কাকে কাকের মাংস খেলে শিয়াল-শকুনের আর দোষ কী!

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 24 Nov 2015, 05:28 AM
Updated : 24 Nov 2015, 05:28 AM

'মুসলিম' ও 'সন্ত্রাসী' এবং 'ইসলাম' ও 'উগ্রবাদ' (extremism) — শব্দযুগলদ্বয় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একরকম সমার্থক দ্যোতনার সৃষ্টি করেছে। প্রথমটির মধ্যে দ্বিতীয়টি উহ্য আর দ্বিতীয়টির সাথে প্রথমটি অনুমিত।

ফ্রান্সে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নৃশংসতায় ইউরোপের সবচেয়ে প্রানঘাতী হামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই হামলায় অন্তত ১২৯ জন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হয়। বরাবরের মতো বুক এবারও ফুঁলিয়ে 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দি লেভান্ট' (আইএসআইএল) বা 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া' (আইএসআইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করার পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বরাতে অনুমিত যে হামলায় জড়িতরা মুসলমান যাদের মূলে রয়েছে আবদেল হামিদ আবাউদ নামক একজন সিরীয়।

অবশ্য এ হামলায় সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্কেরও ঘাটতি নেই- ইরানের প্রেস টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন সহকারী অর্থমন্ত্রী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক পলক্রেইগ রর্বাটস বলেন,

"সিরিয়া যুদ্ধে ঢুকে পড়ার কৌশল হিসেবে আমরিকা ও ন্যাটো জোট এ কাজ করেছে। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ফরাসি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল বা দায়েশের পক্ষে এমন হামলা চালানো কঠিন। এছাড়া, এ হামলা আইএসআইএল'র স্বার্থ রক্ষা করছে না বরং পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করবে।"

তিনি আরও মনে করেন,

"… এ হামলার পেছনে মিথ্যা লুকিয়ে আছে। ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়া শরণার্থীদের পক্ষে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও বোমা চোরাচালান করা সম্ভব নয় কাজেই তারা এ হামলা চালায়নি।"

আবার, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইলকে দায়ী করেন। প্যারিসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স বলেন,

"আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। ইরাকে আগ্রাসী যুদ্ধের ফলেই আল-কায়েদা ও আইএসের উত্থান হয়েছে। এর দায়দায়িত্ব আমরা চাইলেও এড়াতে পারব না।"

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের মতে

"পৃথিবীর ৪০টি দেশ জঙ্গিদের অর্থ দিয়ে আসছে। এর মধ্যে জি-টুয়েন্টিভুক্ত কিছু দেশও রয়েছে।"

তাছাড়া, কানাডাভিত্তিক রিসার্চ দল 'গ্লোবাল রিসার্চ' ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের ওয়েবসাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল, 'America Created Al-Qaeda and the ISIS Terror Group' ।

গত ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ হাজারের মতো। এ ধরণের সন্ত্রাসী হামলা যেই করুক, যেভাবেই করুক বা যে উদ্দেশ্যেই করুক না কেন সামগ্রিকভাবে এসব হামলায় সবচেয়ে বেশী প্রতিফল ভোগ করতে হচ্ছে গোটা মুসলমান জাতিকে, সর্বোপরি ইসলাম ধর্মকে ।

কেবল প্যারিস হামলা পরবর্তীকালে সিরীয় মুসলমানদের জীবনে আগত বা আসন্ন সংকুলতার কথাই ধরা যাক। আক্রমণের দু'দিন পরেই প্রতিশোধ হিসেবে আল-রাক্কা, সিরিয়া লক্ষ্য ফ্রান্স তার ইতিহাসের বৃহত্তম একক বিমান হামলা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জানিয়েছেন, তাঁর দেশও আইএস-এর বিরুদ্ধে হামলার তীব্রতা বাড়াবে৷ আমেরিকার শতমূখী বিরোধী পক্ষ রাশিয়াও আইএস ইস্যুতে তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রূতি দিয়েছে। অনাক্রমণমূলক অবস্থানই পাঁচ দশক ধরে যে চীনের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ সেই চীনও এবার দৃশ্যত পশ্চিমা অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আইএসসহ সব জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বশক্তিগুলোকে এক হতে ফ্রান্সের দেওয়া প্রস্তাব অনুমোদন করেছে নিরাপত্তা পরিষদ। এতে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের যে স্বর্গরাজ্য গড়ে উঠেছে তা নস্যাৎ করে দিতে হবে।

পুরানো একটা প্রবাদ আছে- 'নগর পুড়িয়ে দেবালয় কি এড়ায়'? সন্ত্রাসীরা সমাজের বাইরের কোনো জীব নয়, তারা চাঁদের দেশেও বসবাস করে না; এরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা সামাজিক ক্যান্সার। সন্ত্রাসবিরোধী একাট্টা আক্রমণ সন্ত্রাসীদের জন্য যতটা না ভয়ের, সাধারণ মানুষের জন্য তার থেকে অনেক বেশী আতঙ্কের- আর যদি সেটা বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে টার্গেট করে গড়ে ওঠে তবে তা হতে পারে চরম সর্বনাশের অশনী সংকেত।

