ব্রাজিলিয় সামবা নৃত্য

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 28 July 2015, 03:13 AM
Updated : 28 July 2015, 03:13 AM

ব্রাজিলের সবচে বড় বাৎসরিক উৎসবের নাম কার্নিভাল। এটি মূলতঃ বিভিন্ন মুখোশ ও বাহারি পোশাকে সামবার তালে তালে নাচের প্যারেড। একই সাথে চলে অদম্য পানাহার ও উম্মত্ত ভালোবাসা বিনিময়ের অযাচিত বহিঃপ্রকাশ।

খ্রিস্টধর্ম মতে জেরুজালেম শহরের কালভারি নামক স্থানে যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। এই ক্রসিফিকেইশনের তৃতীয় দিনে যিশু খ্রিস্ট পুনরুত্থান লাভ করে। তাই খ্রিস্টধর্মালম্বীরা এই দিনটি ঈস্টার (ঈস্টার সানডে) হিসেবে পালন করে। এ ঈস্টারের চল্লিশ দিন পূর্বে "ধূসর বুধবার" (এ্যাশ ওয়েডনেসডে) দিয়ে শুরু হয় লেন্ট। লেন্টের এ সময়কাল খ্রিস্টধর্মালম্বীদের কয়েকটি অংশের (রোমান ক্যাথলিকস, লুথেরান, মেথোডিস্ট ইত্যাদি) জন্য মিতাচার, সংযম, অনুশোচনা তথা আত্মিক পরিশুদ্ধির সময়। এ্যাশ ওয়েডনেসডের ঠিক আগের চারটি দিন ব্রাজিলে কার্নিভালের হিসেবে পালন করা হয়।

'কার্নিভাল' শব্দটি এসেছে "carne levare" বা "carne vale" হতে যার অর্থ হলো "মাংসের বিদায়" অর্থাৎ, মাংস-মদ হতে বিরত থাকা বা মিতাচার। ব্যাপারটা এই যে, এই চার দিনে ব্যাপক আনন্দ-উৎসব ও পানাহারের মধ্য দিয়ে পরবর্তী চল্লিশ দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, যার বাস্তবিক প্রয়োগ খুব বেশী একটা আছে বলে ঠাওর হয় না। যাহোক, আবার কার্নিভালে ফিরে আসি।

কার্নিভালের সবচে বড় উৎসব এখন ব্রাজিলে হলেও এটি প্রায় তিনশ' বছর ধরে এদেশে প্রচলিত একটি বিদেশী সংস্কৃতি। এটি মূলতঃ গ্রিকদের মদের দেবতা ডায়োনিসাসের এর নামে কৃত বসন্ত উৎসব। পরবর্তীতে রোমানরা তাদের মদের দেবতা বাকুস ও কৃষি দেবীর স্মরণে আয়োজিত স্যাটারনালিয়া নামে এই উৎসবের প্রথাটি গ্রহণ করে। পরে রোমান ক্যাথলিক চার্চ স্যাটারনালিয়াকে লেন্টের পূর্ববর্তী উৎসব হিসেবে নির্ধারণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে স্যাটারনালিয়া সবার কাছে গণ নাচ, গান, বাজনা, পানাহার ইত্যাদির উৎসব হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ইটালি হতে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল ও ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।

আজকের এই কার্নিভাল উৎসবটি পর্তুগীজ উপনিবেশকারীদের হাত ধরে এনট্রুডো নামে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে শুরু হয় ১৭২৩ সালে। পরবর্তীতে ১৮৫৫ সালে গ্রান্ড সোসাইটিস নামের একটি প্যারেড এ উৎসবটিকে নতুন করে পরিচিতি ঘটায়। ব্রাজিলের তৎকালীন সম্রাটসহ ৮০ জনের একটি উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন মুখোশে, পোষাকে গান-বাজনা করে এ প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। ১৮৭০ সালে গ্রান্ড সোসাইটিসে যুক্ত হয় করডাও কার্নাভালেস্কো নামের আরেকটি দল। এরা রাজা, রাণী, ডাইনী, কৃষক, নর্তকী ইত্যাদির মুখোশে অঙ্গ-ভঙ্গি ও নাচ-গান করতো। সাধারণ কর্মজীবীদের অংশগ্রহণে ১৮৭২ সালে রাংসোস কার্নাভালেসকো নামে আরেকটি দল এ প্যারেডে অংশগ্রহণ শুরু করে। এরা মূলতঃ ছিল বিভিন্ন বাদ্য-বাজনার সমন্বয়ে গঠিত একটি অর্কেস্ট্রা। গ্রান্ড সোসাইটিসকে সাথে নিয়ে রাংসোসই এই প্যারেডে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের মধ্যে নাচ-গান ও বাজনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করে। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বন্ধ থাকা এই প্যারেড পুনরায় চালু হয় ১৯৪৭ সালে।

