আমাজন জঙ্গলে চারটি দিন

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 6 August 2015, 07:34 PM
Updated : 6 August 2015, 07:34 PM

আমাজন জঙ্গলে যাত্রা-প্রস্তুতি। বাক্স-পেটরা নিয়ে সবাই হোটেলের নিচে জড়ো হচ্ছিল। আমার মতো সবাই একদিন-দু'দিন আগেই আমাজোনাস প্রদেশের রাজধানী মানাউসে এসে পৌঁছেছে। ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এ প্রদেশেই আমাজন জঙ্গলের মূল অংশের অবস্থান। আয়তনে আমাজোনাস ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ প্রদেশ, আয়তন প্রায় ১৬ লক্ষ বর্গকিমি; অর্থাৎ, শুধু এই প্রদেশই আয়তনে বাংলাদেশের ১০ গুণ। যদি এই প্রদেশটি স্বাধীন কোনো দেশ হতো, তবে আয়তনে সে দেশটি হতো পৃথিবীর ১৮তম বৃহত্তম দেশ।

যাত্রার শুরুতেই এক হোচট। পরিচিত হলাম দু'জন মার্কিন পর্যটকের সাথে, তাঁরা দুই বান্ধবী- এলেন বিবলোউইটয ও সুসান তুলচিন। দু'জনই ষাটোর্ধ্ব ও কথাবর্তায় ঝানু পর্যটক। আলাপের শুরুতেই বাংলাদেশী শুনে এলেন আমার দিকে এক গুগলি ছুঁড়ে বললেন-ÒIt's amazing to see a Bangladeshi as a tourist, rather than a money machine abroad"। আমাদের সাথে ট্যুর কোম্পানির যে গাইড ছিলেন তাঁর নাম মার্সেলজ। হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই তিনি আবার তাতে ঘি যোগ করে বললেন যে তারা এখনও আমাজন জঙ্গল ট্যুরে কোনো বাংলাদেশীকে পায়নি। আমাদের সাথে আরো দু'জন মার্কিনি ছিলো-এন্থনি গ্রেনহেক ও তার জমজ বোন মারিয়া; ছিলো অস্ট্রেলিয়ান আন্দ্রে সিলভা, ডাচ টিম যিজস্ট্রা, ফরাসি হ্যান্স ফিটযারেল্ড হারি, ব্রাজিলিয়ান নাতালিয়া কারডোসো নেরেস এবং দু'জন জন করে কানাডিয়ান ও ইটালিয়ান। সবাই চুপ, কারো মুখে কোনো রা নেই। মনে হলো চুপ থেকে সবাই ঐ মার্কিনি মহিলার কথাটাই বিশ্বাস করছে। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, একটু ঢোক গিলে 'ঝান্ডু-দা'র ভাব নিয়ে তাঁকে বললাম, ÒHumm, it sounds interesting, but rather unfortunate that you are yet to travel a lot to come across many Bangladeshi tourists"। যা হোক "ওহ, রিয়েলি! দ্যাট'স ওনডারফুল" বলে তিনি হঠাৎ রণে ভঙ্গ দিলেন। পশ্চিমাদের এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে যে তারা অযথা 'তালগাছটা আমার' ধরণের তর্কে নামেন না। তর্কে সুবিধা হবে না মনে করলে তারা দ্রুত তর্কে পিছু হঠেন। হোটেল থেকে মাইক্রোবাসে আমাদেরকে প্রথমে 'রিও নেগ্রো'র (পর্তুগিজে 'রিও' মানে 'নদী' আর 'নেগ্রো' অর্থ 'কালো'; অর্থাৎ, নদীটির নাম 'কালো নদী') তীরে স্পিডবোটের ঘাট 'পোর্তো দো সেয়াজা'তে নেয়া হবে। ধীরে ধীরে আমরা সবাই মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। মুড়ির টিনমার্কা সেই মাইক্রোবাসটি প্রায় আড়াই ঘণ্টা দৌঁড়ে গিয়ে থামলো রিও নেগ্রোর পাড়ে।

