মনপাখি- তোমার জায়গা কোথায়- কোন খাঁচায়?

মোঃ রওশন আলম
Published : 6 Sept 2015, 07:10 PM
Updated : 6 Sept 2015, 07:10 PM

বিদেশের মাটিতে কেমন কাটে আমাদের? কারা আসেন দেশ থেকে বিদেশে? কেন আসেন? দেশের সাথে নাড়ির টান কি ছিঁড়ে যায় বিদেশে এলে? এমন সব প্রশ্ন ভর করে আমাদের অনেকেরই মাঝে। কখনো থাকতে থাকতে ভাল লেগে যায় কারো কারো বিদেশের মাটিতে, তাই তারা থেকে যায়। আবার কেউ কেউ অগত্যা থেকে যেতে বাধ্য হয় বিদেশে। দোদুল্যমান মনে আজ চলে যাব কাল চলে যাব এভাবে গুনতে গুনতেও অনেকের মাস, বছর পার হয়ে যায় কিম্বা যুগই চলে যায়, তবুও আর ফিরে যাওয়া হয়না প্রনপ্রিয় দেশে, ফেলে আসা সোনার বাংলাদেশে। কিসের টানে আবার ফিরে যেতে চায় মন দেশে? আমরা বলে থাকি দেশে এতো খুন, এতো চুরি, এতো দুর্নীতি, এতো অনিরাপত্তা, এতো স্বজনপ্রীতি তারপরেও মন কেন চায় তাহলে বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে? কি ফেলে এসেছি সেখানে? নাড়ির টান নাকি সংস্কৃতি নাকি দেশটির প্রতি নির্মল ভালবাসা? নাকি সবগুলোই? কেন পারিনা তাহলে অবশেষে ফিরে যেতে সেখানে? কিসের বাঁধা পথিমধ্যে? আমার মাতৃভূমিতে আমি ফিরে যাবো, বাঁধা দেবে কে তাতে? তাহলে পারিনা কেন সে সিদ্ধান্ত নিতে? আমরা অজানা এক আকাঙ্খায় আটকে পড়ে থাকি বিদেশের মাটিতে। কি সে আকাঙ্ক্ষা বিদেশে? শুধু কি ডলার? নাকি গ্রিন কার্ড? নাকি প্রফেশন? নাকি পরিবার? নাকি সাদা বিদেশিনী বউ? নাকি দেশের মাটিতে অনিরাপত্তা ভেবে? নাকি দেশ আমাদেরকে ধরে রাখতে পারেনা (এ প্রশ্নটি করা কি চলে? হয়তো অবান্তর বটে)? তাহলে ১৬-১৭ কোটি বঙ্গ সন্তান আজো দেশে আছে কি করে? শুরুতেই অনেক প্রশ্ন করে ফেললাম, তাই না? এতোসব প্রশ্নের মাঝেও যদি আরেকটি প্রশ্ন রাখি তা কি খুব বেশি বলা হবে? আমরা কি শুধুই আমদ ফুর্তিতে ও সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করে থাকি বিদেশের মাটিতে? ডলার কি হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসে আমাদের হাতে? গাছের পাতার মতোই ঝোঁক দিলে তা কি পড়ে? আসুন তাহলে একটু জানি।

মধ্যপ্রাচ্যের কথায় ধরুন। দেশ থেকে কারা যায় সেখানে? যারা যান তাঁদের অধিকাংশই মূলত শ্রম বিক্রি করতে যান সেখানে। শ্রমের বিনিময়ে সেখান থেকে দিনার, রিয়াল বা রিঙ্গিত আসে। দেশ থেকে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে যারা সে শ্রম দেন, সে এক অমানবিক পরিশ্রম। তবুও তারা তা করে থাকেন। কারণ, আশায় জেগে থাকে তাঁদের মন। একদিন কিছু টাকা জমবে। সেই টাকা দিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে কিছু একটা করে খাবে। হয়তো ছোট একটা দোকান। ব্যবসা। স্বাধীন ব্যবসা।

