দেশত্যাগী হিন্দু, তসলিমা নাসরীন ও উদার রাষ্ট্রের কথা

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 4 May 2011, 03:59 PM
Updated : 3 March 2014, 11:59 AM

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ সংক্রান্ত পরিস্থিতির উন্নয়নে কতটা কী করতে পারছে, তা নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রশ্ন থাকলেও এর চেয়ারম্যান মাঝে মধ্যে এমন কিছু বক্তব্য রাখেন, যা মনোযোগ আকর্ষণ করে। খোদ মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত একটি নারী বিষয়ক সেমিনারে কমিশন চেয়ারম্যান দেশে হিন্দু নির্যাতন ও তাদের দেশত্যাগ নিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, ''এই মানুষগুলো যদি চলে যায় তাহলে কীসের অর্জন, কীসের প্রত্যাশা, কীসের বাংলাদেশ? সংখ্যালঘুদের যদি দেশ ছাড়তে হয়, তাহলে যে বাংলাদেশ থাকে সেটা একাত্তরের বাংলাদেশ নয়, সেটা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নয়, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়।''

তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই বোধহয় এসেছে সংবাদপত্রে। সেখান থেকে শুধু তুলে দিলাম। তার বক্তব্যে হয়তো একটু পুনরুক্তি আছে, কিন্তু সিরিয়াসনেসের ঘাটতি নেই। শুধু কথা বলে যাওয়াকে অনেকে খারাপভাবে দেখেন অবশ্য। তারা কাজ দেখতে চান। কিন্তু কাজের কথাই বা ক'জন বলেন? সত্য উচ্চারণ করেন?

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ওই সেমিনারে আরেকটি প্রায় অনালোচিত বিষয় সামনে আনেন। তিনি ওখানে উপস্থিত নারীদের উদ্দেশে বলেন, 'তসলিমা নাসরীন বলেছেন, বাংলাদেশের নারী এখনও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। সেই তসলিমা নাসরীনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আপনার কী করেছেন বলুন? তিনি কী অপরাধ করেছেন যে মাতৃভূমিকে পদচারণ করতে পারেন না?'

এর উত্তর ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাদের মতো করে দেবেন। উদারমনা, আধুনিক ও প্রগতিবাদীরা দেবেন কীভাবে? সত্যিই তো, তারা কী করেছেন তসলিমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে? এদেশে ভয়ানক ফৌজদারি অপরাধ করে, পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি করেও আইনের কথিত লম্বা হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায় অনেকে। তসলিমা তার আগ্রহের কিছু বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন কেবল। হয়তো সেটি করেছেন তীর্যকভাবে। তা অপরাধ হয়ে থাকলে এর বিচার হতে পারত। কিন্তু মৌলবাদীদের অব্যাহত হুমকির মুখে দেশেই থাকতে পারলেন না তিনি।

তসলিমা নাসরীনকে নাকি বিদেশ চলে যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ খোদ সরকারের তরফ থেকে। এদেশে গোলাম আযমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধী ফিরে এসেছেন, নাগরিকত্বও ফিরে পেয়েছেন। সে সুবাদে অবশ্য তার বিচার অনুষ্ঠান সম্ভবপর হয়েছে। এদিকে তসলিমা নাসরীন দেশেই ফিরতে পারছেন না। তার 'অপরাধ' গোলাম আযমের চেয়েও মারাত্মক বুঝি!

এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন নিয়েও লেখালেখি করেছিলেন তসলিমা। তার ধরন ও মাত্রা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; কিন্তু নির্যাতনের বিষয়টি কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? তার লেখাকে অনেকে 'উদ্দেশ্যমূলক' বলে অভিহিত করেন। (করলেও) তসলিমা কি একা সেটি করেন? আর কেউ করেন না?

উদ্দেশ্যমূলক লেখায়ও সারবস্তু থাকে। সেটি কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। একজন মানুষ কোন উদ্দেশ্যে কী লিখছেন, তা নির্ণয় করা কঠিনও। সহজ হল, তিনি যা লিখছেন বা বলছেন, তার মূল্যায়ন করা। তসলিমা নাসরীনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কাজটি মনে হয় অবহেলিতই থেকে গেছে।

যাহোক, মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ দেব তসলিমার দেশেই থাকতে না পারার বিষয়টি তিনি কিছুটা তীর্যকভাবে তুলে এনেছেন বলে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন বৈকি। দেশে তসলিমার নিরাপত্তা সমস্যা রয়েছে, এও সত্য। এদেশে অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, মানুষের আয় বাড়ছে, বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে; পাশাপাশি এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ছে। ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতকারীর নয়, নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ভিন্নমতাবলম্বীর। এটা বাড়ছে তারা সংখ্যালঘু বলেও।