সেয়াযা হলো নেগ্রো ও সলিমোয়েস নদীর সঙ্গম। এখান থেকে স্পীড বোটে আমাদেরকে এই নদী সঙ্গমের ওপাড়ে যেতে হবে। কলম্বিয়ার 'গুয়াইনিয়া' নামের স্থান দিয়ে ব্রাজিলে ঢুকেছে পৃথিবীর দীর্ঘতম কালো পানির নদী নেগ্রো। অন্যদিকে, পেরুতে জন্ম নিয়ে ব্রাজিলের আমাজোনাস স্টেটের 'তাবাচিংগা' নামক স্থান দিয়ে প্রবেশ করে 'কালো নদী'তে মিশেছে বিশ্বের অন্যতম কর্দমাক্ত নদী 'সলিমোয়েস'। তবে সবচে' আশ্চর্যের বিষয় হলো তীব্রতা, ঘনত্ব ও তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে নেগ্রোর কালো ও সলিমোয়েসের কর্দমাক্ত পানি কখনো একত্রে মেশে না। দুটি স্রোত পাশাপাশি বয়ে চলে নিরন্তর।

নদীর ওপারে স্পীড বোট যে ঘাটে থামলো সে অঞ্চলের নাম 'কারেইরো দ্য ভারযেয়া'। এ স্থানটির নামকরণে একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। 'ভারযেয়া' অর্থ 'নিম্নভুমি'। ১৯৮৭ সালে গোড়াপত্তন ঘটা এই এলাকাটির প্রায় ৯৫ শতাংশই পানিতে ডুবে থাকে বলে এটি 'কারেইরোর নিম্নভূমি'। এক ঘণ্টা সময় নিয়ে আমরা নদী সঙ্গম পার করলাম। এখান হতে মুড়ির টিন মার্কা আরেকটি মাইক্রোবাসে চড়ে আমরা আবার রওনা হলাম। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সোজা চলার পর গাড়িটি হাতের ডানে মোড় নিয়ে মেঠো পথ দিয়ে এগুতে লাগলো। অবশেষে গাড়ি থামলো মাসারিকো বা 'মশাল' নদীর তীরে। সেখানে নেমে দেখি ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রির জন্য আদিবাসীরা সারি সারি ডাব, বিয়ার, চিপসের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। যে যত পাড়লো ডাব খেতে লাগলো, আমিও। আমাদেরকে আবারও যানবাহন বদলাতে হবে, এবার ট্রলারে চড়ে ছোট্ট সেই মাসারিকো নদী বেয়ে আমাজনের উত্তর-পশ্চিমে এগুতে হবে যেখানে মাসারিকো নদী মিশে গেছে জুমা নদীতে। সেই জুমা নদীর কোন একটি স্থানের 'জুমা লজ' আমাদের গন্তব্য।

জঙ্গলের ভেতর বয়ে চলেছে নদী আর সেই নদীতে এঁকেবেঁকে চলছিল আমাদের ট্রলারটি। নদীর দু'পাড়ে ঘন জঙ্গল। নিঝুম নিস্তব্ধ চারিদিক। নাম না জানা হাজারো পাখির কলকাকলি। মাঝে মাঝে দলে দলে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে এ গাছ থেকে ওগাছে লাফাচ্ছিল মাকাকুরা ('মাকাকু' পর্তুগিজ শব্দ যার অর্থ 'বানর')। মায়ের সাথে দূরে ডাঙায় বসে রোদ পোহাচ্ছিল কুমির ছানার। দিনের আলো বোধ হয় আমাজনে প্রবেশ করতে চায় না, তাই রোদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরেও আবছা আলো-আঁধারির খেলা চলছিল আমাজনের বুক জুড়ে। জঙ্গলের প্রায় ১৫০ কিমি বুক চিরে শেষ বিকেলের দিকে আমরা জুমা লজে পৌঁছালাম। জুমা নদীর উপরে কাঠের তৈরী জুমা লজ। নীচে বয়ে চলেছে খরস্রোতা জুমা। লজের চারিদিকে নদীতে নিরাপত্তার বেষ্টনী রয়েছে। সম্ভবত কুমিরের আমক্রণ থেকে ট্যুরিস্টদের বাঁচানোর জন্য এমনটি করা হয়েছে। লজটিতে গোসলের কোন আলাদা ব্যবস্থা নেই, গোসলের একমাত্র স্থান নিচের কাকচক্ষু নদী জুমা। হাফ প্যান্ট, থ্রি কোয়ার্টার, বিকিনি যে যার মতো পোশাক পরে লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে সবাই মিলে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মার্সেলজ জানালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। ক্লান্ত শরীরে আমরা সবাই লাইন ধরে একে একে খাবারের টেবিলে বসলাম।

