ভূত রহস্যঃ ভীতুদের পড়া নিষেধ!

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 19 June 2015, 09:24 AM
Updated : 19 June 2015, 09:24 AM

শুরুতেই বিষয়টি পরিস্কার করে নেয়া ভালো যে আজকের এই লেখাটি জ্বীন নিয়ে নয়, ভুত নিয়ে।তাই প্রথমে জ্বীন ও ভুতের মাঝে একটি সূক্ষ্ণ রেখা টেনে নেয়া প্রয়োজন।পবিত্র কোরানের ৭২তম 'সূরা জ্বীন' ও ১১৪তম 'সূরা নাস' এ জ্বীনের অস্তিত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। মানুষের ন্যায় জ্বীন জাতিও আল্লাহ্তা'লার সৃষ্টি যারা হযরত আদম (আঃ) এর আগমনের ২০০০ বছর পূর্ব থেকেই পৃথিবীতে ছিল এবং এখনো তাদের অস্তিত্ব রয়েছে বলে বিশ্বাস বিদ্যমান।  জ্বীন জাতির আদি পিতা (আবূল জিন্নাত) সামূমকে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আগুন থেকে সৃষ্টি করেন। জ্বীনরা আগুণের তৈরী হলেও এরা মূলত আগুন নয়। অন্যদিকে, ভূত হলো কোনো মৃত ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা বা অপচ্ছায়া যা পৃথিবীর মায়ার বাঁধনে স্বর্গ-নরকের মাঝখানে লটকে থাকে।ভুত বিষয়ে লোকে এমনটাই বিশ্বাস করে যে, কোনো কোনো আত্মা প্রাণির শরীর থেকে বের হওয়ার পরও তা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। এক কথায়, শরীরহীন আত্মাই হচ্ছে ভূত। সুতরাং, জ্বীন ও ভুত দুটি ভিন্ন মতভেদ ও বিশ্বাস- এদের মাঝে কোন সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

ভুতের কিন্তু লিঙ্গভেদও আছে। সকলের সাধারণ নাম 'ভুত' হলেও 'ভুত' হচ্ছে পুরুষ এবং 'পেত্নী' হচ্ছে নারীর অশরীরি আত্মা! ভুতের রাজ্যে নারী ভুতের সংখ্যাই বেশী-পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মৃত্যুর পরেও নারীকে শান্তি দেয়নি, পেত্নী নামক ঘৃণ্য এক চরিত্রে তাকে চিত্রায়ন করেছে। শতকরা আশিভাগেরও বেশী ভুতের গল্পে নারীদের প্রাধান্য রয়েছে। মৃত আত্মার প্রকারভেদে পেত্নীদের নামকরণ করা হয়- 'শাকচুন্নী' (সে সব বিবাহিত মেয়েদের আত্মা যারা তার স্বামীর পরকীয়ার জন্য জীবন দিয়েছে), 'শাকিনী' (সে সব মেয়েদের আত্মা যারা বিয়ের পরে অসুখে বা নির্যাতনে পড়ে আত্মহত্যা করেছে), 'মোহিনী' (সে সব মেয়েদের আত্মা যারা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা বিয়ের আগেই আত্মহত্যা করেছে), 'ডাকিনী' (সে সব মেয়েদের আত্মা যারা অসময়ে কোনো কারনে মারা গেছে। সেই অর্থে মোহিনী, শাকিনী বা শাকচুন্নী সবাই ডাকিনীর অন্তর্ভুক্ত), 'ডাইনী' (অত্যন্ত সুন্দরী মেয়েদের আত্মা), 'কাঁদারমা' (এরা জঙ্গলে বসে করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে ) এবং 'চোরাচুন্নী' (সে সব মেয়েদের আত্মা যারা জীবনে চোর ছিলো)। মৃত পুরুষ আত্মাদের মধ্যে আছে 'মামদো' (মুসলমান পুরুষের আত্মা), 'ব্রক্ষ দৈত্য' (হিন্দু ব্রাক্ষনদের আত্মা), 'দৈত্য' (শারীরিক ভাবে ভীষন শক্তিশালী পুরুষ আত্মা), 'বেঘোভূত' (বাঘের আক্রমনে মৃত্যুবরণ করেছে এমন মানুষের আত্মা) এবং 'চোরাচুন্না' (পুরুষ চোরের আত্মা)। এছাড়া রয়েছে 'নিশী' যারা মানুষকে বশ করে নিয়ে যায়; 'আলেয়া' যারা জলাশয়ে বসবাস করে মাঝি বা জেলেদের ভয় দেখায়; 'পিশাচ/পিশাচী' ও 'রাক্ষস/রাক্ষসী' হলো তারা যারা নির্দয়, নিষ্ঠুর বা নীচ প্রকৃতির পুরুষ/নারীর আত্মা; 'কানাভুলো'রা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে; 'পেঁচাপেঁচি'রা জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও শিকারের দেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়; 'মেছোভূতে'রা ভূতেরা মাছ ভালোবাসে ও 'গেছোভূতে'রা গাছে বসবাস করে; 'দেও'রা লোকজনকে পানিতে ফেলে ডুবিয়ে মারে; এবং 'কবন্ধক' যাদের শরীরে মাথা থাকে না। সত্যি, আমরা পারিও বটে!!

