নতুন সৌদি যুবরাজ ও সম্ভাব্য সংস্কার

বিজন সরকার
Published : 13 Nov 2011, 05:45 AM
Updated : 19 July 2017, 04:51 AM

সৌদি আরবের ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেল। পরিবর্তনগুলি কেবল দেশটির জন্য নয়, বিশ্ব রাজনীতির জন্যও চিন্তার বিষয়।

গত জুন মাসের ২০ তারিখে সৌদি প্রশাসন একটি রাজকীয় ডিক্রি জারি করে। জারিকৃত ডিক্রির দ্বারা ৫৭ বছরের অভিজ্ঞ ক্রাউন প্রিন্স ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আবু বিন তারিফকে সব ধরনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হল তাঁর 'ক্রাউন প্রিন্স' উপাধিও। নিয়ম ও প্রথা অনুযায়ী আবু বিন তারিফ সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ মোহাম্মদ সালমানের উত্তরাধিকার হওয়ার কথা ছিল।

সৌদির রাজপরিবারের ক্ষমতার ইতিহাসের সব প্রথা ভেঙে সৌদি বাদশাহ মোহাম্মদ সালমান তাঁর পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে 'ক্রাউন প্রিন্স' তথা যুবরাজ করলেন। তাঁকে উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও দেওয়া হল। একইসঙ্গে বর্তমান প্রতিরক্ষার দায়িত্বেও তাঁকে বহাল রাখা হল।

মোহাম্মাদ বিন সালমানের বয়স ৩১। অথচ দেশটির রাজতন্ত্রের দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকেই সৌদির শাসন ক্ষমতায় আসার মূল যোগ্যতা হিসেবে বয়স বিবেচিত হয়ে আসছে। সেই প্রচলিত প্রথা ও নিয়ম অনুসারে প্রিন্স মোহাম্মাদ আবু বিন তারিফেরই ভবিষ্যতে দেশটির বাদশাহ হওয়ার কথা।

ডিক্রিতে কিছু বিষয় পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কেবল সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ ফয়সালের ছেলে ও নাতিরা দেশটির ভবিষ্যৎ বাদশাহ হতে পারবে এমন একটি সিদ্ধান্ত ডিক্রির মাধ্যমে দেশের জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সিদ্বান্তগুলি নেওয়া হয় আনুগত্য কাউন্সিলের সভা থেকে। ৩৪ জন সদস্যের মধ্যে ৩১ জন আনুগত্য কাউন্সিলের সদস্য ডিক্রির পক্ষে মত দেন। উল্লেখ্য যে, কয়েকজন ধর্মীয় নেতা ছাড়া আনুগত্য কাউন্সিলের সবাই সৌদির রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্য।

এমতাবস্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে প্রথা ও রীতিবহির্ভূত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেসব ডিক্রি জারি করা হয়েছে, তাতে দেশটির রাজতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ কাঠামো কতটুকু প্রভাবিত হয়, সেই প্রশ্নটি কেবল মধ্যপ্রাচ্য হয়, সারা বিশ্বের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নটি সরাসরি বিবেচনায় নেওয়া যাক। প্রশ্নটি হল, ক্ষমতার রাজনীতির নব্য পরিবর্তন সৌদি আরবের পরিবারকে কীভাবে ও কতটুকু প্রভাবিত করবে?

প্রশ্নটির উত্তর দুটি স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রেক্ষাপট দুটি পারস্পারিক নির্ভরশীল ও আন্তসম্পর্কীয়। প্রথম প্রেক্ষাপটটি হল দেশটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার রহস্যজনক কাঠামো ও সমাজের উপর সেই কাঠামোর প্রভাব। দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটটি বিশ্ব রাজনীতি।

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটটি তিনটি মৌলিক কারণে সৌদি আরবের ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বর্তমানে সৌদি আরব ইয়েমেনের সঙ্গে একটি অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত এবং সেই যুদ্ধের ব্যয়ের অর্থনীতি সৌদির শাসকগোষ্ঠীর জন্য এখন বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় জঙ্গিবাদের ইস্যুতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তৃতীয়ত, সৌদি আরব দেশটির মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটি অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই তিনটি ঘটনার পিছনে যিনি কারিগর তিনি হলেন সদ্য পদোন্নতি পাওয়া ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান।