আমাজনে যাবো আর মাছ খাবো না তাই কখনো হয়। পিরারুকু, পিরানহা, পাকু ও তামবাকি সবই ছিল আমাদের প্রতিদিনকার খাবার তালিকায়। পিরারুকু পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম স্বাদু পানির মাছ। এরা আকারে ২ মিটার ও ওজনে ১০০ কেজিরও বেশি হয়। অন্যদিকে, পিরানহা, পাকু ও তামবাকি এসবই একই রকম চেহারার স্বাদু পানির মাছ। পিরানহা আকারে ছোট কিন্তু ধারালো ও সূচালো দাঁতের জন্য ভয়ানক; পাকুর দাঁত অনেকটা মানুষের দাঁতের মতো; আর তামবাকি পাকুর মতই ২৫-৩০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে।

আমাজন জঙ্গলে জুমা নদীতে কাঠের ঘরে আমাদের প্রথম রাত। মাঝে মাঝে প্রবল স্রোতে রুমগুলি দুলে দুলে উঠছিল। অদ্ভূত শিহরণ জাগানিয়া নিস্তব্ধতা আর দূরের আকাশে মিটিমিটি জ্বলা তারা; নদীর জলে টুপটাপ, ঝুপঝাপ শব্দ আর চকিৎ চকিৎ ভয়ের কাঁপন; মশারির বাইরে মশার গুনগুনানি আর ভেতরে আমি বিনিদ্র, নিষ্পলক। অতঃপর ঘুমের কাছে ভয়ের আত্মসমর্পন, সকালে পাখির কিচিরমিচির আর কাঠের ফাঁক দিয়ে প্রভাত সূর্যালোকের বিচ্ছুরণে নিদ্রাভঙ্গ হলো। সেদিন ছিল জঙ্গল যাত্রার দ্বিতীয় দিন।

ভ্রমণের তিন দিনের প্রতিদিনই মার্সেলজ জঙ্গলে আমাদেরকে পাঁচ ঘণ্টা করে ট্রেকিং করিয়েছিলো। প্রতিদিন সকালেই আমরা বর্ষাতি, পানি, শুকনো খাবার, সানগ্লাস ইত্যাদি ব্যাকপ্যাকে ভরে সারা গায়ে পতঙ্গনিরোধক ঔষধ মেখে জঙ্গলে বের হতাম। তিন দিন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আমাদের যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছিলো এবার তা বলছি। ঘুরতে ঘুরতে সে আমাজনের বিভিন্ন গাছের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়েছিলো। প্রথমে পরিচয় হলো ব্রাজিল নাটের সাথে। নামের সাথে ব্রাজিল থাকলেও 'ব্রাজিল নাট' ভেনিজুয়েলা, পেরু, বলিভিয়া ও কলম্বিয়াতেও প্রচুর পরিমাণে জন্মে। নাটের খোলস খুবই শক্ত; তবে ভেতরের শাঁস দেখতে অনেকটা কাঁঠালের বিঁচির মতো আর স্বাদে মনে হয় কাজু বাদাম। সিঙ্কোনা বা কুইনাইন গাছের ফুল বড় বিচিত্র রঙের; গাছের বাকল ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে খ্যাত। স্থানীয়রা মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য এই গাছের বাকল ঘরে রাখে এবং ম্যালেরিয়া হলে সেটি পানিতে ভিজিয়ে রেখে পান করে। কুইনাইন ইকুয়েডর ও পেরুর জাতীয় গাছ। হাঁটতে পারে কিনা জানি না তবে এর পরে আমাদের দেখা গাছটির নাম 'চলন্ত পাম'। সুপারী গাছের মতো দেখতে এই গাছের টেবিলের পায়ের মতো ৫-১০ টি করে শিকড় থাকে। কিছুক্ষণ পরে মার্সেলজ একটি গাছের বাকল তুলে নিয়ে জানালো এটি চিরহরিৎ কর্পূর গাছ। সাথে সাথে আমরাও আরো খানিকটা তুলে নিয়ে শুঁকে নিশ্চিত হলাম সে ভুল বলেনি। এর পরে আমরা যে গাছটি দেখলাম তার ফল আইসক্রিমের সাথে ব্রাজিলে বেশ জনপ্রিয়, নাম আছাই পাম। 'আছাই' শব্দটির অর্থটি বেশ মজার- 'যে ফল কাঁদে বা পানি নির্গত করে'। আছাই পাম দেখতে অনেকটা খেজুরের মতো, স্বাদেও খানিকটা সেরকম।

