবো আমি এবং তুমিই-বা কী করবে? আমার বয়স তখন ৮। বাবার ফেরা হয়েছে কিনা অথবা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরবর্তী সময়ে তা আর আমার জানা হয়নি–নানা কারণে। তবে বর্তমানে তাঁর বয়স ৬৪ বছর।
এই যে ফেলে আসা সংখ্যা–সেখানে আমি ফিরতে চাই কিনা? প্রশ্নগুলো সরল মনে হলেও, অত্যন্ত জটিল এবং কুটিল; আমার কাছে বিশেষ করে। সে-কারণে ফেরার ভাবনা মাঝে মাঝে জেঁকে বসে আবার ফিরলে ফেরা যাবে কিনা অথবা কতদিনে বা কতবছরে? আবার ফিরে আসা, এমনো তো হতে পারে আর ফেরা হলো না শূন্যের অভেদ্য বেষ্টনী ভেঙে। বয়স আটাশ গড়িয়ে ঊনত্রিশে। তাহলে করণীয়টাই-বা কী?
আমি ফিরতে চাই–ফিরে যাচ্ছি শূন্যের দিকে। বৌদ্ধ শাস্ত্রে একটি কথা আছে–'নির্বাণপ্রাপ্তি'। এতেই মুক্তি–এতেই ভক্তি–এতেই শক্তি। নির্বাণপ্রাপ্তি অর্থাৎ শূন্যতাপ্রাপ্তি। গণিতশাস্ত্রে শূন্যের গুরুত্ব এবং গুরুত্বহীনতা আমাকে টানে না; বরং মহান সম্মানীয় বুদ্ধের নির্বাণপ্রাপ্তি অর্থাৎ শূন্যতাপ্রাপ্তি আমাকে টানে। যে-কারণে সকল ধর্মগ্রন্থ পড়ছি আর ভাঙছি–ভাঙছি আর লিখছি–লিখছি আর পড়ছি। পড়া আর পড়া, পড়ার বিকল্প দেখি না। জ্ঞানী হওয়া অথবা জ্ঞানার্জনের জন্যই শুধু নয়–আমি আমাকেই চিনতে এবং বুঝতে এবং অন্যকে–জগৎকে–মানুষকে চিনতে চাই–চিনবার প্রত্যয় রয়েছে। এই প্রত্যয়ই এখন আমার ধর্ম।
সক্রেটিসের অমরবাণী–Know Thyself–নিজেকে জানো। নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে জগৎকে চেনা। এই চেনাই আমার শূন্যযাত্রা এবং শূন্যদর্শন।
* যদিও শূন্যগর্ভে পদার্পণ সাম্যবাদের মূলাদর্শকে চিহ্নিত করে, আর সর্বক্ষেত্রে সমান ও সহাবস্থানকে করে সমর্থন।

তারিখ : ১৬ জানুয়ারি ২০১২