যাহোক, প্রথমেই আমরা সৌদি আরবের শাসনক্ষমতা কেন্দ্রিক পরিবর্তনের যে আয়োজন সেটি দেশটির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিশ্লেষণ করি।

কমে আসা রাষ্ট্রীয় সম্পদ, বিশ্ববাজারে তেলের বিকল্প জ্বালানির উপস্থিতি, তেলের দরপতন, রাষ্ট্রের লাগামহীন খরচে লাগাম টানার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সৌদি আরব। এসব জটিল সমস্যার মধ্য দিয়েই সৌদি আরবকে ভবিষ্যৎ নেতা নির্বাচন করার পথটি মসৃণ করতে হয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া সৌদি আরবের অর্থনীতি ঠিকিয়ে রাখা যে সম্ভব নয় তা নতুন নেতৃত্বও বিশ্বাস করে। একইসঙ্গে প্রত্যাশিত ও প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করতে গেলে যে আগে দরকার দেশটির সামাজিক চিন্তার সংস্কার, তা-ও নতুন নেতৃত্ব ভালো করে অনুধাবন করতে পেরেছে।

এমতাবস্থায় ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের হাতে সম্ভাব্য সামাজিক পরিবর্তনের ফলে কট্টর রক্ষণশীল সমাজের ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ কাঠামো কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে, সেটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। পরিষ্কারভাবে বললে বলা যায়, প্রত্যাশিত ও প্রস্তাবিত পরিবর্তনের প্যাকেজটি রাজপরিবারের সদস্য ও ধর্মীয় কট্টর গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কোনো ধরনের আস্থার সংকট ও বঞ্চনার ক্ষোভ তৈরি করবে কি না, তা নিয়েই চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে প্রথাবহির্ভূত ক্ষমতার পরিবর্তন যে কোনো ধরনের অঘটনের দিকে মোড় নিতে পারে। কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্তত ইতিহাস তা-ই বলে। তাছাড়া বিষয়টি এমন নয় যে সামাজিক অনুষঙ্গে পরিবর্তন ও সংস্কারের ফলে সৌদির কোনো জনপ্রিয় বাদশাহকে মূল্য দিতে হয়নি।

প্রথাবহির্ভূত পরিবর্তন রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরাগভাজনপূর্ণ মানসিকতা লালনকারীদের ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। একই সঙ্গে নতুন ক্রাউন প্রিন্সের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি দেশটির ভিতরে কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠীকে উত্তেজিত করতে পারে।

মোহাম্মদ বিন সালমান বছর দুয়েক ধরে যে অর্থনৈতিক সংস্কারের স্লোগান দিয়ে আসছে সেটি 'মিশন-২০৩০' নামে পরিচিত। তাঁর মূল পরিকল্পনা হল দেশটির তেল নির্ভরশীলতা কমিয়ে অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা; বিকল্প অর্থনীতির সন্ধান করা।

সন্দেহাতীতভাবে তরুণ নেতা মোহাম্মাদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক সংস্কার প্রকল্প সৌদির তরুণ প্রজন্মকে খুব বেশি আশাবাদী করে তুলেছে। তরুণ সমাজ প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্যে সমাজের অন্যান্য পরিবর্তনগুলি দেখতে পাচ্ছে। প্রসঙ্গত, দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই তরুণ।

যাহোক, মোহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। প্রথমটি হল, 'মিশন-২০৩০' বাস্তবায়নের জন্য সৌদি প্রশাসনের সক্ষমতা অভাব। দ্বিতীয়টি হল, অর্থনৈতিক সংস্কার করতে গেলে সামাজিক পরিবর্তনের আবশ্যকতার বিষয়টি। কট্টর ধর্মীয় অনুশাসন সম্ভাব্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পরিবর্তনযোগ্য মৌলিক অনুষঙ্গকে মেনে নেবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের সন্দেহ। প্রসঙ্গত, 'মিশন-২০৩০' সালের মৌলিক উদ্দেশ্য হল দেশের ভিতরে বাইরের বিনিয়োগ নিয়ে আসা। বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনতে গেলেই দেশটিকে ক্রমশ কট্টর রূপ থেকে উদার রূপের দিকে যেতে হবে।

