কাবাব যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিক

আশরাফুজ্জামান আশরাফ
Published : 26 Nov 2012, 10:19 AM
Updated : 26 Nov 2012, 10:19 AM

আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন জ্বলছে উত্তরার দক্ষিণখানের সোয়ান গার্মেন্ট, ম্যককয়া সোয়েটারর্স এবং সার ডেনিমে, জানিনা সেখানে কত জন জীবন্ত পুড়ে কাবাব হবে। দক্ষিণখানে জ্বলছে আমার কিছু সহকর্মী আর অন্যখানে ১১১ জন সহকর্মীর কাবাব সৎকার করা হচ্ছে। যারা ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনে শনি বারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে কাবাব হয়েছে।

আমিও জীবন্ত পুড়ে কাবাব হওয়ার মুখোমুখি হয়েছিলাম দুইবার। আমি তখন নারায়ণগঞ্জের এক পোশাক কারখানায় আবাসিক থাকতাম। রাত বারোটার পর যখন আমরা গভীর ঘুমে ঠিক সেই সময় আগুন লেগে যায় আমাদের বিল্ডিং-এর নিচের তলায়। আমার সহকর্মীরা অসাধারণ দক্ষতায় আগুন নেভাতে সক্ষম হয়, এবং আমারা কাবাব না হয়ে জীবন্ত নীচে নেমে আসি। ঘটনাটি রাতে হওয়ায় ও কারখানা বন্ধ থাকায় হইহুল্লোর হয়নি ও পদদলীত হয়ে কেউ মারা যায় নি। দ্বিতীয় ঘটনা, একদিন লাঞ্চের সময় আমার রুমে খাবার খাচ্ছিলাম এমন সময় অগ্নি সংকেত বেজে ওঠে আমরা নিচে নেমে আসি এবং আমারা আগুন নেভাতে সক্ষম হই। এবার ছোটাছুটি করতে কয়েকজন আহত হয়।

বাতাসে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের পোড়া মাংসের গন্ধ। যারা কাবাব হয়ে গেছে অধিকাংশ আমাদের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার। যাদের আত্মীয়-স্বজনদের কান্নায় ভারী হচ্ছে মিঠাপুকুরের বাতাস। রেহানা, বিউটি, সুমন, মিতু, মালা, ফারুক, সাদ্দাম, দুলালি, মৌসুমী, শাহ আলম, সুমাইয়া, বুলবুলি, শিউলিদের আমরা আর কত হারাবো? যারা বাড়ীতে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাতেনাপেরে শুধু জীবন বাঁচার তাগিদে পাড়ি জমায় পোশাক কারখানায়, কাজ করে অত্যন্ত দুবেলা খাবার পাওয়া যাবে এই আসায়, তারা আজ উলটো পোশাক কারখানার খাবারে পরিনত হয়েছে। আসলে আমার এই সহকর্মীদের পোশাক কারখানা খাচ্ছেনা খাচ্ছে মানুষরুপি কিছু হায়ানা। আমার সহকর্মীরা প্রতিনিয়ত এই হায়ানাদের দ্বারা অত্যাচারিত হয় এবং এই হায়ানাদের কারণে কারখানাগুলোর দরজা বন্ধ থাকে। তাজরিন ফ্যাশনসে আগুন লাগার সময় কলাপসিবল গেইটে তালা দেওয়া ছিল। শুধু তাজরিন ফ্যাশন নয় আমাদের দেশের অধিকাংশ পোশাক কারখানায় কাজ চলা অবস্থায় শুধু একটি মাত্র গেইট খোলা রেখে বাকী গেইটগুলো বন্ধ করে দেয়। তাজরিন ফ্যাশনসের শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন আগুন লাগার সময় কলাপসিবল গেইটে তালা দেওয়া ছিল যার দরুন হতাহতের সংখ্যা এত বেশি হয়েছে। মেইন গেটের পাশাপাশি টয়লেটের দরজাগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়, এমন অনেক কারখানা আছে যেখানে টয়লেট কার্ড পর্যন্ত ইস্যু করা হয়।

আমাদের পোশাক কারখানা গুলোতে পর্যপ্ত পরিমাণ অগ্নি মহড়া দেয়া হয় না। অগ্নি মহড়ায় প্রায় ২০ মিনিটের মতো সময় নষ্ট হয়, এই ২০ প্রডাকশন হয়না বিধায় কারখানা কর্তৃপক্ষ অগ্নি মহড়ার আয়োজন করে না। এই হায়াদের কাছে হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনের চেয়ে ২০ মিনিটের মূ্ল্য অনেক বেশি।

যখন ফায়ার এলার্ম বেজে উঠে সে সময় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেয়া হয় এ সময় জরুরি বাতি জ্বলে ওঠে, কিন্তু অনেক কারখানায় পর্যাপ্ত পরিমাণ জরুরি বাতি নেই থাকলেও সেগুলো আর জ্বলে না। সাধারণত কাপড়ের আগুন দ্রুত ছড়ায় না, কিন্তু অন্ধকার ঘরে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে আগুন আসার আগেই অনেকে পদদলিত হয়ে মারা যায়। আর শ্রমিকদের চলাচলের পথগুলো খুবই সংকির্ণ, যে পথ দিয়ে এক জনের বেশি চলাচল করা যায় না।

এ ঘটনা তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এই তদন্ত প্রতিবেদন শুধু কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এর বেশি আশা করিনা। কারণ রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে তো জিম্মি। নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিজিএমইএ, এই টাকা খুবই সামান্য আর টাকা কখনও জীবনের বিকল্প হতে পারে না।
আসুন আমরা সবাই হতভাগা ও হতভাগীদের জন্য দোয়া করি, "এই ইহজীবনের সীমাহীন কষ্টের পরিবর্তে আল্লাহ যেন তাদের বেহেস্ত নছিব করে। এবং আমাদের গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের মনে শ্রমিকদের কষ্টটুকু বোঝার তৌফিক দান করে। আমিন"।