দেশের বেকার জনগোষ্ঠীকে ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং-এ নিয়োজিত করার মাধ্যমে সম্ভব দেশের অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন

আমিনুল ইসলাম সজীব
Published : 13 Dec 2012, 11:03 AM
Updated : 13 Dec 2012, 11:03 AM

ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং-এ বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে এক ধরণের বিপ্লবে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং-এ অংশগ্রহণের যেই অদম্য ঝোঁক লক্ষ্য করা যায় তা নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ও ভবিষ্যতেও রাখবে। গত কয়েক বছরেই বাংলাদেশে কেবল ফ্রিল্যান্সাররা আয় করেছেন ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আরও নতুনদের ফ্রিল্যান্সিং-এ অংশগ্রহণের ফলে এই অঙ্ক প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

আপনি অবাক হতে পারেন, কীভাবে এই বিপ্লব ঘটে গেল? গত বছরগুলোতে তো বাংলাদেশ সরকার এ দেশের মানুষকে ফ্রিল্যান্সিং-এ উদ্বুদ্ধ করেনি। বরং ফ্রিল্যান্সিং কাজে অংশ নেয়া ও অর্থ প্রাপ্তি ছিল বেশ ঝামেলার কাজ। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ না থাকলে অনেকটা চুপিসারেই এ দেশের তরুণ ও বেকারদের মধ্যে এই ফ্রিল্যান্সিং বিপ্লব গড়ে উঠেছে। আর সরকারের গত কয়েক বছরের সব কিছুর পেছনে "ই" জুড়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় এই ফ্রিল্যান্সিং পেয়েছে ব্যাপক সমৃদ্ধি।

কিন্তু কেন এমনটা ঘটেছে? আমরা যদি খুলনার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো সেখানকার অনেক শিল্পই বন্ধ হয়ে গেছে দুর্নীতি ও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ার কারণে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা খুব একটা ভালো নেই। আর তরুণ প্রজন্ম নিজেদের উন্নতির জন্য পড়াশোনার দিকে বেশি জোর দিয়েছে। কিন্তু পড়াশোনা শেষে বা এ সময়ে চাকরির বাজারের বেহাল দশা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন প্রজন্মকে প্রয়োজনমতো চাকরি দিতে পারছে না। আর এই প্রজন্মের তরুণদেরও খুলনা না ছেড়েই কিছু একটা করার প্রচেষ্টা ছিল। সেভাবেই ধীরে ধীরে ফ্রিল্যান্সিং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

তবে ফ্রিল্যান্সিং-এর ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেলেও এখনও এই খাতে লেগে থাকা মানুষের দুর্দশা কমেনি। তারা এখনও অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে একটি রয়েছে পেপাল পেমেন্ট গেটওয়ে সুবিধা। ফ্রিল্যান্সার ও আউটসোর্সিং পার্টনারদের যাবতীয় সুবিধাদি দেয়া গেলে দেশে এই খাত আরও অনেকখানি এগিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার কখনোই এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেনি। এসইএ-এমই-ডব্লিউই ফাইবার অপটিক ক্যাবল কানেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে দু'বার পিছিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের তথ্য বিদেশে পাচার হয়ে যাবে এমন অদ্ভূত যুক্তিতে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়নি তখন।

বর্তমানে বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তির খাতে অনেক এগিয়ে আছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সত্যিকারের অনলাইন সুবিধাদি এখনও এ দেশে পুরোপুরি চালু হয়নি। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায়ও আমরা অনেকখানি পিছিয়ে আছি।

ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং এমন একটি শিল্প যেখানে আয় হচ্ছে অবিশ্বাস্য ৩.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ এর ১ শতাংশও নিতে পারছে না। যদিও ঢাকা আউটসোর্সিং শহরগুলোর মধ্যে শীর্ষের দিকে আছে, তবুও সার্বিক বিবেচনায় অতোটা এগিয়ে নেই বাংলাদেশ। আজ আমাদের দেশে ফ্রিল্যান্সিং-এর যেই অবস্থা, ভারতে ১০ বছর আগে সেই অবস্থা ছিল। অর্থাৎ, আমরা ভারতের তুলনায় এখনও এক দশক পিছিয়ে আছি।

তবে তার মানে এই নয় যে, সবসময়ই ভারতের তুলনায় আমাদের এগিয়ে থাকতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ মানুষ রয়েছেন যারা এই দেশকে ভারতের সমপর্যায় কেন, ভারতকে ছাড়িয়ে আরও বেশি অগ্রসর করে নিতে পারবে। কিন্তু এ জন্য তাদের প্রয়োজন সুযোগের। যদি আমরা তাদের সুযোগ করে দিতে পারলেই তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। আর এই সুযোগ আসতে হবে সরকার ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। যদি আমরা সেই সুযোগ তৈরি করতে না পারি, তাহলে ভিয়েতনাম বা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো এই খাতে রাজত্ব করেই যাবে। আর যদি আমরা সুযোগ তৈরি করতে পারি, যদি আমরা এই আউটসোর্সিং শিল্পের মাত্র ১ শতাংশও পেতে সক্ষম হই, তাহলে হয়তো পোশাক শিল্প বা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের চেয়েও ছাড়িয়ে যাবে আউটসোর্সিং খাতে এ দেশের আয়ের অঙ্ক।

