সাগর তীরের শিশু আয়লান কুর্দি

মোঃ রওশন আলম
Published : 14 Sept 2015, 11:05 AM
Updated : 14 Sept 2015, 11:05 AM

তিন বছরের একটি শিশু। নাম তাঁর আয়লান। ক'দিন আগে শিশুটির নিথর দেহ পড়ে ছিল সাগর তীরে। কান পেতে কিছু একটা যেন শুনতে চাইছে সে এই সভ্য পৃথিবীর কাছে। হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় সে কান পেতে ছিল। কেন এই দুর্যোগমুখর সাগর পথে এ বয়সে তাঁকে যাত্রা দিতে হল, অথবা কেনই বা মরতে হল তাঁকে এবং তাঁর খেলার সাথী মাত্র দু' বছরের বড় আপন ভাইকে ও তাঁদের মায়াবতী মাকেও একই সঙ্গে একই পরিনতি বরণ করতে হল?

আয়লান কুর্দির নিষ্প্রাণ দেহের ছবিটি যেন অনেক কথা বলছে। ডেডি-আমি কান পেতে আছি- তুমি কি বেঁচে আছো? ছোট্ট তরী ডুবে সবাই যখন সাগরের অথৈ পানিতে তুমুল জীবনসংগ্রামে ভাসছে, তুমি তোমার দু' বাহুতে তোমার এই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু সন্তানদুটোকে বাঁচানোর কি অসীম প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে। তাতে দুঃখ পেও না ডেডি। সেই জীবন মরনের সন্ধিক্ষনেও আমি তোমাকে বেঁচে থাকার একটুখানি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলাম। বলেছিলাম- প্লিজ ডোন্ট ডাই, ডেডি। ডেডি, তুমি কি এখনো শুনতে পাও আমাকে? উত্তর দাও ডেডি। সবিনয় নিবেদনে হাত কড়জোর করে বরং জানতে চাও তুমি আজ এই নির্বাক পৃথিবীর কাছে- কেন আজকের এই নির্মম পরিনতি হল আমাদের? কেনই বা আইএস-এর সৃষ্টি হল? কারা এই আইএস? কারা তাঁদের জন্ম দিল? আর কতদিন বাশার-আল-আসাদ বা আরব শেখরা প্রাসাদ দখলে থাকবে? কাদের দয়ায় পিতৃসুত্রে শেখরা যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকে ডেডি? শিয়া-সুন্নি-কুরদি কি ডেডি? কেন এই বিভাজন? কেন আমরা জন্মভুমি ছাড়া হতে চাইছিলাম? ঝাঁকে ঝাঁকে কেন সকলে দেশ ছাড়ছে? কোথায় যাবে তারা? কারা তাদের নেবে বা আশ্রয় দেবে ডেডি? এতো মানুষ কেন সাগরে ভাসছে, কেনই বা ইউরোপের দ্বীপের দিকে ছুটছে? কেনই বা ভিটে মাটি ছাড়া সাগরে ভাসা অসহায় এই মানুষদেরকে আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলো স্বেচ্ছায় নিতে এতো দ্বিধাবোধ করছে ডেডি? এই মানুষগুলো কি তাহলে মানুষ না? ওরা তাহলে কারা ডেডি- যারা আসাদ বা আরব শেখ বা তাঁদের পিছনের শক্তিধররা? আরবের সীমানার তেলের হিস্যার জন্যই কি বিশ্ব মোড়লরা শেখদেরকে রাজপ্রাসাদে টিকিয়ে রেখেছে ডেডি? জানি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলেও আমি নতুন জীবন আর কখনো ফিরে পাবো না, যেমন তুমিও আর কখনোই ফিরে পাবে না তোমার হারানো সুখী পরিবারটিকে অর্থাৎ তোমার আদরমাখা সন্তান দুটোকে এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় জননীকে, তবুও সভ্য পৃথিবীর কাছে নির্বাক হয়ে এই প্রশ্নগুলো তুলে ধরছি ডেডি। উত্তর পাবার অপেক্ষায় আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে কান পেতে শুয়ে আছি এই নিঝুম সাগর তীরে। এই অশান্ত পৃথিবী আমাকে ইহজগত থেকে ওপাড়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমি আর আসবো না ফিরে, এ আমার কেবল অভিমান নয়, ক্রোধও বটে, তুমি বরং ভাল থেকো ডেডি।

