শূন্যদর্শন : দ্বিতীয় ভাগ

আহমেদ ফিরোজ
Published : 20 Jan 2012, 12:54 PM
Updated : 20 Jan 2012, 12:54 PM

সর্বশূন্যবাদ
সর্বশূন্যবাদে সকল কিংবা কোনো কিছুই পরমার্থ নয়, যদিও তার ব্যবহার আছে, মানা হয়। আর সর্বসত্যিবাদের সম্পূর্ণ প্রতিপভূত হলো সর্বশূন্যবাদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ্য, বুদ্ধর জ্ঞান-শূন্যতা এবং সর্ব-ধর্ম-শূন্যতা ঘোষণার কথা।
ধর্মসমূহের শূন্যতা উপলব্ধিজাত জ্ঞান থেকে বলা যায়, সাধকের মনে ঐ শূন্যতার জ্ঞান অবশেষ থাকবে এবং মনে হতে পারে, ঐ শূন্যতা যেন সত্য কোনো কিছু। পক্ষান্তরে ঐ শূন্যতা-জ্ঞানকেও পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যথা সর্বশূন্যতা পূর্ণ হবে না।

শূন্যতা
নির্বাণ যখন শূন্যতায় রূপান্তরিত, তখন মানুষকে কর্মফল দিয়ে অমৃতফল গ্রহণ করতে হয়। যারা অমৃতফল ক্রয় বা অর্জন করে, তারা সুখী হয়। সে অর্থে শূন্যতা নির্বাণই। যেহেতু নির্বাণ সর্বকুলেশূন্য, সেহেতু তাকে শূন্য বলা হয়।
সর্বদৃষ্টি শূন্য হয়ে পরমশূন্যতা, অত্যন্ত শূন্যতাকে গ্রহণ করলেই যোগী বা সাধক নির্বাণ লাভ করতে পারে। সে-প্রেক্ষিতে নির্বাণ শূন্যতারূপই। পঞ্চকন্ধের নিরোধই পরমশূন্য নির্বাণ। আর পঞ্চকন্ধ-শূন্য বলে নির্বাণ পরমশূন্য।
লোকোত্তরবাদীগণের মতে, যেখানে সর্ব থাকে না, সর্ব নিরুদ্ধ হয়, সর্ব উপশান্ত হয়, তাই নির্বাণ। সে-কারণে নির্বাণ সর্বাতীত বা সর্বশূন্য। তা সিদ্ধও করা যায়। সর্ব সংস্কৃত অনিত্য ও দুঃখ; আর নির্বাণ অসংস্কৃত নিত্য ও পরমসুখ। সুতরাং নির্বাণে সর্ব থাকতে পারে না। নির্বাণ সর্বশূন্য। সর্বশূন্য বলে নির্বাণ পরমশূন্য।

জগৎ শূন্য
মহাশূন্যবাদী গৌতম বুদ্ধ জগৎকে শূন্য বলেছেন, যেহেতু জগৎ আত্মা এবং আত্মীয় শূন্য। একে কেউ কেউ দ্বিকোটিক শূন্যতা বলে অভিহিত করেছেন।
এই মতে, উপরোল্লিখিত ও নিম্নোক্ত শূন্যতাসমূহ পর পর পরিগ্রহণ করে। অর্থাৎ দ্বিকোটিক শূন্যতা পরিগ্রহণে আত্মা নাই, অপর কিছু আত্মার নাই–যা পরিষ্কারভাবে স্থিত। পুন আমি কোথাও কিঞ্চিতও নাই, আমারও কোথাও কোনোখানে কিঞ্চিতও নাই–এই যা চতুষ্কোটিক শূন্যতা বলে কথিত হয়, তা পরিগ্রহণ করে।
চক্ষু, মন, রূপ, ধর্ম, চক্ষুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, চক্ষুসংস্পর্শ ইত্যাদি জরা-মরণ ধরে প্রত্যেকটিকে; আত্মা, আত্মীয়, নিত্য, ধ্রুব, শাশ্বত ও অবিপরিণামধর্ম–এই ছয় প্রকারে শূন্য বলে ভাবনা করাই ছয় আকারে শূন্যতা পরিগ্রহণ।
আট আকারে শূন্যতা, দশ আকারে শূন্যতা, বারো আকারে শূন্যতা, চৌদ্দ আকারে শূন্যতাও এই প্রকারে পরিগ্রহীত হয়, নির্দিষ্ট চক্রসন্ধিতে। [যার বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী সংস্করণে সন্নিবেশিত হবে।]
এই বিবেচনা থেকে উল্লিখিত পাওয়া যায়, রূপাদিকে এই প্রকারে দেখলেই মানুষ এবং লোককে শূন্যত দেখলেই মৃত্যু অতিক্রম করে।