আপনি যদি আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন অনেক পরিবর্তন সাধিত হওয়ার পরও আমরা খুব একটা স্বাধীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ এখনও অনেক রক্ষণশীল। চলাচলের ক্ষেত্রে বাসে এখনও নারী-পুরুষ বিভেদে বসার ব্যবস্থা রয়ে গেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা এখনও সমাজে অবাধে চলাফেরা করতে পারেন না বললেই চলে। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও নারীরাই 'বাদ' পড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে। আর যারা কোনোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে বেশিরভাগের ক্যারিয়ারেরই ইতি ঘটে তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরপরই। ক্যারিয়ারের এই ইতিকে কেউ ভালো বা খারাপ বলে আখ্যায়িত করতে পারবেন না। কেননা, নারীর দ্বারা সন্তান বড় করে তোলা বহু শতাব্দীর পুরনো ঐতিহ্য। এমনকি উন্নত দেশেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত নারীরা সন্তান লালন-পালনের স্বার্থে ঘরেই থাকেন। সব মিলিয়ে দেখা যায়, একটি পর্যায়ে গিয়ে নারীর সব মনোযোগ ঘরেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

অথচ আমাদের দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশই নারী। আপনি যদি এই বিপুল শতাংশ জনশক্তিকে আয়ের জন্য কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে দেশের সার্বিক উন্নতিও অনেকখানিই পিছিয়ে যাবে। আর আমাদের সমাজব্যবস্থা অনুযায়ী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারীকে ঘরে রেখেই অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়ার বোধহয় একটিই উপায় আছে। আশা করি আপনারা সবাই জানেন কী সেই উপায়।

আবার, আমাদের দেশে বয়স্করাও একটা সময় পর তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবে কাজের চাপ নিতে না পারায় বা বয়সসীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাবার ফলে তারা কেবল অন্যের উপর নির্ভরশীলই হয়ে পড়েন না, একই সঙ্গে দেশের অর্থ উপার্জনে লিপ্ত জনগণের মধ্য থেকে বাদ পড়ে যান যেখানে তারা আর কখনোই ফিরে আসেন না। আমরা কীভাবে সেসব বয়স্ক মানুষদের কোনো শারীরিক পরিশ্রমের চাপ না দিয়ে আবারও স্বনির্ভরশীল ও অর্থ উপার্জনে সক্ষম করে তুলতে পারি? আশা করি আপনি এই প্রশ্নের জবাবও জানেন।

অন্যদিকে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আমরা প্রায়ই ভাবি, আমাদের জনসংখ্যার সবচেয়ে দুর্বলতম অংশ হচ্ছে এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিৎ, সব প্রতিবন্ধী মানুষই কিন্তু সবদিক দিয়ে প্রতিবন্ধী নন। আমি এমনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার মানুষ দেখেছি যাদের রয়েছে অবিশ্বাস্য প্রতিভা, জ্ঞান এবং দক্ষতা। কিন্তু তারা অন্যদের মতো সাধারণ কর্মস্থলে চাকরি করতে পারেন না কেবল তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। এই চিত্র বদলানোরও যেন কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমরা কিন্তু তাদেরও দেশের অর্থোপার্জনে লিপ্ত জনগোষ্ঠীর আওতায় নিয়ে আসতে পারি। আর সেটাও কীভাবে সম্ভব তা আপনি ভাবতেই পারছেন।

আমরা সাধারণত ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং নিয়ে কথা বলার সময় তরুণ প্রজন্মকেই বুঝিয়ে থাকি। হ্যাঁ, তারাই আমাদের দেশের ভবিষ্যত। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং-এর কাজে যদি বেকার জনগোষ্ঠীর সবটুকুকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে আমাদের দেশের অর্থনীতি কোথায় যেতে পারে তা ভেবে দেখুন।

কাজেই, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করতে হলে সরকারকে অবশ্যই এই শিল্পকে যত দ্রুত সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব সে লক্ষে কাজ করতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, এই খাতে অর্থ দেশে আনায় এখনও অনেক বড় বাধা রয়েছে। পেয়জা সাম্প্রতিক সময়ে চালু হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মাধ্যম পেপাল আসবো আসবো করেও দেশে এখনও আসেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও খুব একটা সক্রিয় ভূমিকা রাখছে না। তবে ইদানীং সবকিছু বেশ দ্রুত এগোচ্ছে তাই এই আশা করা যায় যে শিগগিরই আমরা পেপালসহ যাবতীয় সুবিধাদি উপভোগ করতে পারবো। হ্যাঁ, দেশে এখনও দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষ রয়েছেন, মানি লন্ডারিং-এ লিপ্ত মানুষ রয়েছেন, কিন্তু তাদের জন্য পুরো জাতির সামনে পরে থাকা সুযোগ অপেক্ষা করতে পারে না।

গত ৮-১১ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২। এই আয়োজনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল "নলেজ টু প্রসপারিটি" বা সমৃদ্ধির লক্ষ্যে জ্ঞান। গত কয়েক মাসে আমরা ডুল্যান্সার নামক কিছু প্রতারক চক্রের কার্যক্রম লক্ষ্য করেছি। প্রতারিত হওয়ার পর বা অন্যকে প্রতারিত হতে দেখে অনেকেই এই শিক্ষা নিশ্চয়ই পেয়েছেন যে, তথ্য-প্রযুক্তি বা ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং খাতে জ্ঞান ছাড়া সেই সমৃদ্ধি বা সফলতা পাওয়া যায় না। আর সে জন্যই আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের স্লোগান ছিল যথার্থ।

এবারের আয়োজনে প্রতিবারের মতো কেবল তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি এই পরিধিকে আরেকটু বড় করি, তাহলে আমাদের প্রত্যাশা ও সম্ভাবনাও হয়ে ওঠে আরও বিস্তর।

মূল লেখাঃ আসিফ আনোয়ার, বাংলাদেশ ইন্টারনেট মার্কেটিং কনসালটেন্ট।
অনুবাদঃ মোঃ আমিনুল ইসলাম সজীব, প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক, অ্যান্ড্রয়েড কথন