মা, বাবা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্রকে নিয়ে এক নব জীবনের সূচনা করবে তারা। হাসি ফুটাবে পরিবারের সবার মুখে। সে আশায় জীবন যৌবনকে প্রায় দীর্ঘ সময় ধরে জিম্মি করে রাখেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে। তাঁদের কর্মক্ষেত্রের সঙ্গী যারা থাকেন বিশেষ করে অন্য দেশের শ্রমিকদের কাইজ্জা-লাঞ্চনা, তদুপরি ভাষার বিড়ম্বনা সবই সহ্য করে নেয় তারা এই ক্ষণিকের জীবনে। নারী হলে পদে পদে বিপদ আরো বেড়ে যায়। একটু ভুলে নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে ললাটে তাঁদের। ভাষা জানা না থাকায় কাকুতি মিনতিও সঠিকভাবে করতে পারেন না তারা মনিবের কাছে। তাই হাত পা ধরেও তখন মাফ পান না তারা দানবদের হাত থেকে। সব কিছু সহ্য করে নিতে বাধ্য হন তারা অবশেষে চোখ বুজে ভবিষ্যতের সুন্দর ও সচ্ছল এক সংসার গড়ার বিভোর স্বপ্নে, দেশে ফিরে গিয়ে। ক'জনের ভাগ্যেই বা সে স্বপ্ন পূরণ হয়ে থাকে তাঁদের নিজের মতো করে? সে হিসেব কি আছে আমাদের কাছে? মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের কি কষ্ট বা বেদনা তা কি আমাদের দেশের সরকার পুংখানুপুংখভাবে জানার চেষ্টা করে থাকে? শ্রমিকদের কষ্ট লাঘবের জন্য দেশে আগাম ট্রেইন করে তাঁদেরকে প্রস্তুত করা অথবা মিনিমাম কথা বার্তা বিনিময়ের জন্য তাঁদের ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা আমাদের দেশে সরকারী উদ্দীপনায় কি হয়ে থাকে? আমরা শুধুই রেমিটেন্স বাড়ানোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কত আসলো মাসে? বছরে?

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া অথবা জাপানের মাটিতে কারা আসেন? দেশের সবচেয়ে স্কিলফুল ছেলেমেয়েরা এসব দেশে পাড়ি জমায় উচ্চশিক্ষার আশায়। আশায় বুক বেঁধে উড়াল দেয় তারা বিদেশ ভুবনে। বিদেশে গবেষণা করবে বিজ্ঞান জগতের সেরা টপিক নিয়ে- সে আশায়। কখনো তা হিগস-বসন কনা নিয়ে, অথবা শরীরের ডিফেকটিভ জিন নিয়ে অথবা সেলের নিউক্লিয়াসের মধ্যের যে মিউটেটেড ডিএনএগুলো ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টির জন্য অনেকাংশেই দায়ী তাঁদের সনাক্তকরণ ও চিকিৎসার উপায় খুঁজে বের করার প্রয়াস চালায় তারা। সফলও হয় অনেকক্ষেত্রে। কেমিস্ট্রির ন্যাচারাল প্রোডাক্টসের টোটাল সিনথেসিস করে ফেলতে পারেন অনায়াসে তারা এখন বিদেশের ল্যাবরেটরিতে। এ আর এমন কি নতুন খবর এখন বাংলাদেশী সায়েন্টিস্টদের কাছে? গবেষণার গভীর নেশায় তারা মত্ত হয়ে যায় একসময় ভিনদেশে। এ নেশা প্রফেশনের নেশা, এ নেশা জীবনকে গতিশীল রাখার নেশা। গবেষণালব্ধ ফলাফল পাবলিশও হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেচার সাময়িকীতে অথবা সায়েন্স ম্যাগাজিনে কিম্বা সেলের মতো হাই ইমপ্যাক্ট জার্নালগুলোতে অথবা আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। এভাবে দেশ থেকে উঠে এসে এই স্কিলফুল খাঁটি সোনারা প্রফেশনাল জীবন শুরু করতে থাকেন বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অথবা সিলিকন ভ্যালির মতোন সিটিগুলোর হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিতে অথবা ড্রাগ ফার্মাগুলোতে। গবেষণার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে শেখেন তারা। কেউ কেউ ভাল সফলতা পান আবার কম্পিটিশনের তালে অনেক সময় অনেকে পিছেও পড়ে যান। এদেশে কোনো মামা বা চাচা নেই, নেই কোনো মামা-চাচার ফোনও। তাই মেধার উপরে নির্ভরশীল হয়ে তা দিয়েই কেবল টিকে থাকতে হয় তাঁদের। তাবৎ বিশ্বের খ্যাতনামা সায়েন্টিস্টদের পাশে তাঁদেরও নাম লেখা থাকে আন্তর্জাতিক জার্নালের পাতায় পাতায়। এসব সাফল্য এখন বাংলাদেশ থেকে আগত ছেলেমেয়েরা হরহামেশায় করছেন বিদেশের মাটিতে। তাহলে এমন গবেষণা কেন তারা করতে পারছেন না দেশের মাটিতে? কিসের অভাব সেখানে? মেধা রিকগনিকেশনের অভাব? গবেষণার অবকাঠামো? অর্থ? পলিটিক্স কি অন্তরায়? গবেষণার অর্থের জন্য লবিং? নাকি অন্য কিছু? নাকি নীল বা সাদা রঙ্গের পিছনে দৌড়?