এবারে আসা যাক কার্নিভালের মূল আকর্ষণ সামবা নাচ (ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন) ও মিউজিক বিষয়ে। কার্নিভালের মতো সামবাও এ দেশীয় নয়। ষোড়শ শতকে পশ্চিম আফ্রিকা ও এ্যাঙ্গোলার দাসদের সাথে এ নাচ ও গান ব্রাজিলে অনুপ্রবেশ করে। পরবর্তীতে ব্রাজিলের বাহিয়া ও রিও ডি জেনিরো প্রদেশের নাচ ও গানের সংস্কৃতির সাথে মিশে গড়ে ওঠা এই অ্যাফ্রো-ব্রাজিলিয়ান মিউজিক বর্তমানে ব্রাজিলিয়ান সামবা নামে পরিচিত। ১৯২৮ সালে মাংগেরা নামে ১ম সামবা দল আবির্ভূত হয়। ১৯৩২ সালে কার্নিভালের প্যারেডের প্রতিযোগিতায় মাংগেরাসহ অন্যান্য সামবা দল যুক্ত হয়। আর ধীরে ধীরে এই সামবাই হয়ে ওঠে কার্নিভালের প্রাণ।

রিও ডি জেনিরোর "রিও বানকো" নামের এভিনিউটি ছিল কার্নিভাল প্যারেডের চিরাচরিত স্থান। ১৯৮৪ সাল হতে রিও ডি জেনিরোতে জগদ্বিখ্যাত স্থপতি অসকার নেইমারের নকশায় নির্মিত সামবাড্রোম নামক একটি প্যারেড কমপ্লেক্সে এ কার্নিভালের আয়োজন করা হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য অনেক শহরেও এ কার্নিভালের আয়োজন করা হয়।

 হয়তবা এভাবেই বিকাশ ঘটে একটি সংস্কৃতির। এক দেশ হতে অন্য দেশে, এক জাতি হতে অন্য জাতিতে, এক ধর্ম হতে অন্য ধর্মে কালে কালে সংস্কৃতি বিকশিত হয়, বিবর্তিত হয়, রূপান্তরিত হয়, পরিবর্তিত হয়। বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত প্রায় সকল সংস্কৃতির ইতিহাসেরই পিছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশের, সময়ের, জাতির, ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশগ্রহণ। ঐতিহাসিক ব্যবচ্ছেদে বাঙালী সংস্কৃতির অনেক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাসও এমনিভাবেই রচিত হয়েছে। তারপরে তা ধীরে ধীরে বিবর্তিত, রূপান্তরিত, পরিবর্তিত হয়ে হাজার বছরের আজকের এই বাঙালী সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। যেমনিভাবে কেউ জানতো না যে গ্রিসের বা ইটালির এই কার্নিভাল একদিন ব্রাজিলের প্রধান উৎসবে পরিণত হবে, তেমনিভাবে কেউ জানে না আজ থেকে শত-সহস্র বছর পরে ব্রাজিলের এ কার্নিভাল অন্য কোন দেশের প্রধান উৎসবে পরিণত হবে কিনা। যেমনিভাবে শতশত বছর আগের অবাঞ্চিত অনেক বিদেশী সংস্কৃতি আজকের বাঙালী সংস্কৃতির মূলধারায় মিশে গেছে, তেমনিভাবেই কেউ জানে না আজ থেকে শত-সহস্র বছর পরে আজকের নিন্দিত কোন বিদেশী সংস্কৃতি নন্দিত বাঙালী সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে কিনা। হয়তো করবে, হয়তো বা না।