আমাজনের বনে হারিয়ে গেলে কোন চিন্তা নেই। সেখানে 'সুমৌমেইরা' নামে এক ধরণের গাছ আছে যেটি আপনাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করবে। এ গাছগুলি আমাজনের সবচে' উঁচু গাছ, লম্বায় প্রায় ২০০ ফিটের মতো হয়। গাছটির গুঁড়িতে আঘাত করলে বন কাঁপিয়ে আওয়াজ হয়। এই আওয়াজ শুনেই লোকজন বুঝতে পারবে যে আপনি জঙ্গলে হারিয়ে গেছেন। তারপরে সেই শব্দ শুনে উদ্ধারকারীরা এসে বলবে, "পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ"। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই গাছটিকে স্থানীয়রা তাই 'জঙ্গল টেলিফোন' বলে ডাকে। বনের মধ্যে চলতে চলতে কাজু বাদাম ঝুলতে দেখলে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত লোকজনের পক্ষে লোভ সামলানো দায়। সবার মুখেই বেশ কিছু চালান হলে গেল। আমার পকেটেও গেলো কিছু। খাবার জন্য আমরা আরো যেসব ফল পেয়েছিলাম তার মধ্যে অন্যতম ছিল 'সাওয়ারসপ'। প্রায় কাঁঠালের মতো দেখতে এ ফলগুলিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'গ্রাভিওলা'। ক্যান্সার রোগের প্রতিষেধক হিসেবে লোকজনের কাছে এ ফলটি বেশ জনপ্রিয়। তবে কোন পাঁকা গ্রাভিওলা না পাওয়ায় আমরা সবাই কাঁচা ফলগুলোর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। গ্রাভিওলা না খেতে পারার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল 'ইঙ্গা'। বাংলাদেশের সজনে ডাটার মতো লম্বা লম্বা ইঙ্গার ভেতরের সাদা শাঁস সবাই মিলে খেতে লাগলাম। পরে জানলাম এটি বানরের অত্যধিক প্রিয় একটি খাবার। আমরা আতা ফলের মতো একটি ফলের গাছও দেখেছিলাম, নাম 'ননি'। এ ফলটি দিয়ে যে ননি জুস তৈরী হয় তাও ব্রাজিলে জনপ্রিয়। একটি গাছের গোঁড়া খুঁড়ে মার্সেলজ কিছু শিকড় বের করেছিলো। নাম বললো 'কাসাভা' যাকে ব্রাজিলিয়রা 'মানজিওকা' বলে জানে। বিশ্বের তৃতীয় প্রধান শর্করাসমৃদ্ধ এই কাসাভা আফ্রিকান অনেক দেশের প্রধান খাদ্য।

আমাজনে এতো হাঁটাহাঁটি করে কোন পশুপাখি দেখিনি সেটা বললে লোকজন কি বিশ্বাস করবে? কালো রঙের একটি প্রাণী দেখে বন্য শূকর বলে ঘাবড়ে গেলাম। গাইড জানালো ওটার নাম 'তাপির'। তৃণভোজী এ প্রাণিটিকে বেশ শান্ত ও ঘরোয়া বলে মনে হয়েছিলো। অন্য একটি প্রাণীর দিকে আঙ্গুল তুলে মার্সেলজ বলেছিলো সেটি 'ক্যাপিবারা'। এটি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। মাটিতে বড় বড় ঢিবি করে এরা বাস করে। এরা মূলত নিশাচর জাতীয় একটি প্রাণি। জঙ্গলের পথে পথে বিচিত্র রঙের ও সাইজের যে প্রাণীটি সবচে' বেশী যততত্র আমাদের আশেপাশে উঁকিঝুঁকি মারছিলো সেটি হলো বানর। আজব এই প্রাণিটির মনুষ্য প্রীতি। আমাদের দেখা অজস্র পক্ষিকূলের মধ্যে যে কয়টির নাম মনে আছে তারা হলো 'তৌকান', 'ম্যাকাও', 'আরারা', 'কনডোর', বাজ, ঈগল, শকুন ইত্যাদি ইত্যাদি।