যুগের পর যুগ ধরে মানুষ কেন ভুতে বিশ্বাস করে যাচ্ছে? এর পেছনে বেশ কতগুলো কারণ রয়েছে। এ সকল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বংশ পরম্পরায় আবর্তিত লৌকিক কাহিনী, রয়েছে ভুতসাহিত্য এবং সেলুলয়েডে চিত্রায়ন। পৃথিবীর সকল দেশের সকল ভাষার সাহিত্যে ভুতের অস্তিত্ত্ব রয়েছে, হলিউড থেকে টালিউড সব রূপালি পর্দাতেই ভুত নিয়ে অদ্ভূতুরে সব কল্পকাহিনী চিত্রায়ন করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভুতবিশ্বাসী সকল মানুষের কাছে ভুতের অস্তিত্ত্ব, চেহারা, আকার-প্রকৃতি, চালচলন সবই প্রায় একই রকমের। আর এই অভিন্নতাই ভুতকে সকল যুগের, সকল দেশের, সকল সমাজের, সকল শ্রেণির মানুষের কাছে ভুতে বিশ্বাসের ভিত্তিকে যুগ-যুগান্তরে মজবুত করে তুলেছে। অশরীরীর প্রতি মানুষের একটি চিরন্তন শ্রদ্ধাভক্তিমিশ্রিত ভীতি আছে যা মানুষের কাছে ভুতের অস্তিত্ত্বকে প্রায় সত্যে রূপান্তর করে ফেলেছে। তাই বিশ্বাস করুক বা না করুক, ভুতের অস্তিত্ত্ব নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করতে চায় না। এটাই ভুত মামাদের আসল শক্তি।

ভুতের গল্প হোক, সাহিত্য হোক বা চলচ্চিত্রই হোক না কেন ভুতের চরিত্র চিত্রায়ন একই রকম। এ সকল কাহিনীতে সবসময় কয়েকটি বিশেষ আবশ্যকীয় উপাদান থাকে- নির্জনতা, একাকীত্ব, পরিবেশ বা স্থান, সময়, অবয়ব-পোশাক, চলাফেরা, খাবার, রূপান্তর ক্ষমতা ও তা দেখা/বোঝার জন্য সক্ষম প্রাণি, অতীত ঘটনা ইত্যাদি। কালে কালে ভৌতিক চরিত্রের এ সকল অভিন্ন চিত্রায়ন আমাদের সবার মনের মধ্যে কোনো এক সুপ্ত ভুত পুষে রেখেছে। মানুষ যদি এমন কোনো অবস্থানে উপনীত হয় যখন তার ভৌতিক জ্ঞানের প্রতিটি বা অধিকাংশ উপাদান খাপে খাপে মিলে যায় তখন মনের মধ্যেকার সেই সুপ্ত ভুতটি আমাদেরই অজান্তে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়; আর আমরা সেই ভুতের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ি। যে ব্যক্তির ভুত বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই বা যার পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে ভুত অনুধাবন করার মতো শক্তি নেই সেই ব্যক্তি কখনো ভুত দেখে না, ভুতের ভয় পায় না। তাই আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, কেবল ভুত বিষয়ে জ্ঞান থাকলেই মানুষ ভুতের ভয় পায়, না থাকলে পায় না।