কার্ল মার্কস বলে গেছেন, একটি সমাজ কতটা উন্নত, তা বোঝা যায় এর নারীর দিকে তাকালে। আর একটি সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক, তা বোঝা যাবে এর সংখ্যালঘুর দিকে দৃষ্টি দিলে। নানা ধরনের সংখ্যালঘু থাকে সমাজে। চিন্তার দিক দিয়ে সংখ্যালঘুরা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। এক অর্থে এদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

ড. আহমদ শরীফ কয়েক দফা হুমকির মুখে পড়েছিলেন তার মত প্রকাশের 'অপরাধে'। স্যার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতেন। হেঁটে এসে বসতেন এর গোল চত্বরে। আমরা মাঝে মধ্যে যেতাম তার সঙ্গে কথা বলতে। মৌলবাদীরা শরীফ স্যারের মাথার দাম ঘোষণার পর সাদা ক্যাডস পায়ে কিছুদিন তিনি আর আসেননি উদ্যানে। তখনও কিছুটা বুঝেছিলাম, দেশ কতটা গণতান্ত্রিক বা কেমন গণতান্ত্রিক দেশ বানাচ্ছি আমরা।

এর বেশ কিছুদিন পর ড. হুমায়ূন আজাদ তো আক্রান্তই হলেন একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও তাকে বাঁচানো গেল না। আজাদ স্যার একটি বই লিখেছিলেন, যার শিরোনাম: 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম'? আপন মনে, একাকি পথ চলা এ বুদ্ধিজীবী ছুরিকাহত হওয়ার পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বাঁধভাঙা মিছিল বেরিয়েছিল, যার ব্যানারে বড় করে লেখা ছিল ওই শিরোনামটি।

হুমায়ূন আজাদ মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর, ২০১৪-এর বাংলাদেশে এ প্রশ্নটি মনে হচ্ছে আরও প্রাসঙ্গিক।
সত্যিই তো, কোন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম আমরা? ভিন্ন বা নতুন একটি দেশই চেয়েছিলাম একাত্তরে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা বলেছিলাম– একটি চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ জয় করে কেমন দেশ অর্জন করতে চাইছি। ইতোপূর্বে এখানে লেখা এক নিবন্ধে বলেছিলাম, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনের কথা ছিল না। সেটি ছিল ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানের মূলনীতিতে।

এতে কোনো সমস্যা তো নেই। ঘোষণাপত্রে 'গণতান্ত্রিক' দেশ গঠনের কথা বলা হয়েছিল। সুনির্দিষ্টভাবেই ছিল 'ন্যায্যতা' প্রতিষ্ঠার কথা। গণতন্ত্র থাকলে ন্যায্যতা আপনাআপনি থাকে। গণতন্ত্র থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতাও থাকে। শুধু ধর্ম কেন, থাকে বর্ণনিরপেক্ষতা। তাই থাকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতকরণ ও তা রক্ষার প্রশ্ন।

গণতন্ত্র সংখ্যাগুরুর শাসন বটে, তবে সেটি সংখ্যালঘুকে ধারণ করেই; তাকে বাদ দিয়ে, প্রান্তিক বানিয়ে কিংবা তার অধিকার খর্ব করে নয়। এখানেই আসে 'ন্যায্যতা' বা সমানাধিকারের প্রশ্ন। নির্বাচনে যে পরাস্ত হল কিংবা সংখ্যায় ক্ষুদ্র, গণতান্ত্রিক দেশে তার অধিকারও সমান। যে বিজয়ী বা বৃহৎ, তার অধিকার তো আপনাআপনিই রক্ষিত। অধিকার রক্ষার প্রশ্ন তাই সংখ্যালঘুর। গণতন্ত্রের একটা ভালো অর্থ তাই সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করা। দেশটিতে সংখ্যালঘু কেমন আছে, সেটি খতিয়ে দেখা তাই জরুরি।

আমাদের মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান এদিকে দৃষ্টি দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন দেখে তাই ভালো লাগল। এতে কোনো কাজ হবে না জানি, তবু তো একজন ওই রকম অবস্থান থেকে বললেন কথাটা। প্রশ্ন উত্থাপন করাই নাকি অনেক সময় জরুরি। কে জানে, এখন হয়তো তেমন সময়ই এসে উপস্থিত হয়েছে!

