ধর্মান্ধতা ও ধর্মবিদ্বেষের সাঁড়াশিতে মানবতার ত্রাহি মধুসূদন

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 17 May 2015, 05:01 AM
Updated : 17 May 2015, 05:01 AM

ধর্ম হলো বিশ্বাস– পাপ ও পূণ্যের বিশ্বাস, লৌকিকতা ও অলৌকিকতার বিশ্বাস, নৈতিকতা ও অনৈতিকতার বিশ্বাস, বিশ্বাসযোগ্যতায় বিশ্বাস আবার অবিশ্বাসযোগ্যতায়ও বিশ্বাস; আনুগত্য– বিশ্বাস, প্রার্থনা ও অনুসরণের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য, অবতারগণের প্রতি আনুগত্য, প্রচারকগণের প্রতি আনুগত্য আর অনুচরগণের প্রতি আনুগত্য; লিপিবদ্ধ বা অলিখিত জীবন বিধান-ইহজাগতিক সুখ-শান্তি লাভের উপায়, স্বর্গালোকে সুরক্ষা লাভের উপায়, স্রষ্টা ও সৃষ্টির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উপায়, বিশ্বাস ও আনুগত্যের মোড়কে আবদ্ধ মানবিকতার নির্দেশমালা; রীতিনীতি– ঐ বিধান অনুযায়ি বিশ্বাস লালন-পালনের ঐতিহ্যগত ক্রিয়াকলাপ, ঐ আনুগত্য প্রদর্শনের শৃঙ্খলিত সামষ্টিক কর্মপন্থা, এবং কর্ম- স্রষ্টার সন্তুষ্টিতে ও সৃষ্টির কল্যাণে কর্ম, বিশ্বাসের কর্ম, আনুগত্যের কর্ম ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে জীবন বিধান নির্দেশিত কর্ম। ধর্মের অস্তিত্ত্ব থাকে বিশ্বাস ও আনুগত্যে এবং প্রথাগত রীতিনীতির মাধ্যমে তা প্রকাশ ঘটে আস্তিক বা ধার্মিকদের গোষ্ঠীগত সার্বিক কর্মকাণ্ডে।

অপরদিকে, নাস্তিক্যবাদ হলো উত্তরবিহীন যৌক্তিক প্রশ্ন সম্বলিত ভাবাদর্শ– স্রষ্টার অস্তিত্ত্বের দর্শন নিয়ে প্রশ্ন, স্রষ্টার অবতারগণের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন, অলৌকিকতা নিয়ে প্রশ্ন, ধর্মীয় জীবন বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন; বদ্ধমূল সংশয়– ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সংশয়, ধর্মীয় আনুগত্যের যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় ও ধর্মীয় জীবন বিধান নির্দেশিত রীতিনীতি সম্বলিত ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে সংশয়; সংশয়জাত অবিশ্বাস– স্রষ্টায় অবিশ্বাস, স্রষ্টা-সৃষ্টির সম্পর্কে অবিশ্বাস ও অবিশ্বাসযোগ্য সকল বিষ্ময়ে অবিশ্বাস; বিশ্বাস– অবিশ্বাসে বিশ্বাস, স্রষ্টার বিপরীতে প্রাকৃতিক জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বিশ্বাস, প্রার্থনার বিপরীতে সেবায় বিশ্বাস, অলৌকিকতার বিপরীতে যুক্তিবাদীতায় বিশ্বাস, ধর্মীয় রীতিনীতির বিপরীতে মানবতায় বিশ্বাস; এবং কর্ম– প্রার্থনায় স্রষ্টার সন্তুষ্টির পরিবর্তে জ্ঞানের পূজা ও স্বর্গালোকে সুরক্ষার পরিবর্তে ইহজীবনের সেবামূলক কর্মকাণ্ড। নাস্তিক্যবাদের অস্তিত্ত্ব থাকে অবিশ্বাসের বিশ্বাসে ও ঐ বিশ্বাসের আনুগত্যে এবং তা প্রকাশ ঘটে প্রথাবিরোধী রীতিনীতির মাধ্যমে নাস্তিকদের ভিন্ন ভিন্ন কর্মকাণ্ডে।