আর্যসত্যচতুষ্টয় শূন্য
আর্যসত্যচতুষ্টয়ের শূন্যত বিনিশ্চয়ও জানতে, তথা অনুভব করতে হবে। শূন্যত সকল পরমার্থ সমস্ত সত্যসমূহই বেদক-কারক-নিবৃত্ত-গমকা-ভাব-হেতু শূন্য বলে বেদিতব্য। বলা হচ্ছে, দুঃখ নিশ্চয়ই আছে, পক্ষান্তরে দুঃখিত কেউ নিশ্চয় নেই। কারক কিংবা ক্রিয়াও নিশ্চয় নেই। নির্বৃতি নিশ্চয় আছে, পক্ষান্তরে নির্বৃত মানুষ নিশ্চয় নেই। নির্বাণের মার্গ নিশ্চয় আছে, পক্ষান্তরে তাতে গমনকারী নিশ্চয় নেই।
দুঃখ-সত্য ও সমুদয় সত্যে–ধ্রুবত্ব, সুখত্ব ও শুভত্ব শূন্য; অমৃতপদ বা নিরোধ সত্য–আত্মা শূন্য এবং মার্গ তথা সত্য–ধ্রুবত্ব, সুখ ও আত্মা শূন্য। এতেই শূন্যতা। সুতরাং আত্মা শূন্য, নির্বাণগামী এবং নির্বাণপ্রাপ্ত মানুষ শূন্য বলে নির্বাণ শূন্যতা।
নির্বাণ স্বভাবত একবিধ হলেও কারণ পর্যায়ে দ্বিবিধ হয় : সোপাধিশেষ-নির্বাণ-ধাতু এবং অনুপাধিশেষ-নির্বাণ-ধাতু; তথা আকারভেদে ত্রিবিধ হয়–শূন্যতা, অনিমিত্ত এবং অপ্রণিহিত।
[এখানে ব্যবহারযাত্রার সংক্ষেপরূপ তুলে ধরা হলো, পরবর্তী সংস্করণে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বর্ণনার পাশাপাশি শূন্যধর্ম নিয়েও আলোচনা করা হবে–যা শূন্যযাত্রার প্রাকৃত, প্রকৃত ও প্রকৃতিগত অবস্থানকে চিহ্নিত করবে আত্মটানে সহজেই এবং জ্ঞানতত্ত্বের বিকাশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে; যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি দেহ-মন ও আত্মাগতভাবে মিশে যাবে এবং অলৌকিকতার বিশ্বাস ও বিজ্ঞান একই পথে অগ্রগামী হবে। এর অর্থ, প্রচলিত ধর্মের অলৌকিকতা বা রূপকথারূপ আরব্যরজনীর মতোই শিহরিত করবে, কিন্তু মানুষ তার সত্যতা জানতে পারবে। যারা সত্য জানবে, তারা জ্ঞানধর্মের বিকাশে কাজ করবে। যারা জানবে না, তারা শয়তান ও অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস স্থাপন করবে। জ্ঞানীরা বিজ্ঞানকে ধর্মবিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, আর অজ্ঞানীরা তা নিয়ে মিছিল-মিটিং করবে, মারামারি-কাটাকাটি করবে, ফতোয়া-রাজনীতিতে মত্ত হবে। জ্ঞানী ও সচেতন, বিশেষ করে আত্মশুদ্ধ মানুষদের সতর্ক হতে তাদের থেকে–সর্বসমাজেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে হাজার বছরের অর্জন তথা ধারাবাহিকতাকে, অর্থাৎ পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকেও রক্ষা করতে হবে। তবেই শূন্যযাত্রা সফল হবে। মানুষ শান্তিধর্ম পালন করবে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও সাম্যবাদাদর্শে। যেখানে সুন্দর ও কল্যাণধর্ম শূন্যধর্মে পরিণতি পাবে।]

