কেন এতো ট্রাজেডি, এ দায়ভার কার?

মোঃ রওশন আলম
Published : 4 Oct 2015, 06:36 PM
Updated : 4 Oct 2015, 06:36 PM

হজ আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের পাঁচটি স্তম্ভের মদ্ধে একটি। এই ফরজ কাজটি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে শারীরিক ও আর্থিক উভয় ক্ষেত্রে সক্ষম ধর্মপ্রাণ মুসলিমগন তাই সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন কর্নার থেকে পবিত্র মক্কা নগরীতে গিয়ে হাজির হন। বিভিন্ন সময়ে সেখানে সন্মানিত হাজীগণ ছোট বড় নানান দুর্ঘটনারও সন্মুখিন হয়ে থাকেন। অনেকে তাতে প্রাণ হারান, আবার পঙ্গুত্বও বরণ করেন। যেমন এ বছরের হজ্জ চলাকালীন সময়ে দুটি বড় দুর্ঘটনার খবর আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। তার একটি হচ্ছে- (১) গত ১১ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার একটি অরক্ষিত কন্সট্রাকশন ক্রেন মক্কা নগরীর গ্র্যান্ড মস্কের উপরে হঠাৎ আছড়ে পড়ে। তাতে ১১১ জন হজ্জ পালনরত হাজী অকালে প্রান হারায় ও ৩৯৪ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই তথ্যটি এখন আর অজানাও নয়। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা ভিডিও ক্লিপসহ ইতিমধ্যে প্রচারিতও হয়েছে। কন্সট্রাকশন কাজে নিয়জিত ফার্মটির নাম ছিল- সৌদি বিনলাদেন গ্রুপ। দুর্ঘটনাটি ঘটার পর পরই সৌদি কর্তৃপক্ষ বিনলাদেন গ্রুপের সব একটিভিটি বন্ধ করে দেয় এবং কন্সট্রাকশন ফার্মের একজিকিউটিভ লেভেলের কর্মকর্তাদের দেশত্যাগ সাময়িকভাবে বাতিল করে দেয়। তদুপরি আহত নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণেরও অঙ্গীকার করেন। (২) উপরোক্ত ঘটনাটির ঘা শুঁকাতে না শুঁকাতেই প্রায় দু'সপ্তাহের মাথায় গত ২৪শে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মক্কা নগরীর মিনাতে আরেকটি মর্মবিদারক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তাতে ৭১৭ জন হাজী পদদলিত হয়ে অথবা অধিক তাপমাত্রায় ভিড়ের চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে (সাফোকেশন) প্রাণ হারায়। আহত হয় অন্তত ৮৫০ এর উপরে। যদিও এই সংখ্যা আরো অধিক বলে অনেকেই আশংকা করেছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হতাহতের আত্মীয়স্বজনগন যেমন শোকার্ত হয়েছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও হয়েছেন নির্বাক। কষ্টে শোকাতর ও হতবিহল অনেকেই তাই বলেছেন যে, কেন এতো ট্রাজেডি, কারাই বা দায়ী? হজ আয়োজক সৌদি কর্তৃপক্ষের হজ্জ ব্যবস্থাপনায় কোথাও কি কোনো ফাঁকফোকর রয়েছে কিম্বা অদক্ষতা বা খামখেয়ালীপনা?

এরূপ প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক নয় এই কারণে যে, এ বছরই শুধু নয়, অতীতেও অনেক হাজি নানাবিধ দুর্ঘটনায় সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন। গত ২৫ বছরের দিকে একটু তাকালেই তার একটি পরিসংখ্যান জানা যাবে। যেমন, ২০০৬ সালে শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতে গিয়ে ৩৬০ জন হাজি পদদলিত হয়ে প্রাণ হারায়। সেবছর হজ্জ শুরুর ঠিক একদিন আগে মসজিদে হেরেমের ঠিক পাশের ৮ তলা একটি আবাসিক হোটেল ধসেও আরো ৭৩ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। এর আগে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২০০৪ সালেও ২৪৪ জন, ২০০১ সালে ৩৫ জন, ১৯৯৮ সালে ১৮০ জন, ১৯৯৭ সালে ৩৪০ জন (আহত দেড় হাজার), ১৯৯৪ সালে ২৭০ জন, এবং ১৯৯০ সালে ১৪২৬ জন হাজি অকালে তাঁদের জীবন হারিয়েছেন (সূত্রঃ নিউইয়র্ক টাইমস, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫)।

