মহামারীতেও থেমে নেই জঙ্গিগোষ্ঠির চক্রান্ত

মনিরা নাজমী জাহান
Published : 21 Jan 2012, 05:05 PM
Updated : 14 June 2020, 03:41 PM

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে মূলত দুই ধাপে মানুষের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। একটি মহামারী চলাকালীন এবং অপরটি ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণে আসার পর নতুন পৃথিবীর বাস্তবতা। করোনাভাইরাসের সময়ে তৈরি সমস্যাগুলো ইতিমধ্যে আমরা দেখছি। 

এ সমস্যাগুলো বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক, এমনকি ব্যক্তিজীবনকেও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ মহামারীকে কেন্দ্র করে আমরা দেখেছি বিশ্বের দুই পরাশক্তির পরষ্পর দোষারোপের লড়াই। দেখেছি ধর্মের ভিত্তিতে মহামারীকে কেন্দ্র করে একে অপরকে দোষারোপের লড়াই। সামাজিক অবক্ষয়ের এক বীভৎস রূপ দেখেছি করোনা-মহামারীকে কেন্দ্র করে। 

কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে শুনলে তাকে সমাজচ্যুত করার এক বীভৎস লড়াইয়ে মেতে উঠেছে সমাজ। ব্যক্তিজীবনে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব কোনও অংশে কম ভয়াবহ নয়। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএফপিএ এবং এভেনার হেলথ, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, ও অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশে গত তিন মাসের লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা ২০ শতাংশ বেড়েছে। এই প্রতিবেদন থেকেই বোঝা যায়, করোনাভাইরাস মহামারীতে মানুষের ব্যক্তিজীবনও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

করোনা-পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত বিপর্যয় নেমে আসতে পারে তার একটি হল অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডি হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় যে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা আমেরিকায় ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা পরবর্তী বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর অর্থবাজারে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল- তার চেয়েও অনেক সুদূরপ্রসারী। 

সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্য সংকট, কাজহীনতা করোনাভাইরাসের পরের সময়ের বিশ্বকে নিয়ে যাবে নতুন এক সংঘাতময় বাস্তবতায়। 

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা 'ডব্লিউএফপি'-র প্রধান ডেভিড বসেলে বলেছেন, "করোনা সংকটের কারণে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ধেয়ে আসছে তা খুবই ভয়াবহ। জাতিসংঘ বিশ্বের গরীব জনগোষ্ঠির মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে, কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। এসব গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ব-ব্যবস্থার আওতায় একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতিসঙ্ঘ তহবিল গঠন করা না হলে এ ভয়াবহ পরিণতি মেনে নিতে হবে বিশ্ববাসীকে।"

এখানে উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন দেশের আর্থিক সহায়তায় বিশ্বের অন্তত ১০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয় ডব্লিউএফপি। এর মধ্যে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ খাবার না পেলে অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

তবে এত সমস্যার মধ্যেও নতুন আরেকটি সমস্যা বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। সেই সমস্যাটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ। 

এই তো সপ্তাহ খানেক আগেই জঙ্গিগোষ্ঠি বোকো হারাম ও তাদের শাখা ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) নাইজেরিয়ার উত্তরপূর্বাঞ্চলের একটি গ্রামে হামলা চালিয়ে অন্তত ৬৯ জনকে হত্যা করে। 

মহামারী চলাকালীন এবং করোনাভাইরাসের পরের সময়ে যে কয়টি প্রধানতম সমস্যা বিশ্ববাসীকে মোকাবেলা করতে হবে সেই সমস্যাগুলকে জঙ্গিগোষ্ঠি তাদের নিজেদের স্বার্থে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়ার আশংকা থেকেই যাচ্ছে। করোনাকালীন জাতীয়তার ভিত্তিতে বা ধর্মের ভিত্তিতে যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে, যেভাবে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে-  তা সত্যিই ভয়াবহ। যার সুযোগ নিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠি খুব সহজেই জঙ্গিবাদকে উস্কে দিতে পারে। সম্প্রতি এমন নজির লক্ষ্য করা গেছে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিগোষ্ঠিগুলোর কর্মকাণ্ডে। 

