কক্সবাজারে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে উতলা মন

আলমগীর হোসাইন
Published : 14 Oct 2017, 08:40 AM
Updated : 14 Oct 2017, 08:40 AM

বিশাল সমুদ্রে যেন মিশেছে দূর আকাশের সীমানা। উত্তাল সমুদ্রে ঢেউয়ের পেছনে ফণা তুলে আসে ঢেউ। সাথে দুধ সাদা ফেনার উৎসব। বিরামহীন ঢেউয়ের নৃত্যে ঝংকার তুলে হুহু সুরের মূর্ছনা । সৈকতে আছড়ে পড়া সে ঢেউ পর্যটকদের পায়ে পরায় ফেনার নূপুর । সমূদ্রের মনভোলানো নানান রোমাঞ্চ মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় পর্যটকদের সব ক্লান্তি। শিস দিয়ে যেন আনাড়ি করে তুলে পর্যটকের মন। তাইতো দিন গড়াতেই তার বুকে জমে পর্যটকের উপচে পড়া ভীড়। বলছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এবং বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন স্পট এটি।

কক্সবাজার বেড়ানোর ইচ্ছা বহুদিনের। প্রিয় সাইদুল মামার সৌজন্যে আর মাহমুদ মামার সাপোর্টে বেরিয়ে পড়ি ইচ্ছে পূরণে। সিলেটের গোলাপগঞ্জ বাঘা বাজার থেকে সেদিন (২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭) সন্ধ্যায় আমাদের বাস ছাড়ে কক্সবাজার অভিমুখে। সন্ধ্যা গড়িয়ে পৃথিবীর বুকে নামে নিকোশ কালো অন্ধকার। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে দারুন গতিতে ছুটে চলে গাড়ি, মাঝে মাঝে সড়কের ভাঙা গর্তে পড়ে বুক ধুকধুকানি ঝাুকুনি!

চোখেমুখে তখন কক্সবাজার ভ্রমণের তীব্র উত্তেজনা। সমান উত্তেজনা আমার পাশে বসা মুকিত মামার চোখে। তাইতো নানা গল্পে মেতেছি দুজনে। কিছুদূর যেতেই যেন গহিন ঘুমে ডুব দিলেন আরিফ মামা। গাড়িতে কারো চোখে ঘুমের আবেশ কারোবা চোখে কক্সবাজার যাওয়ার উত্তেজনায় ঘুম নিরুদ্দেশ । কুমিল্লা দিঘির পারে এসে হাল্কা ব্রেক কষে আমাদের গাড়ি । উদ্যেশ্য রোমান মামার বাসা। কারন রাতের ভুরিভুজের জন্য তাঁর বাসার বড় ডেকসিতে আমাদের জন্য তখন অপেক্ষা করছে ধোঁয়া উঠা গরম বিরিয়ানি। গপাগপ বিরিয়ানি গিলে গলায় তুলি তৃপ্তির ঢেঁকুর । রাতের খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষে আবারো ছুটে চলে গাড়ি। অন্ধাকারের ফ্রেমে আবদ্ধ দৃষ্টি। তাইতো দেখা যায়না দূর সীমানা। চলতে চলতে রাতের খোলস ফুড়ে উঁকি দেয় ভোর। চোখ ছুঁয়ে যায় আলোর আলপিন।

ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করতে মাঝে মাঝে ব্রেক কষে গাড়ি । কড়া লিকারের চায়ে চলে মন চঙ্গা কারার আয়োজন। কখনো ভুরিভোজ । অবশ্য কর্ণফুলী সেতুর কাছে এসে চা বিরাতি বা ভুরিভুজের জন্য থামেনি আমাদের বাস । বাংলাদেশের অন্যতম এ দীর্ঘ সেতুকে ঘিরে জমে উঠেছে সকালের ব্যাস্ত নদী বন্দর । বন্দরে জাহাজ, মাছধরা ট্রলার আর সাম্পানের যেন মিলন মেলা, জেলেরা ঝাকে ঝাকে মাছ তুলছে পাড়ে । ইলিশের ঘ্রাণ যেন পাগল করে মন । এমন পরিস্তিতে কিছু সময় না দাড়িয়ে এবং মাছ আহরোনের এ দৃশ্য উপভোগ না করে গাড়িতো আর সামনে এগুতে দেয়া যায়না। এখানে কিছু সময় থেমে আবার ছুটে চলি সম্মুখে । সড়কের ছন্দে চলে গাড়ি। কোথাও চোখের সামনে ধরা দেয় ছায়া ঘেরা গাছের সারী, নদী, হাওর, ঘনজঙ্গল, পাহাড় কখনোবা শহরের অট্রালিকা । জানালা দিয়ে কখনো দৃষ্টি চলে যায় দৃর সীমানায় ।

পাহাড়, নদী, ঘনজঙ্গল, শহরের কোলাহল আর খোলা প্রান্তরের প্রদর্শনী উপভোগ করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়ি থামে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে। কলাতলি বিচ স্টেন্ডে গাড়ি পার্কিং করে টানা ভ্রমণ থেকে মিলে নিস্তার।

একটানা ভ্রমনের ক্লান্তি ভর করেছে সবার উপর। তাই চোখ কচলাতে কচলাতে বিশ্রামের জন্য হোটেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। মোটামোটি সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের কয়কেজনের চোখে কিছুতেই ঘুম আসছেনা। কেননা স্টেন্ড থেকে সমুদ্রের যে গর্জন শোনা গিয়েছিল সে গর্জন কানে ভাসছে বারবার। তাই কিছু সময় বিস্রাম নিয়ে ছুটে চলি সমুদ্র পানে। নগ্ন পায়ে সৈকতের নরম বালুচরে দাঁড়াতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন মুহূর্তে ধুয়ে নিয়ে যায় সমূদ্রের উচ্ছ্বাস। রাতের সমূদ্র একেবারে অন্যরকম। ব্যস্ত নগরীর ক্লান্ত নাগরীকের নাক ডাকা সুরে যেন ঘুমিয়ে যায় পুরো পৃথিবী। কিন্তু সদা জাগ্রত সমূদ্রের উত্থাল ঢেউয়ে যেন উতলা করে তুলে আমাদের মন । এ দৃশ্য অসাধারন । রাতকে বিদায় দিতে সমূদ্র বুকে জোয়ার এসে যেন চলে ভোরের আমন্ত্রণ। আকাশে আলো ফোঁটলে চোখে ধরা দেয় বালুচরে লাল কাঁকড়ার লুকুচুরি খেলা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া নানা রঙ্গের শামুক-ঝিনুক।

সকালে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামে চলে যাই। চোখে ঘুমের হাল্কা পরশ এলেও যেন জেগে থাকে মন। সকাল এগারোটা বাজতেই গোসলের প্রস্তুতি সেরে ছুটে চলি সমুদ্র-রোমঞ্চে । ঢেউয়ে পিঠ ঠেকিয়ে উপুড় হয়ে পড়া, ঢেউয়ে ভেসে কিংবা লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দেওয়ার সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। যেন ফিরে যাই শৈশবে। ঢেউয়ের সাথে চলে অবিরাম ছেলেখেলা। চলে ওয়াটার বাইক, মোটর বাইক, সার্ফিংয়ের এডভেঞ্চার । ছাতার নিচে বসে এ দৃশ্য উপভোগের স্বাদ একেবারে ভিন্ন। বিচে ছাতায় বসে, পাড়ে দাড়িয়ে কিংবা সমুদ্র ঢেউয়ে ভিজে জুবুথুবু হয়ে চলে ক্লিক ক্লিক ছবি তোলার ধুম। ভ্রমণের এ সেরা সময়টুকু হয় ক্যামেরাবন্দি। কলাতলি, সুগন্ধা, লাবনী বিচ সহ আরো কয়টি বিচ, ঢেউ আর গর্জন মিলে সমুদ্র সাজিয়ে বসেছে রোমাঞ্চিত সৌন্দর্যের পসরা। এ যেন মনোমুগ্ধকর এক ভিন্ন জগত।

