পড়ন্ত বিকেলে চিকনাগুলের জলকন্যায়

আলমগীর হোসাইন
Published : 30 August 2017, 04:46 AM
Updated : 30 August 2017, 04:46 AM

চারিদিকে থৈথৈ করছে অথৈজল, মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটি বন । দূর থেকে মনে হয় সবুজ শাড়ি পরে জলে ডুব দিয়েছিল এক জলকন্যা , জল থেকে উঠে শুকাতে সূর্যের কাছে এলিয়ে দিয়েছে সেই ভেজা গা । কাছে যেতে যেতে কম্পিউটারের পিকচার জুম অপশনের মতো ছোট থেকে ক্রমেই বড় হতে থাকে । নাগালে যেতেই মনের গভির থেকে আনমনে মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে "আহা কতো সুন্দর"। আঁকাবাঁকা গাছ আর ডালের ঝাড়, গাছের শীর্ষডালে মন ছেড়ে শিস দেয় একলা পাখি, কাটবিড়ালির মতো গাছ বায় তাগড়া ঈদুর, ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে দোল খায় পড়ন্ত সূর্যের আলো, বনের এমন মনকাড়া রূপে একে যেন করে তুলেছে পিকচারপোস্টকার্ড । তা হলে কোথায় এ বন? বলার আগে বলে নেই রবীঠাকুরে সেই বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি চরণ ।

"দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু"

হ্যা বিকেলে প্রকৃতির একটু ভিন্নস্বাদ নিতে নৌকা চড়তে গিয়েছিলাম হাওরে। তবে সৌন্দর্য যে এতোটা জাল ছড়িয়ে বসে আছে ভাবিনি । জলের উপর এই ভাসমান বন দূর থেকে দেখে আসছিলাম বহুদিন ধরে। যাবো যাবো ভেবে হয়নি কখনো যাওয়া । অতপর ২৭ আগস্ট রবিবার বন্ধু নাসির,ইফতেখার আর জয়নালকে সাথে নিয়ে নৌকা বাইতে বাইতেই পৌছে গেলাম সেই মনকাড়া বনের দ্বারে । বন্ধু জয়নালের কথা আলাদা ভাবে বলতেই হয় কারন দক্ষতায় সে একেবারে জাত মাঝি । তার কারনেই আরামছে যেতে পেরেছি জলকন্যায়।

বেশী দূরে নয় এই জলকন্যা রূপি শতবর্ষী বনের অবস্থান আমাদের চিকনাগুল হাওরের উত্তরপূর্ব দিকে। আরো সহজ করে বলতে গেলে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুলের উমনপুর এবং পানিছড়া গ্রামের পূর্বে অক্সির পুলের কাছে ।

জল আর বনের এমন অপূর্ব মিথালীর জন্য এ বনের নাম জলকন্যা যথার্থ । এ বনের সবচেয়ে বড় আকর্ষন প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে এটিও বৈশিষ্ট পাল্টায় । বৃষ্টি বা ঢল নেমে হাওরে জল টুইটুম্বুর হলে কোনমতে মাথা উঁচিয়ে শ্বাস নেওয়ার মতো এটিও মাথা বের করে বাকিটা ভিজিয়ে রাখে , জল সামান্য কমলেই যেন যৌবন উছলিয়ে উঠার মতো রূপ বের করে হাতাছানি দেয় প্রকৃতি প্রেমীদের । আর একেবারে কমে গেলে সেও জলের খোলস থেকে বেরিয়ে আসে সগৌরবে। তখন নৌকা ছাড়া পায়ে হেটেই যাওয়া যায় অনায়াসে । তবে বছরের বেশীরভাগ সময়ই এর আশেপাশে থাকে জলের বেষ্টনী । শুকনো মৌসুমেও একবার যাবো, দেখবো বলে তার ভিন্নতর রূপ । তবে বৃষ্টির  জলবন্দী জীবনের একগুয়েমীতা কাটাতে, এবং এর মূলরূপ উপভোগ করতে  বর্ষামৌসুমে  যাওয়াই হবে সবচেয়ে বেশী আনন্দের।  কেননা এ সময় না গেলতো কলকল জলে দুল খাওয়া নৌকা ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যাবেনা । আকাশের নিচে ভাসতে দেখা যাবেনা আরেক আকাশ, আয়নার মতো ঝকঝকে জলে জলকন্যার মুখ দেখার অপরূপ দৃশ্য । বনের ভেতরে দেখা যাবেনা মাছের ঘাই, জলের সাথে পড়ন্ত সূর্যের মাখামাখি কিংবা ঝিমিয়ে যাওয়া বিকেলের শাপলাফুল ।