কীভাবে মানুষের মনে ভুতের সুপ্ত জীবনীর সূত্রপাত ঘটে? এই আলোচনার আগে আমরা ভুতকে দুটি দলে ভাগ করে নেই- গেঁয়ো ও শহুরে ভুত। প্রথমে গেঁয়ো ভুত। গ্রামের সহজ-সরল প্রতিটি মানুষের মনে ছোটবেলা থেকেই সুপ্ত ভুতের জিন রয়েছে। সেজন্য বেঁচে থাকার জন্য, চরে বেড়ানোর জন্য এরা গ্রামকেই প্রধান আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে। এখানে তাদের নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরী করার প্রয়োজন নেই। গল্প, সাহিত্য বা চলচ্চিত্র আমাদের মনের মধ্যে সুপ্ত যে ভুতটি জন্ম দিয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া যেতে পারে। প্রতিটি গ্রাম্য ভুতের কিছু এজমালি বাসস্থান থাকে, যেমন- শ্মশান, গোরস্তান, বাঁশঝাড়, জঙ্গল, বড় তাল/বেল/আম/বট/তেঁতুল/দেবদারু/শেওড়া/অশ্বত্থ (ভিন্ন ভিন্ন গাছ হতে পারে, তবে সেগুলো অবশ্যই প্রাচীন ও বিশাল সাইজের) গাছ, বিস্তীর্ণ ফাঁকা প্রান্তর, রেললাইন, পোড়ে বাড়ি/মন্দির (ভুতের গল্পে মসজিদ, গির্জার কোন স্থান নেই)। গল্পের সময় হবে বেলা দ্বি-প্রহর, মধ্য রাত থেকে ভোর রাতের পূর্ব পর্যন্ত, ঝড়ের রাত বা অমাবস্যার রাত। অবয়বের মধ্যে ভুতের সাইজ সবময় খুব বড় হবে। এত বড় হবে যে, পা দেখা গেলে তার মাথা দেখা যাবে না। পায়ের ব্যাপারে আরো একটু বিশেষত্ব থাকবে আর তা হলো পায়ের পাতা হবে উল্টানো। মাথার চুল থাকবে খুব লম্বা লম্বা, যে চুল সারা মুখ ঢেকে রাখবে আর যার কারণে তাদের মুখ দেখা যাবে না। হাতে-পায়ের নখ থাকবে বড় বড় এবং খুব ধারালো। মুখমণ্ডল থাকবে বিকৃত, বিভৎস। দাঁত থাকবে মূলোর সাইজের, সাদা ফকফকে, চোখ থাকবে মণিহীন টকটকে লাল বা সাদা রঙের এবং এরা কথা বলবে ন্যাকা সুরে। কিছু ভুত সরাসরি কঙ্কালের তৈরি, গায়ে-গতরে চামরা-নাক-চোখ-মুখের বালাই নেই, এরা হাঁটলে খটখট, ঝনঝন শব্দ হবে। এবার আসা যাক পোশাকের বিষয়ে। ভুতদের গায়ের রঙ সাধারণত কালো হয়। মানুষ মরে গেলে সাদা পোশাকের ব্যবহার হয় আর সেজন্যই কালো গায়ের রঙের কম্বিনেশনে ভুতের পোশাক প্রধানত সাদা ধবধবে হতে হবে। তবে, মাঝে মাঝে কালো পোশাকও দেখা যায়, সেক্ষেত্রে গায়ের রঙটা সাদা হওয়া বাঞ্চনীয়, কেননা সাদা-কালো কম্বিনেশন ভৌতিক আবহ সৃষ্টিতে সহায়ক। চলাফেরার বেলায় ভুতেদের হঠাৎ উদয় বা অন্তর্ধানের ক্ষমতা থাকবে, তারা শুন্যে হাঁটবে এবং খাঁড়া হয়ে গাছে উঠবে। বড় সাইজের মাছ গ্রাম্য ভুতের সবচে প্রিয় খাবার (এদের মধ্যে ইলিশ ও শোলের জনপ্রিয়তা বেশী)। কোনো এক অজানা কারণে ভুতেরা ছোট মাছ খায় না। অন্য জনপ্রিয় খাবার মানুষের মাংশ ও পানীয় হলো (মানুষের) রক্ত। অবশ্য খাবার গ্রহণের ব্যাপারটা ভুতের বিশ্বাসকে অনেক বেশী দুর্বল করে দেয়। এ পর্যায়ে ভুত আর আত্মা থাকে না, প্রাণির কাতারে এসে পড়ে কারণ আত্মার ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকার কোনরূপ যৌক্তিকতা নেই। ভুতের যেকোনো প্রাণির রূপ ধারণ করবে আর সেটা বুঝতে পেরে ডাকাডাকি করবে কুকুর, ঘোড়া, গরু ইত্যাদি। ভুতের জিন হলো তার জন্ম ইতিহাস (এ প্রবন্ধের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ পুনরায় দেখুন), সকল অপমৃত্যু {আত্মহত্যা, (ধর্ষণ করে হত্যা) হত্যা, বাসে-ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু প্রভৃতি} বা মৃতের সৎকারহীন সকল ব্যক্তির আত্মাই (অর্থাৎ, যাদের বিভৎস মৃত্যু ঘটে) ভুত রূপে জন্মলাভের যোগ্য।