দীর্ঘদিন যাবৎ-ই দুর্ঘটনাগুলি ঘটে আসছে বার বার। ধর্মীয় অনুভূতির কারণে বিভিন্ন দেশ তা বরাবরই চেপে যায়, প্রতিবাদ তেমন করেন না (এ বছর ইরানের কথাটা অবশ্য ভিন্ন, তারা প্রতিবাদ ও তদন্তের দাবী ব্জানিয়েছে)। সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা যদি থেকেও থাকে সেদিকে কেউ জোড়ালোভাবে অঙ্গুলি তোলেন না, কোনো দেশই না। বরং অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে থাকেন যে, এতো বিপুল সংখ্যক হাজীদের ব্যবস্থাপনা করা চাত্তিখাতি কথা নয়। এই বলে তারা বরং সৌদি কর্তৃপক্ষকে এক ধরণের দায়মুক্তি দেওয়ার-ই প্রয়াস চালান- যা বড়ই অমানবিক। কিন্তু বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন তারা কখনো তোলেন না যে, অতিথিকে আপ্যায়ন বা খেদমত ঠিকমতো করতে না পারলে তাকে দাওয়াত দেওয়ার দরকারটা কি? হয়েছে এমন যে, ঘরে আয়োজন আছে মাত্র ১০ জনের, অথচ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে ৩০-৪০ জন, তাতে অতিথিদের পেটের ক্ষুধা যেমন মিটবে না, তেমনি ক্ষুধার্ত পেট নিয়েই তাঁদেরকে চলে যেতে হবে। অতিথির তো জানার কথা নয় যে আয়োজকের ঘরে চাল নাই, ডাল নাই, মাংস বা বিরিয়ানি তো দূরের কথা। তেমনি সৌদি কর্তৃপক্ষেরও তো এটা আজানা থাকার কথা নয় যে, কত লাখ হাজির আয়োজন করার সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে বা কত লাখের নিরাপত্তা দেবার কেপাসিটি তাঁদের রয়েছে? এবার ২০ লাখ হাজীদেরকে তারা ভিসা প্রদান করেছেন হজের জন্য। তাতেই যা ঘটে গেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! অথচ শ্রুতি আছে যে, ৩০ লাখ হাজিদেরকে তারা এবার ভিসা দিতে চেয়েছিলেন। হাজিদের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে হয়ত ডলার ইনকামের একটা মধুর সম্পর্ক রয়েছে। তাতে ধর্মপ্রাণ হাজিদের প্রাণ গেলেও কর্তৃপক্ষের হাতে ডলার তো আসছে, দায়ভার নেবার ফুসরৎ কোথায়? শুধু ডলার আর ডলার। সেলুকাস এ পৃথিবী!

 
কিন্তু এই ডলার সঞ্চয় কি সবার জন্য এতো সহজ? বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের হাজীদের অবস্থা থাকে বেশ নড়বড়ে- অর্থনৈতিকভাবে, শারীরিকভাবেও। তবে মনে থাকে তাঁদের প্রচুর শক্তি, অদম্য বলা যায়। একবার জিকির উঠলে তাই তাদেরকে আর থামানো যায় না। হজে তারা যাবেন-ই। সাড়া জীবনের সঞ্চয় থেকে তিল তিল করে পয়সা বাঁচান তারা। অথচ হাজীদের সেই সঞ্চিত ডলারের অনেকটায় চলে যায় যাদের ঘরে, সেই সৌদি কর্তৃপক্ষ বলতে গেলে বার বারই হাজীদের জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে অসমর্থ হচ্ছেন, প্রাণহানি ঘটছে প্রায় বছরই। আর কত বছর তাহলে এভাবে চলতে থাকবে? দায়ভার? বিবেকের কাঠগড়া কি আজ শুন্য?