আয়লান কুর্দির এই ছবিটি আরো যেন বলে দেয় যে, সভ্যতা এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু তারসঙ্গে সভ্যতার অপমানও একেবারে পিছিয়ে নেই। সাড়া পৃথিবী আজ কেবল হিসাব-নিকাশ করছে, কে কতজন নেবে। যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে লক্ষ লক্ষ সহায় সম্বলহীন আসহায় মানুষ দেশত্যাগী হচ্ছে, সেখানে কেবল ১০ হাজার, ৩০ হাজার, ১ লাখের…..হিসাব.। সাগর ভাসা বা পাড়ি দেওয়া অভিবাসীরা কতখানি হুমকি হতে পারে তাঁদের জন্য ইত্যাদি হিসাব-নিকাশও চলছে। কি আশ্চর্য এই হিসাব নিকাশ। সমস্যার মূলে বা গভীরে কেউ যেন চোখ দিচ্ছে না- কেন এই দেশত্যাগ?

অথচ বিশ্বব্রমান্ডের সঙ্গে তুলনায় আনলে এই পৃথিবীর অস্তিত্ব একটি বিন্দুর মতো।যে বিন্দুতে ৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মানুষের বসবাস। এতো মানুষ আবার এই বিন্দুরমধ্যেই একাধিক মানচিত্র এঁকেছে। ভাগাভাগি করে নিয়েছে তাঁদের অংশ।এক একটি ভাগ বা সীমানা এক একটি দেশ, এক একটি মহাদেশ। সিরিয়া সেরকমই একটি দেশ। সেখানে ক্ষমতা ও দখল নিয়ে আজো হচ্ছে এতো টানাটানি, এতো হানাহানি। বিশ্ব মোড়লরা সেইসব হানাহানির অযাচিত রেফারি অথবা তাবেদার না হয়ে যেন নীরব বসে থাকতে পারেন না। মোড়লদের স্বার্থ যায় যেদিকে, সমাধানের পথ বাতলানো হয় সেদিকে। তাই মানুষ ও মানবতা কাঁদলেও বিশ্ব মোড়ল বা শেখদের মন যেমন গলে না, মূল সমস্যার সমাধানও হয় না।

আমরা সবাই তো মানুষ। আশরাফুল মক্লুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। ধর্মপ্রাণ মানুষগণ বিশ্বাস করে থাকেন যে, একপিতা ও একমাতা (আদম ও ইভ) থেকেই আমাদের আগমন। অথচ এক পৃথিবীতে এক হয়ে থাকতে পারছি না আমরা। বিভেদ লেগেই আছে। কখনো ধর্ম, কখনো বর্ণ বা স্বার্থ নিয়ে সংঘাত। চরম সংঘাত। সেখান থেকে হত্যা, মানবতার অবমাননা-সবকিছু চলছে, কোনোকিছুই যেন থেমে থাকছে না। অথচ ধর্মীয় বিধানগুলো মানবকুলের শৃঙ্খলার কথা বলে, মুক্তির পথ দেখায়, অপরের বিপদে এগিয়ে আসার কথা বলে। আমরা কি তা করছি? ধর্মের নামে অনেকেই করছি অধর্ম, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তা দৃশ্যমান আজ। শিশু আয়লান কুর্দির এভাবে ইহলোক ত্যাগ মানবধর্ম ও মানবিকতার গাঁয়ে যেন বড় এক কালো দাগ বা কালিমা এঁকে দিয়েছে।

আমরা যদি সৃষ্টিকর্তাকে ভয়-ই পাই বা মান্য করি, তাহলে অপরের অনিষ্ঠ কখনোই হতে দিতে যেমন পারি না তেমনি নিজেরাও অমানুষ হতে পারিনা, অন্যের দুর্যোগে বা দুঃসময়ে সহায়তার হাত না বাড়িয়ে দিয়েও থাকতে পারিনা। আমাদের সে মানবিকতা আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? সাগর তীরের শিশু আয়নাল কুর্দির নিথর দেহের কান পেতে শুয়ে থাকার করুণ দৃশ্যটি এটাই কি বলে দেয় না যে, আমরা মানবতার পথ হারিয়ে নিষ্ঠুরতার দিকে বেগবান হতে চলেছি?