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন রাতে ডিনারের পরে জুমা নদীতে আমরা 'কাইমান' শিকারে গিয়েছিলাম। কাইমান কি তা আমার জানা ছিলো না। শুধালে এতটুকু জানলাম এটি কুমির জাতীয় সরীসৃপ। বাকীটা শিকারের পর। নৌকায় আমাদেরকে তুলে মাথায় সার্চ লাইট বেঁধে মার্সেলজ রওনা হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত; নিস্তব্ধ জঙ্গল; কনকনে হাওয়া; আর এদিক ওদিক সার্চ লাইটের আলো। আমাজনের অভদ্র মশারা কামড়ানোর স্খান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে না। বারবার পতঙ্গ নিবারক স্প্রে করেও হাতদুটি একদণ্ডের জন্যেও স্থির থাকতে পারেনি। সার্চ লাইট যেখানে স্থির রইলো সেখানে দেখলাম দুটি ছোট লাইট জ্বলজ্বল করছে। ওই দুটি কাইমানের চোখ। নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হলো। বৈঠায় ধীরে ধীরে ওই দিকে চলল নৌকা যার মাথায় উঁবুর হয়ে শুয়ে আছে মার্সেলজ। ঝুপ! এক হাতে ঘাড় আর এক হাতে লেজের দিকে ধরে মার্সেলজ তুলে আনলো একটি কাইমান। সবাই বিহ্বল, হতবাক ও বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে ছিলো। কুমিরের মতো ধারালো ও সূঁচালো দাঁত থাকলেও কাইমান কুমির নয়। দুই প্রজাতির কাইমান পাওয়া যায়- 'বামন কাইমান' ও 'কালো কাইমান' । প্রথমটি সর্বোচ্চ ১ মিটার সাইজের হলেও কালো কাইমান প্রায় ৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এটা ধরে ছবির পোজ দিতে গিয়ে বুঝলাম কাইমান ছোট হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী ও ভয়ানক। রাতে লজে ফিরে মার্সেলজ আমাদেরকে কাইমান শিকারের নানা দুঃসাহসিক ঘটনাও বলেছিলো। তাঁর হাতে-গায়ে অসংখ্য স্থানে লেখা ছিলো সেইসব শিকারের ইতিহাস।

ভ্রমণের তৃতীয় দিন বিকেলে আমরা গিয়েছিলাম আদিবাসীদের ডেরায়, দেখেছিলাম জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। তবে আমরা একেবারে জঙ্গলবাসীদের দেখা পাইনি। মার্সেলজ জানিয়েছিল তারা সচরাচর সভ্য মানুষের সাক্ষাতে আসে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা ট্যুরিস্টদের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে। যাদের দেখেছিলাম তাদের জীবনে কিছুটা হলেও এখন সভ্যতার আলো এসে পড়েছে। তারাও এখন লেখাপড়া শিখছে। এসব আদিবাসীরা মৎস শিকার করে, হস্তশিল্প নির্মান করে, রাবার উৎপন্ন করে, চাষাবাদ করে, জঙ্গলের ফলফলালি সংগ্রহ করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। আদিবাসী পল্লী ঘুরে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা আস্বাদ পেয়েছিলাম নিষ্পাপ আদিমতার, ঘ্রাণ নিয়েছিলাম সহজ-সরল জীবনযাপনের সোঁদা গন্ধের।