এবার মিনাতে যেদিন ৭১৭ জন হাজি নিহত হলেন (আহত ততোধিক), সেদিন সৌদি কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন যে, হাজিরা সে সময় গাইডলাইন মেনে পথ চলেননি, তাই এই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি (বড়ই নির্মম অভিযোগ- যারা মরলেন তারাই কিনা দোষের কাঠগড়ায় উঠলেন)। অথচ এমন অভিযোগ তো চাউর হয়ে উঠছে যে, সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ সালমান আল সৌদ (সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের পুত্র) তার বিশাল সাগরেদ এবং সেনা ও পুলিশের গাড়িবহর নিয়ে হঠাৎ করেই সেদিন হজ্জ জমায়েতে যোগ দিতে এসেছিলেন। তার এই খামখেয়ালীপনার জন্যই হাজীদের পথ চলাচলে মারাত্মক যে বিঘ্ন ঘটেছিল এবং আকস্মিক প্যানিক ও হুড়োহুড়ির সৃষ্টি হয়েছিল, ফলে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে এতো হাজীর জীবন ঝরে যায়।

বিজ্ঞান এগিয়েছে, টেকনোলজি এগিয়েছে, দক্ষ লোকের সংখ্যাও বেড়েছে। যেমন, ক্রাউড ডাইনামিকস এন্ড ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্টরা একটি ঘন জটিল পরিবেশেও বিপুল সংখ্যক মানুষের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে ঘিরে ক্রাউডদেড় মুভমেন্ট/গতিবিধি কিরূপ হতে পারে অর্থাৎ কি করিলে সেখানে কি ঘটিবে- এককথায় আগাম "কজ ও ইফেক্ট" তারা নির্ধারণ করে থাকেন। এসব স্পেশালিষ্ট বা এক্সপার্টের অভাব যেসৌদি কর্তৃপক্ষের রয়েছে তা নয়।তবে এক্সপার্টদের পরামর্শ কতটা নিখুঁতভাবে ইমপ্লিমেন্ট করা হয় সেখানে, সেটা মুখ্য।

প্রসঙ্গত, আমার বয়স্ক মাতাপিতা দু'জনেই এবার পবিত্র হজ পালনে গিয়েছিলেন। তারা ২রা অক্টোবর ফিরেও এসেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌। বয়স বেশি বিধায় বাংলাদেশ থেকে তারা সেখানে বেশ আগের দিকের ফ্লাইটেই গিয়েছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা আমরা করেছিলাম। "তাঁরা কেমন আছেন এবং তাঁদের কিরূপ হাল হকিকত সেখানে"- এরূপ একধরনের আতংক সর্বদায় আমাদের মাথার উপরে ভর করে ছিল বিশেষ করে ডেডলি দুর্ঘটনাগুলো ঘটার কারণে। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমার এটুকু বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না যে, এবারের হজ্জ পালনরত যে দুই মিলিয়ন বা তার অধিক হাজী সাড়া দুনিয়ার বিভিন্ন কর্নার থেকে সেখানে জমায়েত হয়েছিলেন, তাদের পরিবার-পরিজন কিরূপ আতংকেই না দিনাতিপাত করেছিলেন এবার?

আমাদের সমাজের অনেক মানুষই আছেন যারা ইচ্ছে থাকা সত্তেও শারীরিক ও আর্থিক উভয় সংকটের কারণে হজে যেতে পারেন না। আবার অনেকেই আছেন যারা সামর্থ্য হওয়া সত্তেও হজ্জ পালনে ব্রত হয়না। অন্যদিকে সমাজের যে স্বল্প সংখ্যক মানুষ ইহজগতের লোভ লালসা বা জাগতিক ত্যাগ স্বীকার করে হজ পালনে ব্রত হন এবং পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফাত ময়দানে গিয়ে আল্লাহর নিকট সমর্পিত হন, তারা আমাদের সমাজে বড়ই শ্রদ্ধেয় ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসাবেই পরিগণিত হন। হাজীগণ হজ্জ শেষে স্ব স্ব পরিবারের কাছে পুনরায় ফিরে আসবেন সেই প্রত্যাশা নিয়ে তাঁদের মুখপানের দিকে অধীর আগ্রহ সহকারে ক্ষণ গুনে থাকি আমরা। তাঁদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক যা কারো নিকটই কাম্য নয় বিশেষ করে তা যদি হয় হজ্জ অব্যবস্থাপনার কারণে। সৌদি কর্তৃপক্ষ আর কত বছর এসব অস্বাভাবিক মৃত্যু হতে দিবেন বা মৃতের দায়ভার এড়িয়ে চলবেন, এর জবাব কি জানা যাবে কখনো কারো কাছে?