কোন প্রেক্ষাপটে দেশে কেমন নির্বাচন হয়েছে গত ৫ জানুয়ারি, তা সবাই জানি। এটি নিয়ে আমরা কেউ গর্বিত নই। এর ভিত্তিতে গঠিত সরকার কতটা নৈতিক জোর দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে, সে প্রশ্ন তার সমর্থকদের মধ্যেও আছে। এর একটা নিষ্পত্তিও হয়তো ঘটবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে মাঝে মধ্যে তার চিন্তার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সরকারের বিরোধী পক্ষ তো নতুন করে আন্দোলনে যাওয়ার কথাও বলছে, বিশেষত চলমান উপজেলা নির্বাচনে ভালো করার পর। কিন্তু এর মধ্যে পড়ে দিনাজপুর, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে নির্যাতনের শিকার হতে হল, তাদের কী হবে? আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালেও তাদের ওপর যা ঘটল, এতে দেশে শান্তি-স্বস্তিতে থাকার বিষয়ে তাদের অনাস্থা কি আরও গাঢ় হয়নি?

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান যে দুটি স্থানে সংঘটিত হামলা-নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলেছেন, তার একটিতে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন একই পরিবারের একাধিক নারী। ঠিক জানি না, পরিবারটি এর মধ্যে দেশত্যাগ করেছে কিনা। তবে এ ধরনের ঘটনার পর, বিশেষত দ্রুত ও কঠোর বিচার না হলে দেশত্যাগই হয়ে ওঠে অনিবার্য।

হিন্দু ও শিখ জনগোষ্ঠীর অব্যাহত দেশত্যাগের মুখে পাকিস্তানে তারা এখন 'নেই' হয়ে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশ তেমনটি হবে না বলেই আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম একাত্তরে। 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালি' বলে গান বেঁধেছিলাম। চার রকম উপাসনালয়ের ছবি দিয়ে সুন্দর পোস্টার বানিয়েছিলাম। সেটি বোধহয় গানে আর পোস্টারেই রয়ে গেছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তো বিবেচনাতেই আসেনি। নানা ধর্মের মানুষ নিয়ে যে 'বাঙালি' সমাজ, সেটিও গড়ে তোলা যায়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর আধিপত্য আর শাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার দাপটে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর অবস্থা করুণ। তাদের জীবন, সম্পদ, অধিকার ও মর্যাদা এখানে কমবেশি টানা সঙ্কটে।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছেন, নির্যাতিত হিন্দুরা দেশত্যাগ করলে কীসের বাংলাদেশ! তিনি নিশ্চয়ই অবহিত; তা সত্ত্বেও আলোচনার খাতিরে বলি, সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশে। ২০০১-এর নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে যা ঘটেছিল, তাতে সরাসরি নির্যাতনের শিকার হয়নি এমন হিন্দু পরিবারেরও মন ভেঙে যায়। নানা দিক বিবেচনায় এদের অনেকে দেশত্যাগ করেন। সর্বশেষ জনগণনায় সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে।

গত এক দশকে ৯-১০ লাখ হিন্দু দেশত্যাগে বাধ্য বা 'মিসিং পপুলেশন' হয়েছেন বলে তথ্য দিচ্ছেন কেউ কেউ। এদের একাংশ যে সম্পন্ন মুসলমানের মতো উন্নত দেশগুলোয় চলে যায়নি, তা অবশ্য বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তারা ভারতকেও বেছে নিতে পারেন। কিন্তু এদের সংখ্যা কত? তাদের বিষয়ে তেমন কিছু বলারও নেই।

দুঃখ, পরিতাপ ও লজ্জা থাকল তাদের নিয়ে, যারা চোখের কোণে অশ্রু মুছতে মুছতে আর পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে দালালের হাত ধরে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন। জমিজমাও যারা বাজারমূল্যে বেচতে পারেননি। হয়তো বলেকয়েও যেতে পারেননি প্রতিবেশিকে।

আমরা তো জানি, এখন ভারতেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে না নিশ্চিন্ত কোনো জীবন– যদিও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা, দেশটির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন এদের সারা ভারতে 'পরিকল্পনামাফিক' আশ্রয় দেওয়ার কথা। তিনি এমনটি বলছেন বিশেষত নির্বাচন নিকটবর্তী বলে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে 'হিন্দু ভোট' চাই তার। এদেশে যেমন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও জোটের চাই 'মুসলিম ভোট'।

মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানকে বিনীতভাবে বলি, এর মধ্যে দেশত্যাগ তো অনেক ঘটে গেছে। কত বড় আঘাত পেলে, কতটা অসহায় বোধ করলে একজন মানুষ দেশত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তা বোঝা তাদের পক্ষে অসম্ভব যারা সংখ্যায় গুরু। এদের মধ্যে যারা ক্ষমতা মদমত্ত ও শক্তিতে দিশেহারা, তাদের জন্য বড় আনন্দের সময় এটা। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধের সংখ্যা সেভাবে না কমলেও দেশে 'বিধর্মী' হিন্দুর সংখ্যা কমছে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তথা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীও কমছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর তাদের অনেকে অবশ্য ফিরে এসেছেন দেশে, কিন্তু চুক্তিমতো আশ্রয় বা অধিকার ফিরে পাননি। এদের বাড়তি সমস্যা হলো, চেহারাতেই রয়েছে আলাদা ছাপ। সহজেই চিহ্নিত করা যায় তাদের, যায় বৈষম্যের শিকারে পরিণত করা।