এভাবে যা হচ্ছে, তা হবার কথা ছিল না।  হিটলার, মাও সেতুং, পল পট, মুসোলিনি, ইদি আমিন, তালাত পাশা… এদের পাপের দায়ভার কখনোই তাদের জাতির উপর বর্তায়নি, ধর্মের উপর তো নয়ই। সেকালে না হলেও একালে কিন্ত তালেবানের ইস্যুতে আফিগানিস্তান, আল-কায়েদা ইস্যুতে ইরাক আর আইএস ইস্যুতে সিরিয়াবাসীকে খেসারত দিতে হচ্ছে- আর এদের সকল ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা মুসলিম জাতি।

ইরাকি-সিরীয়রা নিজ ঘরে নিহত, অন্য ঘরে অনাহুত। ইউরোপ যখন ইরাকি, সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করছে, তখনই এই হামলায় পুরো ইউরোপ রাজনীতিক আশ্রয় প্রার্থীদের বিষয়ে নূতন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছে।  ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমঝোতা অনুসারে পোল্যান্ডের সাড়ে চার হাজারের মতো শরণার্থীর আশ্রয় দেওয়ার কথা। পোল্যান্ড সুর পাল্টে বলছে  "নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পেলেই শুধু শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দেওয়া হবে"; অর্থাৎ,  আপাতত তারা নতুন কোনো শরণার্থীদের আশ্রয় দিবেনা।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আগামী বছর ১০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্যারিস হামলার পর মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ  জানিয়েছেন, যদি শরণার্থীদের আশ্রয় দিতেই হয়, তবে কেবল খ্রিষ্টান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে। রিপাবলিকান দলের আলোচিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস হামলার পর আগেভাগেই বলে রেখেছেন, সিরিয়া থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামা যেসব শরণার্থী গ্রহণ করবেন, নির্বাচিত হলে তিনি তাদের সোজা সিরিয়ায় ফেরত পাঠাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গভর্নরেরা একাট্টাভাবে সিরিয়ার মুসলিম শরণার্থীদের নিজ নিজ এলাকায় আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

সিরিয়া থেকে এ বছরের মধ্যে ২৫,০০০ শরণার্থী গ্রহণের প্রতিশ্রূতি দিয়েছিল কানাডার নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুডো। প্যারিস হামলার পরে নিরাপত্তা বিতর্কে সে উৎসাহে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। এখন কানাডা কেবল স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারকে এ কর্মকাণ্ডের আওতায় রেখেছে। পরিবারবিহীন কোন ব্যক্তিকে তারা শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করবে না।

ইতোমধ্যেই শরণার্থী ইস্যুতে জার্মানির ভেতরেও চাপ তৈরি হয়েছে। সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার জন্যেও চাপ আছে। জার্মানি যদি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় তাহলে তার প্রভাব পড়বে বলকান দেশগুলোর ওপরেও। পাশাপাশি ইউরোপের অভিন্ন ভিসা ব্যবস্থার  (শেঙ্গেন ভিসা) ওপরেও এই প্যারিস হামলার প্রভাব পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই এই ভিসা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। জার্মানিসহ বেশ কয়েকটি দেশ শেঙ্গেন ভিসা ব্যবস্থা স্থগিত করেছে।

টেক্সাসের আহমেদ মোহামেদের আবিস্কৃত সেই "বোমা সদৃশ" ঘড়ি কথা সবার মনে আছে- দ্রুত ক্রমবর্ধমান 'ইসলামোফোবিয়া' বা 'ইসলামভীতি' বোঝাতে নিকট অতীতে এর চেয়ে ভাল উদাহরণ আর দেখা যায় না। মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাস আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে- ফ্রান্সে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা শ্লেষাত্মক মন্তব্যের মুখোমুখি হচ্ছে, কানাডা ও যুক্তরাস্ট্রে মসজিদে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, বিনা কারণে কানাডায় এক মুসলিম মহিলা প্রকাশ্যে অপমানিত হয়েছে, কেবলই নামের কারণে বিমান বন্দরগুলোতে মুসলমানদেরকে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে, নামের সাথে আইএসআইএস থাকার কারণে ফেসবুক প্রোফাইল ব্লক হয়েছে; পশ্চিমা স্কুলগুলোতে মুসলিম ছেলেমেয়েরা সহপাঠীদের দ্বারা নিয়ত নিগৃত হচ্ছে, রাস্তায় নামলে শুনতে হচ্ছে "তোমার দেশে চলে যাও। তুমি একজন সন্ত্রাসী"। তাই টিকে থাকার তাগিদে দেশে দেশে মুসলমানদেরকেও ইসলামোফোবিয়া বিরোধী ক্যাম্পেইন জোরদার করতে হচ্ছে- রাস্তায় দাড়িয়ে বলতে হচ্ছে "আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তুমি কী আমায় বিশ্বাস করো? আমাকে জড়িয়ে ধরো"; "আমি একজন মুসলিম, সুতরাং"; মানুষকে ডেকে ডেকে বলতে হচ্ছে "আমি একজন মুসলিম কিন্ত সন্ত্রাসী নই" ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরও নাম কী বেঁচে থাকা! এভাবে কতদিন চলবে বলা দুষ্কর, আরো কিছু হামলার পর এসব পন্থাও অকার্যকর হবে। তারপর, কীভাবে বাঁচবে মুসলমানেরা? ধর্ম লুকিয়ে, না নাম বদলে? কবে শেষ হবে এমন নিদারুণ দূর্দিন? হবে, না কি হবে না!?

 নামধারী মুসলমানেরাই আজ ইসলামের ঘোর শত্রূ। কাকে কাকের মাংস খেলে শিয়াল-শকুনের আর দোষ কী!

====