শেষ বিকেলে আসে জোয়ার, পৃথিবীর বুকটাকে লালা রঙ্গে সাজিয়ে লাল থালার মতো সূূর্য ঢুবে পশ্চিম সমুদ্রে । দিনের ক্লান্তিতে বিদায় হয় ঢেউয়ের সাথে পাঞ্জা লড়ার রোমাঞ্চ।

কিন্তু সমুদ্র প্রেম যেন পিছু টানে মন । সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে আমাদের গাড়ি টার্নিং নেয় সিলেটের পথে । দু-রাতের ঘুমহীন চোখে আসে গাড় ঘুমের আবেশ । ঘুমের ঘোরে গাড়ির শাঁশাঁ শব্দকে মনে হয়ে হুহু ঢেউয়ের সুর, হাল্কা ঝাকুনিতে মনে হয়ে আঁছড়ে পড়া ঢেউ। গাড়ির সাথে মনে হয় ছুটে আসছে সমূদ্র । এ যেন সমূদ্রের সাথে গভির প্রেম ।

নোটঃ যারা কক্সবাজার যেতে চান অবশ্যই বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সাথে বেড়াতে যাবেন। কারন একা আর আহাম্মকে সমান। একা গেলে কোন মজাই পাবেন না । আপনার গন্তব্যস্থল থেকে পরিবহন খরচ চাহিদামতো হোটেল ভাড়া ও খাওয়া এবং অন্যান্য খরচের হিসেব করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু টাকাও সাথে রাখুন। সমূদ্র স্নানের পর শরীর আঁঠালো হয়ে যায় তাই এ আঁটালো ভাব দূর করতে কলের পানিতে গোসল করুন।

সতর্কতাঃ সামান্য অসতর্কতায় প্রতি বছর অনেক পর্যটক সমুদ্রে গোসল করতে নেমে প্রানহানির শিকার হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। ভাটার সময় গোসল না করাই শ্রেয়। ভাটা ও জোয়ারের সময় অনুযায়ী সৈকতে লাল ও সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়। যখন সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হবে তখন গোসল করা নিরাপদ। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নিন। লাইফ গার্ডের কথায় গুরুত্ব দিন। গোসলের সময় সমুদ্রের বেশী গভীরে না যাওয়াই ভাল। কোন বর্জ্য, চিপসের পেকেটে বা কোলড্রিংকের বোতল ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

ইতিহাসের ঝাঁপি থেকেঃ কক্সবাজারের এ রোমাঞ্চ ফেলে ফিরে আসতে চায়ানা মন। তবু আসতে হয়। কিন্তু মুগল সম্রাট শাহ সোজা এ মুগ্ধাতা ফেলে যেন যেতে চাননি অন্য কোথাও। তাই সম্রাটের নির্দেশে তার সাথের প্রায় এক হাজার পালংকি অবস্থান নেয় এখানে। যার ফলস্রুতিতে এলাকার নাম হয়ে যায় পালংকি । মুগলদের পর অনেক হাত হয়ে এটি যায় ব্রিটিশের দখলে । ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নামানুসারে পালংকি হয় কক্সবাজার । ইতিহাস ঘেটে জানা যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধ্যাদেশে ওয়ারেন্ট হোস্টিং বাঙলার গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে হিরাম কক্সকে পালংকির মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন। এবং শরণার্থীদের পুণর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেন কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই মারা ১৭৯৯ সালে মারা যান। তার পূর্নবাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় কক্স সাহেবের বাজার। এই কক্স সাহেবের বাজার লোকমুখে প্রচলিত হয়ে কক্সবাজার নাম ধারন করে।

….

চিকনাগুল, জৈন্তাপুর,সিলেট