এদের সবার দেশ হবে বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। নেতাদের 'উদ্দেশ্যহীনতার' কথা অবশ্য বলেন অনেকে। কিন্তু লক্ষ্যের প্রশ্নে ন্যূনতম ঐকমত্য তো ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি কি বাজারমুখী না মিশ্র না সমাজতান্ত্রিক হবে, তা নিয়ে হয়তো বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু এদেশের সমাজ যে উদার ও এর রাজনীতি যে গণতান্ত্রিক হবে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত ছিল কী?

মওলানা ভাসানীও কি ভিন্ন কোনো সমাজ বা দেশ কল্পনা করেছিলেন? মণি সিংহ বা মোজাফফর আহমেদ? কিন্তু বাস্তবে দেশটা সে ধারায় এগোয়নি। ক্ষমতাসীনদের চিন্তায় মুসলিম-প্রাধান্য ছিল পঁচাত্তরের আগেও। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও দেশ গঠনের জন্য দরকারি উপাদান তৈরির সযত্ন প্রয়াস লক্ষ করিনি তখনও। পঁচাত্তরের পর তো দেশ চলেছে বিপরীত ধারায়।

এদিকে হিন্দু ও আদিবাসীর জমিজমা দখলের সুযোগ যারা তেমন পায়নি, তারা রাজনৈতিকভাবে ওদের প্রতিপক্ষ হয়েছে বেশি করে। চেয়েছে দেশটাকে কেবল বাঙালি মুসলমানের বানাতে। একে পাকিস্তানি ধারায় প্রত্যাবর্তন বললে কী ভুল হবে? এটা নিশ্চিত করতেই কি দশকের পর দশক ঝুলিয়ে রাখা হয়নি অর্পিত সম্পত্তি আইন? সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সুযোগ পেয়েও রদ করা হল না রাষ্ট্রধর্ম?

একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কম জনসমর্থন নিয়ে এসবে হাত দেওয়া অবশ্য কঠিন। দল নির্বিশেষে দেশের সিংহভাগ মানুষকে তো এটা চাইতে হবে। তারা যাতে ওই রকম চায় বা অন্তত অনুমোদন করে, সে লক্ষ্যে আবার পরিচালনা করতে হবে রাজনৈতিক কার্যক্রম। এর কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

এদেশে মুসলমানের মধ্যে যারা অন্য রকম– চিন্তার দিক দিয়ে উদার ও আধুনিক– তারাও অসহায় বোধ করতে শুরু করেছেন। এমন একটি দেশে তারা স্বভাবতই স্বস্তিবোধ করবেন না, যেখানে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের নির্যাতিত হতে হয়। উদারমনা মুসলমানরা দেখতে পেলেন, বৌদ্ধ বসতি ও উপাসনালয়েও আঘাত হানা হলো প্রতিবেশি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অজুহাতে। এ ক্ষেত্রে আবার প্রতিষ্ঠিত হল 'জাতীয় ঐক্য' অর্থাৎ সব পক্ষের লোকজনই অংশ নিল হামলায়। এর তদন্তও কি ঠিকমতো হচ্ছে?

উদারমনা মুসলমানরা জানেন, এরপর তাদের টার্গেট করা হবে। বলা হবে, 'আমাদের মতো মুসলমান হও। নইলে তোমরাও দেশত্যাগ করো'! কিছুদিন আগে খবরে দেখেছিলাম, যশোরের এক গ্রামে বাউল গানের আসরে হামলা চালিয়ে তাদের একজনকে ওখানেই মেরে ফেলেছে এলাকাবাসী। হামলাকারীরা কিন্তু আগেকার মতো অন্যখান থেকে ভাড়া করে আনা লোক বা 'বিহারি গুণ্ডা' নয়।

সমাজ ও রাজনীতির গভীরে একটা পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পরিবর্তন একটা আকার নিয়েছে বলেও মনে হয় কোনো কোনো ঘটনায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের বক্তব্যেও তার ইঙ্গিত পাচ্ছি। ভালো কিছু দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ তার কণ্ঠে স্পষ্ট। বক্তব্য শুনে মনে হল, পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়া বিপরীতমুখী করার কোনো রাজনৈতিক প্রয়াস তার নজরেও পড়ছে না। থাকলে তো পড়বে!

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।