এ হাওর এবং বন সংশ্লিষ্টদের কথাঃ

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এখান থেকে প্রতিবছর গাছখেকো মানে গাছচুরেরা অগনিত গাছে কেটে ফেলছে । ভাসান পানির সময় স্থানীয় এবং বহীরাগত চোরদের আনাগোনা বাড়ে এখানে । অনেকের মতে এখানে নাকি বর্তমান গাছের চেয়ে পূর্বে প্রায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশী গাছ ছিল । এখানে বটবৃক্ষের মতো বড়বড় শতবর্ষী গাছ ছিল, পাখি শাপ, ঈদুর,আর নানান সব বিচিত্র পোকার অভরায়ন্য ছিল এই বন । প্রতিবছর এখান থেকে এতো বেশী গাছ চুরি হয় যে এ বনের ভেতর এখন তুলনামূলক ভাবে প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়েছে । গাছ চুরি টেকাতে নাকি বিশেষ ভূমিকা নিতে দেখা যায়না কারো । আমরাও দেখেছি এখানে পাশাপাশি দুটি বন। একসময় এটি সম্ভবত একটি বনই ছিল মাঝখান থেকে গাছ উধাও হওয়ার কারনে বিচ্ছেদ ঘটেছে । পূর্বের মতো থাকলে এটি রাতারগুলের মতোই কিংবা এর চেয়ে সুন্দর থাকতো বলে ধারনা করা হয় । তবে এখনো এটি তার রূপ পুরোপুরি হারায়নি, চুরদের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে কোনমতে। সৌন্দর্যে রাতারগুলের সাথে এটি তুলনীয়। এ সৌন্দর্য ধরে রাখতে গাছ চুরি ঠেকাতে হবে। সিলেটে আগত পর্যটকদের জন্য এটি হতে পারে পর্যটনের এক নতুন ঠিকানা ।

নোটঃ- মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, সিএনজি ইত্যাদি নিয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক । সাথে গাড়ি না থাকলে চিকনাগুল বাজার থেকে সিএনজি ভাড়া করে নিয়ে যেতে পারবেন । সিলেট গ্যাসফিল্ডের পানিছড়া থার্ড গেইটের সামনের রাস্থা দিয়ে সোজা হাওরের দিকে গেলে একেবারে শেষ মাথায় এসে দেখা মিলবে একটি স্টিলের পুল, না চিনলে যে কাওকে অক্সির পুলের কথা বললেই দেখিয়ে দিবে । এ পুলের কাছে কোন বাড়িতে বা কারো দায়ীত্বে গাড়ি রেখে স্থানীয় জেলেদের কাছে নৌকা চাইলে খুশি মনেই তারা ঘুরিয়ে দেখাবে এ বন । খরচ বলতে কিছু নাই আপনি খুশি হয়ে যা বকশিস দেবেন তাতেই হবে । আবার উমনপুর দোকানে নেমে এর বিপরিত মুখী রাস্থায় গিয়েও একিভাবে যাওয়া যাবে ।

সতর্কতাঃ- মশা,বিছা ও শাপ সম্বন্ধে শতর্ক থাকুন। হঠাৎ শাপ দেখলে দূর থেকে ছবি তুলুন ভয় পাবার কিছু নেই, কারন কোন শাপই অকারনে কামড়ায়না ।

জলে কোন বর্জ্য ফেলবেননা । কোলড্রিংকের বোতল কিংবা খাবারদাবার পানিতে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না ।