লালনধর্ম
লালনধর্ম কী? ঐশ্বরিক ধর্ম, নাকি মানুষের ধর্ম? বানোয়াট অথবা বানানো, নাকি স্বতোপ্রণোদিত? রূপকথারূপ গল্প, নাকি ঘটন-অঘটনের যে বাস্তব তার সত্যয়ন? মিথ্যা তবে কি ব্যাকরণিক ভাষা? ভাষার আরো মাধ্যম কী কী? উত্তর একটাই, লালন মানুষ ছিলেন, দেবতা বা প্রেরিত ব্যক্তি ছিলেন না।
লালনধর্ম তাই মানুষের ধর্ম, সহজকে জয় করা, শরীর ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং আত্মাকে দেখা, বিশ্বাস স্থাপন করা ও আত্মজয়ী মানুষে রূপান্তরিত হওয়া বা নতুন জন্ম লাভ করা। সে-কারণে প্রচল ধর্মকে অস্বীকার বা ত্যাগ করার মাধ্যমে আত্মধর্মে নিবিষ্ট হওয়ার নামই শূন্যধর্ম, অন্যার্থে লালনধর্ম। মানুষের চিরন্তন মুক্তি লালনের গানে ও ব্যাখ্যায় এবং বুদ্ধের শূন্যচর্চায় তথা নির্বাণের আধুনিকরণের ধারাবাহিকতায় বা দর্শন-বিশ্লেষণে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও ইউরোপের ইতিহাস, মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিনের দর্শন ও সাহিত্য পাঠ জরুরি। লালনকে চিনতে হলে, নিজেকে চিনতে হবে, নিজেকে চিনতে হলে অন্যকে চিনতে হবে অন্যকে চিনতে হলে পৃথিবীর ইতিহাস, বিজ্ঞান ও মার্কসবাদী সাহিত্য পূর্ণাঙ্গভাবে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া অপূর্ণাঙ্গ যাত্রা কখনো সম্পূর্ণ যাত্রাকে সমর্থন করবে না। যেখানে ভেঙে পড়ার নতুন গল্প শুরু হবে–যা জ্ঞানসিদ্ধ নয়, আবেগ বা আহাদের উপাখ্যানে পরিবেষ্টিত। লালন মানুষকে মানুষ হতেই বলেছেন, গরু-ছাগল বা অমানুষ নয়; মুখোশযাত্রা নয়, মুখোশোন্মোচনের আহ্বান, সত্যকে আবিষ্কারের ধারায় ফ্রেমমুক্ত করা। সেখানে লালন ধ্যান ও স্মরণে, জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে পরিব্যাপ্ত, পরিস্ফুট, সম্পূর্ণ, আভূমিতল সৌরগামী। আলোর পথের সন্ধান–মানুষযাত্রা। লালনধর্ম মানুষযাত্রাকে সমর্থন করে, উন্মুক্ত করে বিশ্বাসের ভিতভূমি এবং প্রসারিত করে জ্ঞানের দরজা-জানালা, অন্দর-বাইর থেকে আঙিনাদেশ–জন্মভূমি। এখানে লালনের সার্থকতা জন্ম এ বঙ্গে–বাঙালিয়ানা চরিত্রে, সুন্দর ও কল্যাণচর্চার সুবাদে।

তারিখ : ১৯ জানুয়ারি ২০১২