নতুন ক্রাউন প্রিন্স অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য আবশ্যকীয় শর্তগুলি পূরণ করতে আগ্রহী বলেই মনে হয়। বলা যায়, দেশটির রক্ষণশীলতার মৌলিক চরিত্রে পরিবর্তন আনার জন্য তিনি সায় দিয়েছেন। দেশটির খরচের বড় একটি খাত হল সৌদি নাগরিকের প্রবাস ভ্রমণ, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের নানান আধুনিক সুবিধা উপভোগ করার জন্য দেশটির যুবসমাজের বড় একটি অংশ প্রতি বছর ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি দেয়। এতে রাষ্ট্রটির বিশাল অংকের টাকা খরচ হয়। ক্রাউন প্রিন্স দেশের ভিতরেই বিনোদন ব্যবস্থার আয়োজন করতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সিনেমা হলসহ নানান বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান তেলের বিকল্প জ্বালানির উদ্ভাবনের ফলে তেলনির্ভর সৌদির অর্থনীতি যে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা দেশটি হারে হারে টের পাচ্ছে। এমনভাবে চলতে থাকলে, দেশটির পর্যটন খাত থেকে যে সাত থেকে আট শতাংশ রাজস্ব আসে, সেই খাতেও প্রভাব পড়বে। ক্রাউন প্রিন্স বুঝতে পেরেছেন যে ইরান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলি খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও আধুনিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সৌদি আরব কট্টর রক্ষণশীলতা মানতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত, সৌদি আরবের অর্থনীতির সম্ভাব্য চিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আগেও উল্লেখ করেছি যে দেশটির জিডিপি থেকে থেকে তেলের অবদান বাদ দিলে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থান সুদানের চেয়েও খারাপ।

এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের খরচ কমানো ও বিকল্প অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বিনির্মাণ ছাড়া দেশটির অবস্থান মুসলিম বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই সামাজিক পরিবর্তন করে দেশটিকে অন্যান্য ক্ষেত্রে বাণিজ্যবান্ধব করা ছাড়া তেমন বিকল্প হাতে নেই। নতুন ক্রাউন প্রিন্স 'ভিশন-২০৩০' সালের মধ্যে যেসব পরিবর্তন আনতে চাইছেন, সেটি দেশটির ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ রাজপরিবারের ভিতরের সদস্যদেরও প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা যাবে। ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ ছিলেন আধুনিক সৌদি আরবের রূপকার। তাঁর সময়েই দেশটি থেকে এক ডিক্রির মাধ্যমে দাস প্রথা রহিত হয়। সরকারের সিদ্ধান্তে প্রায় হাজার দুয়েক দাসকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। টিভি দেখার অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশের অর্থনীতিতে আধুনিক ধারণা প্রয়োগ হয়। অথচ তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল তাঁরই ভ্রাতুস্পুত্র ফয়সাল বিন মুজাহিদের হাতে।

এবার চলুন আমরা দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণ করি। বর্তমান ভূরাজনীতি, বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি অস্থির সময়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি আরবের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ সালমান দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়ে প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইয়েমেনে হামলার সিদ্ধান্তটি মোহাম্মদ বিন সালমানের। যুদ্ধ শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানের মতো বড় মুসলিম দেশগুলির সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করেও হালে পানি পাননি মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও ইয়েমেনের উপর অনৈতিক যুদ্ধে সায় রয়েছে। সেখানে বহুমাত্রিক যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও উন্নত বিশ্ব নীরব ভূমিকা পালন করছে।