আল-কায়েদা বলেছে, অমুসলিমরা তাদের এই কোয়ারেন্টিনের সময়টাতে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে৷ ইসলামিক স্টেট অবশ্য কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে৷ অনুসারীদের কোনেও অনুকম্পা না দেখিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছে তারা৷

মহামারী শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯ কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনাভাইরাস নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। 

সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে। 

সেখানে বলা হয়, "করোনাভাইরাস গোটা দুনিয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন, যন্ত্রণাদায়ক ছায়া ফেললেও মুসলিম বিশ্বে ভাইরাসটি প্রবেশ করার কারণ হল মুসলিম দেশগুলোতে পাপ, অশ্লীলতা ও নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে গেছে।" 

তারা বলছে, "সঠিক ধর্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানাতে এবং দমন ও দমনকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করোনা সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।"

জার্মান সাংবাদিক জুয়াদ মেখ্কেনেট দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন। 'Far-right and radical Islamist groups are exploiting coronavirus turmoil'- শিরোনামের বিশ্লেষণধর্মী সেই লেখায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ভাইরাস সম্পর্কে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ানো শুরু করেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তার এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার বোকো হারামের এক অডিও বার্তায়। যেখানে দাবি করা হয়, বোকো হারাম যে নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটাই হলো অ্যান্টিভাইরাস। সেই অডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়াকে 'ইসলামের ওপর আঘাত' বলে উল্লেখ করেছে বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেকাউ।

শুধু জঙ্গি কর্মকাণ্ড নয় কোন কোন বিশেষজ্ঞ মহামারী ছড়াতেও জঙ্গিগোষ্ঠির আশংকার কথা উল্লেখ করেছেন। 

এ বিষয়ে নিরাপত্তা গবেষক লায়েথ আলখৌরি বার্তাসংস্থা এপি-কে বলেন, "এমনকি কোনো কোনো গোষ্ঠী 'ভাইরাসের হাত থেকে কেবল ধর্ম মানুষকে বাঁচাতে পারে' এমন তত্ত্ব দিয়ে সব বৈজ্ঞানিক সমাধান এড়িয়ে চলার কথা বলে বরং মহামারী ছড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে৷"

একথা পরিষ্কার যে মহামারীতে বিশ্বজুড়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। তাই করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে যেসব সমস্যা তথা অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাব ঘিরে যে কঠিন সময় অতিক্রম করতে হবে বিশ্বকে সেই সময়েও পরিপূর্ণভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে এই জঙ্গিগোষ্ঠি। 

মানুষ অর্থনৈতিক মন্দা বা খাদ্য সংকটকে কিছুটা হতাশায় নিমজ্জিত হবে । সেই হতাশাকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘৃণায় রূপান্তরের সর্বোচ্চ চেষ্টা ও প্রস্তুতি নিচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠিগুলো। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণাই মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে আগ্রহী করে তোলে। 

মহামারীতে জঙ্গিগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসজাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমন সতর্ক বার্তা দিয়ে আন্তোনিও গুতেরেস  বলেন, "করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে সুযোগ নিয়ে বড় রকমের হামলা চালাতে পারে জঙ্গিরা।" 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মত উদ্বিগ্নতা জানায় ব্রাসেলসভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, "একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়, কোভিড-১৯ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা ও আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে সহযোগিতার জায়গাগুলোকে দুর্বল করে দেবে৷ এতে এই জঙ্গিরা তাদের অভূতপূর্ব হামলার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে।"

এ কথা অনস্বীকার্য যে কোভিড-১৯ মহামারীতে জঙ্গিগোষ্ঠি যেমনভাবে সক্রিয় মহামারীর পরেও তারা ঠিক তেমনভাবেই সক্রিয় থাকবে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তাই বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এ মহামারী এবং মহামারীর পরের সময়ে শিথিলতার কোনও সুযোগ নেই। বরং তাদেরকে আরও কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে যাতে বাংলাদেশ জঙ্গিগোষ্ঠি বিন্দুমাত্র সুযোগ নিতে না পারে।