আস্তিক বা ধার্মিক ও নাস্তিকগণ উভয়ই বিশ্বাসী ও পূজারি। ধার্মিকেরা স্রষ্টায় বিশ্বাসী, নাস্তিকেরা স্রষ্টাহীনতায় বিশ্বাসী। ধার্মিকেরা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করে, পক্ষান্তরে, নাস্তিকেরা যুক্তিবাদিতায় বিশ্বাস করে। এক পক্ষ স্রষ্টার আরাধনা করে, অন্যপক্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূজা করে, মানবতার পূজা করে। ধর্ম যুক্তি-তর্কের অনেক ঊর্ধ্বে প্রথাগত এক পরম বিশ্বাস বলে ধর্ম সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না বা দেয় না বা দিতে পারে না। উত্তরহীন ঐ সকল প্রশ্ন ধীরে ধীরে সংশয়ের জন্ম দেয়, সংশয় থেকে জন্মে অবিশ্বাসে বিশ্বাস- নাস্তিকতা। আর সব ধর্মের মতো নাস্তিকতাও একটি ধর্ম, অবিশ্বাসে গড়ে ওঠা বিশ্বাসের ধর্ম। ধর্মেই এর জন্ম বলে এটি কখনো ধর্মের উপরে যেতে পারে না। জন্মসূত্রে মানুষ কোন না কোন ধর্মে আস্তিক এবং ধর্মের দুর্বলতার কারণে সে নাস্তিকে রূপান্তরিত হয়। নিয়মিত দাড়ি-গোঁফ-নখ না কাটলে মানুষ যেমন বন্য হয়ে ওঠে, তেমনিভাবে অযত্নে লালিত ধর্ম বিশ্বাসের নিরুত্তর মতবাদ থেকে নাস্তিক্যবাদের জন্ম হয়।

ধর্মের পদসোপানে যেমন ধার্মিকের নীচে থাকে ধর্মভীরু, তেমনি নাস্তিকতার ক্ষেত্রে থাকে সংশয়বাদী। ধর্মভীরুরা ধর্মের বিতর্কিত প্রশ্নকে ভয় পান, উত্তর দিতেও ভয় পান। এরা চাঁদে কারো মুখের ছায়াকে বিশ্বাস করে না, তবে এর বিরুদ্ধবাদকে ধর্মচ্যুতি বলে মনে করে। সংশয়বাদীরা সন্দেহের দোলাচালে দুলতে থাকে- তাঁরা ধর্মকে বিশ্বাস করে না আবার নাস্তিকতাকেও ভয় পায়। এরাও চাঁদে কারো মুখের ছায়াকে বিশ্বাস করে না, তবে সামাজিক সুখ-শান্তি-শৃঙ্খলার দায়বদ্ধতায় উদ্ধত প্রতিবাদকে যৌক্তিকতার মাপকাঠিতে করণীয় বলে ভাবতে পারে না। মধ্যবিত্তের মতো আমাদের সমাজে ধর্মভীরু ও সংশয়বাদীদের সংখ্যাই বেশী।