যাহোক, ইয়েমেন যুদ্ধ এখন সৌদির আরবের জন্য 'শাঁখের করাত'। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবের জন্য এখন দুটি পথ খোলা আছে। প্রথম পথ: পরাজয় মেনে ইয়েমেন ত্যাগ করা। দ্বিতীয়টি হল: যুদ্ধে আরও বড় ধরনের বিনিয়োগ করা। সৌদি আরব বড় ধরনের বিনিয়োগের দিকেই যাচ্ছে। আর এখানেই অন্যান্য প্রিন্সের চেয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় আরেকটি মৌলিক কারণ হল কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে একঘরে করে দেওয়া। কাতারের অর্থ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের জন্য 'অক্সিজেন' হিসেবে কাজ করছে– এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফ্রান্সের মতো দেশ উগ্রবাদ প্রচারের অভিযোগে কাতারের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী যেসব ওহাবিজম মসজিদ আছে, সেইগুলির বড় পৃষ্ঠপোষক কাতার।

তবে সৌদি আরব যেভাবে কাতারের উপরে সন্ত্রাসবাদের একক অভিযোগ নিয়ে নিজেকে 'ধোয়া তুলসী পাতা' বানাতে চাইছে, বিষয়টি সেরকম নয়। কাতার সৌদি আরবের নেতৃত্বেই সন্ত্রাসবাদে মদদ দিয়েছে। আইএস সৌদি আরবের জন্য 'ব্যাকলাশ' না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরবের অর্থ আইএস পেয়েছে। এমনকি সরকারি পর্যায়ে অর্থায়ন বন্ধ হলেও পরে ব্যক্তিপর্যায়ে আইএসের জন্য অর্থায়ন সৌদি আরব থেকে হয়েছে। তাছাড়া সৌদি আরবের প্রায় ৪৪ শতাংশ নাগরিক ওহাবিজমে বিশ্বাস করে। এই ওহাবিজমের ত্বাত্ত্বিক মন্ত্রেই আইএস, আল কায়দা আর তালেবানের মতো ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়ে। আধুনিক সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস সৌদি আরবের ভূমিকা বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়।

কাতারের প্রতি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগের পেছনে রয়েছে ইরানের প্রতি কাতারের ক্রমশ বেড়ে উঠা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক। সৌদি আরব এই অঞ্চলে যা চায়, সেটির বিপক্ষে গিয়ে কোনো রাষ্ট্র কিংবা নেতা টিকতে পারেনি। ইরানকে শায়েস্তা করতেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে কয়েকটি মুসলিম দেশ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। মোহাম্মদ বিন সালমান এখানে মূল কারিগর। মোহাম্মদ বিন সালমান কাতারের বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছেন। সিদ্ধান্তটির মাধ্যমে বহুমাত্রিকভাবেই তাঁর রাজনৈতিক দর্শনটি আমেরিকাসহ দেশটির মিত্র দেশগুলিকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়।

তৃতীয় কারণটি আমেরিকা ও সৌদি আরবের ভিতরকার সম্পর্ক। ডোনাল্ড ট্রাম্প ওভাল অফিসে যাওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে। সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে বারাক ওবামা প্রায় 'ডিপ ফ্রিজ'-এ রেখেছিলেন। ট্রাম্প সেটিকে মেরামত করে আগের চেয়ে আরও ঘনিষ্ঠ করছে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরবকে বেছে নেওয়ার পিছনে যে মানুষটি কাজ করেছেন তিনি হলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে মোহাম্মদ বিন সালমান আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে একক নেতৃত্ব ধরে রাখতে আমেরিকার সমর্থন ও অস্ত্রের সরবরাহ, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সৌদি আরবের নেতৃত্ব দেওয়াসহ নানান আলোচনা মোহাম্মদ বিন সালমান ও ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যে আলোচনা হয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের পাশাপাশি বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী সমাজকে তাঁর উচ্চাবিলাসী 'ভিশন-২০৩০' সম্পর্কে অবহিত করেন। ট্রাম্পের প্রথম বিদেশ সফর স্মরণীয় করতে সৌদি আরব মানব ইতিহাসে সবচেয়ে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করে। এখানেও মোহাম্মদ বিন সালমানের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এমতাবস্থায় এটি সহজেই বলা যায়, দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, নতুন ক্রাউন প্রিন্সকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। পুরো প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে সামনে এগোতে হবে।