আমাজন ভ্রমণে আমার অন্যতম মধুর স্মৃতি ছিলো সকালের সূর্যোদয় ও বিকালের সূর্যাস্ত। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এতো অদ্ভূত হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিলো না; অথবা "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া"। কাকচোখ নদীর পানিতে উদয়াচল ও অস্তাচলের লালচে আলো, ওপরের পেঁজো তুলো মেঘমালার ক্যানপি ও অন্ধকার বনরাশির গাঢ় প্রতিচ্ছায়া সবকিছু মিলে যে আবহঘন পরিবেশ আমার সামনে দৃশ্যমান হয়েছিলো, পৃথিবীর কোনো ক্যামেরায় বন্দী কোনো ছবি তার প্রতিবিম্ব হতে পারে না। সূর্যোদয় অবগাহনোত্তর প্রত্যাবর্তনের সময় একটি বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঝাঁকে ঝাঁকে বক নদীর এক থেকে দেড় ফুট উঁচু দিয়ে পূর্ব হতে পশ্চিমের একটি মাত্র পথ ধরে দূরে একটি স্থানে জড়ো হচ্ছে। ওদের একই পথ দিয়ে চলার কারণ তখনও জানা হয়নি। পরে জেনেছিলাম হাজার হাজার বক ঐ স্থানে একত্রিত হবার কারণ ছিলো রাতভর বৃষ্টি ও তজ্জন্য নদীর উপরিভাগে ভেসে ওঠা মাছ। তৃতীয় দিন বিকেলে আমরা বড়শি নিয়ে পিরানহা শিকারে গিয়েছিলাম। জায়গা বদল করে করে অনেকবার চেষ্টা সত্ত্বেও বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। অন্যেরা দু'চারটা পেলেও আমি কোনো মাছ পাইনি। তবে লাভের লাভ হয়েছিল জংলী মশাদের। বর্ষায় কাকভেজা ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা নরম শরীরে হুল ফোটাতে ওদের তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি।

চতুর্থ দিন সকালে আমাদেরকে আমাজন জঙ্গল ছেড়ে আসতে হয়েছিল। ভোর থেকে গোছগাছ করে যখন ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। বুঝেছিলাম এ কয়েক দিনেই আমাজন জঙ্গলের প্রেমে পড়ে গেছি। বেলা তিনটা নাগাদ আমরা আবার আমাজোনাস স্টেটের রাজধানী মানাউসে ফিরে এলাম। শহরটি ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়া হতে প্রায় ২০০০ কিমি উত্তর-পশ্চিমে। বেশ পুরানো শহর যার গোড়াপত্তন ঘটেছিল ১৬৬৯ সালে 'সাও জোসে দো রিও' এর দূর্গ নামে। ১৮৩২ সালে এ স্থানটির নামকরণ করা হয়েছিল 'মানাউস' যার অর্থ 'দেবতাদের মা'।

ফিরতি পথে মানউসে যে দুটি স্থান দেখার সৌভাগ্য ঘটে তার একটি ছিল 'আমাজন অপেরা হাউস'। রেনেসাঁ যুগীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এ ভবনটি উদ্বোধন করা হয় ১৮৯৬ সালে। অন্যটি হলো নেগ্রো নদীর উপর নব্য নির্মিত 'মানাউস ইরানদুবা ব্রিজ' (স্থানীয় ভাষায় 'পংচে রিও নেগ্রো') ও এর সংলগ্ন কৃত্রিম সৈকত। ৩.৬ কিমি দীর্ঘ এ ব্রিজের নকশা অনেকটা আমাদের রাঙামাটির ঝুলন্ত ব্রিজের মতো। তবে ব্রিজ ও সৈকতের চেয়েও সৈকতের উত্তপ্ত বালুতে পর্যটকদের 'রৌদ্র স্নান'ও কম উপভোগ্য ছিল না। একটি কথা না বললেই নয়, আমাজন জঙ্গল আমাজোনাস স্টেটে হলেও এ স্টেটের রাজধানী মানাউস অতিমাত্রায় শিল্পায়িত একটি অঞ্চল যেখানে 'এলজি', 'সামসাং', 'নোকিয়া', 'হুন্দাই' 'হোন্ডা'র মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানির কারখানাসহ অনেক ব্রাজিলিয় শিল্পের কলকারখানাও রয়েছে। ব্রাসিলিয়ার পথে আমার ফিরতি ফ্লাইট ছিল সেদিন রাত সাড়ে আটটায়।

ভ্রমণকাল (১২-১৬ জুন ২০১৩)

=======================

ব্রাজিল নিয়ে অন্যান্য সকল ব্লগসমূহঃ