এবার শহুরে ভুতের কথা বলা যাক। প্রথম দিকে শহুরে ভুতের তেমন আধিক্য না থাকলেও নগরায়নের ফলে ধীরে ধীরে এদের আগমন ঘটে। শহরে বনজঙ্গল, বড় বড় গাছ তেমন পরিমাণের না থাকায় ভুতের অবস্থান নিয়েছে বাসাবাড়িতে। পুরানো ফ্লাটের বাথরুম, স্টোর রুম, সিঁড়িঘরে বা হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে এরা বাস করে। শহরের ভুত ধোঁয়াশা টাইপের, এদের আকার-আকৃতি গ্রামের ভুতের তুলনায় ছোট ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা মানুষের রূপে অবস্থান করে।  জন্মের ইতিহাসে শহুরে ভুতের আরো একটি মাত্রা যোগ করা হয় আর সেটা হলো শিশুর ভ্রুণ হত্যা। আধুনিক সমাজে ক্রমবর্ধমান ভ্রুণ হত্যাকে রোধ করতে এ ধরণের ভুতের জন্ম দেয় সাহিত্যিকেরা। ভুতের বিবর্তন এখানেই থেমে থাকেনি, সৃষ্টি হয়েছে ভ্যাম্পায়ারড্রাকুলা যাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো অস্বাভাবিকভাবে বড় চারটি ছেদন দাঁত। এদের সাহায্যে এরা জ্যান্ত মানুষের রক্তপান করে জীবনধারণ করে এবং সূর্যের আলোর সংস্পর্ষে  আসতেই ধোঁয়ায় নিঃশেষ হয়ে যায়।  সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, কোনভাবেই যাদের অস্তিত্ত্ব থাকার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, তবুও তারা আছে আমাদের চিন্তা-চেতনায়, দিনের পর দিন লালিত হতে আমাদেরই বিশ্বাস-অবিশ্বাসে।

যদি ভুতের অস্তিত্ত্ব থাকার কোন গ্রহণযোগ্য যৌক্তিক না থাকে, তবে কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে ভুতের বিশ্বাস বদ্ধমূল হলো? এদের মধ্যে অনেকেরই স্বচক্ষে(!) ভুত দেখার ঘটনাও প্রচলিত আছে। আবার কেউ কেউ দাবী করেন তারা নাকি ভুতের সাথে সেক্সও করেছেন। গল্পের সাথে এখন এডিটেড ভুতের ভিডিও ওয়েব ভাইরালে পাওয়া যাচ্ছে। ভুতদেখা গল্পের সবচে বড় দুর্বলতা শতকরা নব্বই শতাংশের বেশী গল্পে দর্শক স্বয়ং গল্পকার যা প্রমাণের মানদণ্ডে যাচাই করা অত্যন্ত দুরূহ। তারপরেও কেন এ সকল লোকজন ভুত দেখার গল্প-কাহিনী তৈরি করে? অলস মস্তিস্কের গাঁয়ের লোকেরা তাদের উত্তরসূরীদের কাছ থেকে শোনা গল্পের অনুকরণে সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত মুখরোচকভাবে তৈরি গল্প মানুষকে শুনিয়ে মোহিত করে, নিজেদের সাহসিকতা জাহির করে। শ্রোতারা সেই গল্প অন্যের কাছে প্রচার করে, কেউ কেউ আবার সেটাকেই নিজের নামে চালিয়ে দেয়। গল্পকারের বুদ্ধিমত্তা অনুসারে এভাবে গল্পের ডালপালা জন্মে, পারিপাশ্বিকতা বৃদ্ধি পায়, ঘটনারও সংযোজন-বিয়োজন ঘটে, তারপরেও মূল ভুত গল্পে ঠিকই টিকে থাকে। যারা এসব প্রচারণা লালন করে তদের মধ্যে এক শ্রেণির লোক ভুত ব্যবসায়ী- ভুত ছাড়ানো, টোটকা, তাবিজ, পানি পড়া দেয়া ইত্যাদি যাদের জীবিকা হয়ে উঠেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, কিছু লোক সত্যিই ভুত দেখেছে- কিন্তু কীভাবে?