স্কিলফুল ছাড়াও আরো আগত যারা আছেন এসব উন্নত দেশে তারা হচ্ছেন ইমিগ্রানটরা। মূলত তারা আসেন সরাসরি ইমিগ্রানট ভিসার মাধ্যমে। কখনো তারা আসেন আপনজনদের স্পন্সরের মাধ্যমে, কখনো বা ভাগ্যের চাকা যদি লাইজ্ঞা যায় লটারিতে- যেমন ডাইভারসিটি ভিসা লটারি (আপাতত তা বন্ধ রয়েছে আমেরিকাতে)। তারা এসে নিরালস পরিশ্রম করে থাকেন এসব দেশে। প্রথমে তাঁদের অনেকের ভাষার সমস্যা হয়ে থাকে। জীবনের তাগাদায় তা তারা ধীরে ধীরে কেটে উঠতেও সক্ষম হন একসময়। এমনকি যারা দেশ থেকে শিক্ষিত হয়ে এসেছেন তারাও পড়ালেখা চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে আর মনোযোগী হয়ে উঠতে পারেন না এখানে এসে। কারণ সারভাইভালের জন্য বড্ড অর্থের দরকার হয় এখানে। তাই অড জব (প্রতি ঘণ্টায় ডলার) অথবা ট্যাক্সি ড্রাইভ অথবা ব্যবসার প্রতি নজর কাড়ে তাঁদের আসার সাথে সাথেই। কাঁচা টাকা অর্থাৎ নগদ উপার্জন। শরীরের ক্লান্তিতে তারা অবসর নিতেও যেন ফুসরৎ পান না। এই নগদ উপার্জন মোটেই সহজ নয় এখানে। রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ এই জবগুলতেও। যারা করেন তারাই কেবল জানেন তা। দুটি ডলার আয়ের পিছনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন তারা।

বিদেশের মাটিতে এভাবে অনেক সময় কেটে যায় আমাদের নিমিষেই। দিন, বছর, যুগ। কাঁচা চুলে দু একটা পাকও ধরে যায়। স্ত্রী, সন্তান, সংসার শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ নতুন জেনারেশনের আগমন ঘটে এই পৃথিবীতে। তাঁদের বেড়ে উঠার সাথে সাথে চাহিদারও পরিবর্তন হয়। এসব দেশের নিয়মে স্কুল কলেজ শুরু হয়ে যায় সন্তানদের। অ, আ, ক, খ এর বিপরীতে তারা শিখে ইংরেজি বর্ণ, শব্দ, বাক্য কিম্বা জাপানের হিরাগানা, কাতাগানা বা কাঞ্জী। বিদেশের মাটিতে আমাদের সন্তানরাই হচ্ছে নিউ জেনারেশন। তাঁদেরকে ঠিক নির্দেশনায় ভিন্ন কালচারের মধ্যে বড় করা তাই পিতামাতার ঐকান্তিক দায়িত্তের মধ্যে পড়ে যায়। তাই আমাদের চিন্তাশক্তিও ভবিষ্যতের নতুন চিন্তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। আমরা যারা দেশ থেকে এসে ভিনদেশে এসে এভাবে প্রথম জীবন শুরু করে থাকি, ঠিক এভাবেই আমাদের কোমর পর্যন্ত ধীরে ধীরে এদেশের শুষ্ক মাটির মধ্যে আটকা পরে যায়- যা থেকে উঠে আসা বড়ই এক কঠিন যুদ্ধ বলেই প্রতিভাত হয়। ঠিক চোরাবালির মতো। এখান থেকে উঠে তাই দেশ অভিমুখে আবার স্থায়ী উড়াল দেওয়া অনেকের জন্যই বড় কঠিন পথ হয়ে দাঁড়ায়।

বিদেশের মাটিতে আমাদের অধিকাংশের নিকট আত্মীয়-স্বজন নাই বললেই চলে। এখানে আপনজন বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে নিজ দেশের ভাই-বোনরাই। আপদে বিপদে তারাই কাছে আসেন, আবার তারাই মাঝে মাঝে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন- যা অস্বাভাবিক কিছু না- বরং জীবনেরই অংশ। এতদসত্তেও রক্তের টানের একটা বড় অভাব তো থেকেই যায়। মনপাখির মধ্যে তখন বড়ই উথাল পাতাল বা নাড়াচাড়া দেওয়া শুরু হয়ে যায়- বিশেষ করে দেশের দিকে উড়াল দেবার জন্য। মনের সে অতৃপ্ত ক্ষুধা নিবারণ করা বড়ই দুস্কর হয়ে উঠে।

দীর্ঘদিন ভিনদেশে থাকার ফলে আমরা না পারি চিরতরে দেশে ফিরে যেতে, না পারি বিদেশের মাটিতে খাঁটি বিদেশি হতে। মনপাখি তাই দেশ ও বিদেশের মাঝে কোনো এক অচেনা খাঁচায় আটকা পড়ে থাকে। মনপাখিকে তাই মাঝে মাঝে বলি, মনপাখি- তোমার জায়গা কোথায়? কোন খাঁচায়? উড়াল দিবে তুমি এখন কোনপথে?