সমাজে ধর্ম ও নাস্তিকতার যমজ বেজন্মা রয়েছে- ধর্মের বেজন্মা ধর্মান্ধ আর নাস্তিকতার ধর্মদ্বেষী। এরা ধর্মের ক্যান্সার, নাস্তিক্যবাদের টিউমার। এরা সমাজের ক্ষত, রাষ্ট্রের অসহায়ত্ব। এক পক্ষ কলমের মাথায় সূচ বসিয়ে ধর্মের পশ্চাৎদেশ রক্তাক্ত করছে, আরেক পক্ষ চাপাতি দিয়ে রক্তের বিনিময়ে মস্তক কেড়ে নিচ্ছে। একজন ভূমিকম্পকে ধর্ম দ্বারা ব্যাখ্যায়িত করছে আর অন্যজন অবিশ্বাসের বিষাক্ত দাঁত দিয়ে বিশ্বাসের ধমনী কামড়ে ধরছে। ধর্মান্ধরা স্বীয় ধর্মকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণের জন্য, অন্য ধর্মের উপরে নিজ ধর্মকে আসীন করার জন্য, নিজ ধর্ম দ্বারা অন্য ধর্মকে প্রতিস্থাপনের জন্য মরিয়া হয়ে গেছে; অন্যদিকে ধর্মবিদ্বেষীরা নিজের যুক্তি দিয়ে ধর্মকে হীন প্রতিপন্ন করার জন্য, নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ঘাড়ে চাপানোর জন্য, নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করে সস্তা প্রচার লাভের জন্য বারংবার নিরীহ ধর্মকে আঘাত করে চলেছেন। এরা ভুলে গেছে এখনও বিশ্বের ৮৪ শতাংশ (৫.৮ বিলিয়ন) মানুষ কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস করে, ভুলে যায় বিশ্বে কোন ধর্মই এককভাবে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পৌঁছুতে পারেনি, অর্থাৎ, অবিশ্বাসে বিশ্বাসীরা এখনও অতি নগন্য এবং পৃথিবীতে কোন ধর্মেরই একক কোন আধিপত্য নেই।

আস্তিক্য ও নাস্তিক্যের মাঝে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্ম নিরপেক্ষতা হলো এমন একটি মতবাদ, চিন্তাধারা ও বিশ্বাস যা কোন ধর্মাশ্রিত বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা বা পবিত্র-অপবিত্রতার দায়ভার নিয়ে গড়ে ওঠে না। বায়ুর ধর্ম, জলের ধর্ম, সূর্যের ধর্ম ধর্ম নিরপেক্ষতার ধর্ম। এদের কাছে সমগ্র জাতির একটি ধর্ম, মানব কল্যাণের ধর্ম। ব্যবহারিক অর্থে, ধর্ম নিরপেক্ষতা সমাজের অন্তর্গত সব মানুষের সকল ধর্মের সাম্যাবস্থা নির্ধারণ করে ও ধর্মের ভিত্তিতে শ্রেণিবিণ্যাস রোধ করে। তাই অন্য যে কোন ধর্মের মতো নাস্তিক্য ধর্মও সমাজে টিকে ছিল, আছে, থাকবে। অনেকে এক ও অভিন্ন মনে করলেও ধর্ম নিরপেক্ষতা নাস্তিক্যবাদ নয়, হতে পারে না।

সাম্প্রতিক একটি প্রবণতা লক্ষণীয়- নাস্তিক্যবাদের মোড়কে ধর্মবিদ্বেষকে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে চালিয়ে দেয়া। এরই লেজে ঝুলতে থাকে আরো কয়েকটি ধারণা- ধার্মিক মানে ধর্মান্ধ আর ব্লগার মানে নাস্তিক, নাস্তিক মানে মুক্তমনা, প্রগতিশীল, বিজ্ঞান-মনষ্ক। যেমন কিছু নাস্তিক ব্লগার হলেও সব ব্লগার নাস্তিক নয়, তেমনি সব ধার্মিক ধর্মান্ধ নয়। যেমনিভাবে ইসলামী বই হলেই জিহাদী বই হয়ে যায় না, তেমনি ধর্মদ্বেষী হলেই মুক্তমনা, বিজ্ঞান-মনষ্ক নাস্তিক হওয়া যায় না। কারণ 'ধর্মহীন বিজ্ঞান খোঁড়া, আর বিজ্ঞানহীন ধর্ম অন্ধ' (আলবার্ট আইনস্টাইন)।

আমরা ধামির্ক চাই, ধর্মান্ধ নয়; নাস্তিক চাই ধর্মদ্বেষী নয়।