গল্প, সাহিত্য, লোককাহিনী, চলচ্চিত্র প্রভৃতির সাহায্যে একটি ভুত কেমন হতে পারে, কখন দেখা যেতে পারে, কোথায় থাকতে পারে, কেন কোনো স্থানে ভুত থাকা উচিত, ভুত দেখতে কেমন হওয়া উচিত… অর্থাৎ, কাল্পনিক একটি ভুতের জন্ম দেবার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সব কিছুর সম্যক জ্ঞান আমাদের অবচেতন মনে বিদ্যমান রয়েছে। শুধু প্রয়োজন মনের গহীনে ঘুমন্ত ভুতের প্রতিচ্ছবিকে বাস্তবে রূপদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। ধরা যাক, আপনি রাত সাড়ে বারোটায় (অমাবস্যা হলে জমবে ভালো) গ্রামের কোন বাস স্ট্যান্ডে নামলেন, এখন একাকী আপনাকে এক কি.মি. গ্রাম্য পথ হেঁটে বাড়ী ফিরতে হবে। পথে একটি বাঁশঝাড় আছে। ব্যাস, নিজের কল্পনায় একটি ভুতের জন্ম দেবার জন্য আপনার উপযুক্ত পরিবেশ প্রস্তুত। (যদি কোন কারণে আপনি ঐ বাঁশঝাড় নিয়ে পূর্বে কোন গল্প শুনে থাকেন, তবে পোয়াবারো, নিজে নিজে কল্পনা করে ভুতের জন্ম দিতে হবে না, বাস থেকে নামার সাথে সাথে আপনার ভুত আপনার পিছু নেবে আর বাঁশঝাড়ের কাছে দৃশ্যমান হবে।) হাঁটতে হাঁটতে বাঁশঝাড় অতিক্রম করার সময় আপনার মনে পড়বে বাশঁঝাড়ে ভুত থাকে, আপনি দ্রুত হাঁটবেন, বাতাসে বাঁশ নড়বে, সেই দিকে তাকাবেন এবং চাঁদের আলোর ঝলকে কিছু একটা চোখে পড়বে। আপনি তখন চঞ্চলমতি, অস্থিরচিত্ত, মানসিকভাবে উত্তেজিত…এটাই আপনার অবচেতন মনের ভুতের প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে প্রকট হবে এবং আপনি ভুত দেখবেন। যারা ভুত দ্যাখে তারা সবাই কমবেশী এভাবেই দ্যাখে, তারপরে জনে জনে ঘটনার বর্ণনায় সেই ঘটনার ব্যাপ্তি ঘটবে….বাড়তে থাকবে…দিনে দিনে, কালে কালে

মানুষ ভুত দ্যাখে কারণ সে ভুত সম্পর্কে জানে, মানুষ ভুত দ্যাখে কারণ যে ভুতে বিশ্বাস করে, মানুষ ভুত দ্যাখে কারণ ভুতে ভয় পায়। যারা ভুতে বিশ্বাস করে না তাদেরও অনেকেরই ভুতের ভয় আছে, তারাও একইভাবে ভুত দ্যাখে। এখন রাত প্রায় আড়াইটা, লেখাটা শেষ, সবাই ঘুমাচ্ছে, আমি একা, পানির পিপাসা লেগেছে, রান্না ঘরে অন্ধকার, ভুত নিয়ে এতো এতো আজেবাজে কথা বললাম, বেচারারা নিশ্চয় আমার ঘাড় মটকানোর জন্য পানির ফিল্টারের কাছে বসে আসে, তাই এখন আমারও ভয় করছে। ……….

পানি খেয়ে ফিরে এলাম, ভুত আসেনি, তবুও হার্টবিট একটু বেশী। বুঝলাম, ভুতের ভয়, সেটা তো দেখি আমারও আছে।এখন ঘুমাতে যাবো, এবার আমাকে নির্ঘাত বোবাভুতের হাতে পড়তে হবে। যদি কাল সকাল অব্দি টিকে থাকি দেখা হবে…………