বিশ্ব তেল রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 21 Jan 2016, 05:47 PM
Updated : 21 Jan 2016, 05:47 PM

বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এখন দুধের দামের চেয়েও কম। ডব্লিউটিআই (West Texas Intermediate) সূচকে আজ ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ২৬.১৯ মা.ড., অর্থাৎ, গ্যালন প্রতি বাষট্টি সেন্টস। সেমতে, যদি এক গ্যালন দুধের দাম ১.১৮ মার্কিন ডলার হয়, তবে এক গ্যালন দুধের দামে দুই গ্যালন তেল পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৪ সালের শুরুতে ব্যারেল প্রতি যে তেলের দাম ছিল ১১০ মা.ড., গোল্ডম্যান স্যাস ও মরগ্যান স্টানলি আশঙ্কা করছে তা এখন ২০ মা.ডলারেরও নিচে নেমে যেতে পারে। অবশ্য, তাঁদের এহেন আশঙ্কার যথার্থ অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।

তেলের মূল্য নিম্নগামী হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাটা খুবই সাদামাটা- চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা। ২০১৫ সালে বিশ্বে দৈনিক তেলের চাহিদা ছিল ৯২.৮০ মি.ব্যা.; কিন্ত চাহিদার তুলনায় প্রতিদিন বেশি উত্তোলিত হয়েছে ১.৭ মি.ব্যা.। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত এ যোগানই বিশ্ব তেল অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

বিশ্বে তেলের যোগানকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়- ওপেকভূক্ত* ও ওপেক-বহির্ভূত দেশের তেল উত্তোলন। মোট তেল সরবরাহের ৪০ শতাংশের উত্তোলন হয় ওপেকভূক্ত দেশগুলো থেকে যার সিংহভাগের দাবীদার সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ভেনিজুয়েলা। বাকী ৬০ শতাংশ উত্তোলিত হয় ওপেক-বহির্ভূত দেশগুলো থেকে। এদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচে রয়েছে দেশভিত্তিক উত্তোলনে প্রথম আমেরিকা, তৃতীয় রাশিয়া, পঞ্চম কানাডা, চিন ও মেক্সিকো।

প্রধান দুইটি কারনে তেলের মূল্য নির্ধারণে ওপেক-বহির্ভূত দেশগুলোর তুলনায় ওপেক-ভূক্ত দেশগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশী। একটি হলো, ব্যারেল প্রতি উত্তোলন খরচ- ওপেকের অনেক দেশে ব্যারেল প্রতি উত্তোলন খরচ ওপেক-বহির্ভূত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। আমেরিকায় এক ব্যারেল তেল উত্তোলনে খরচ হয় ৭৩/৫৭ মা.ড. (শেল/গভীর সমুদ্রে), কানাডায় ৯০ মা.ড./ব্যা (বালুতে), রাশিয়ায় ১২০/১৮ (আর্কটিক/সমুদ্র উপকূলে); অপরপক্ষে, সৌদি আরব (সমুদ্র উপকূলে), ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের উত্তোলন খরচ যথাক্রমে ৩, ৬ ও ৭ মা.ড. এবং ওমান, কাতার, ইরান ও আলজেরিয়ার খরচ ১৫ মা.ড.। অপরটি হলো, তেলের রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ। ওপেকভূক্ত দেশগুলো বিশ্ব তেল রপ্তানি বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

তেল উত্তোলনের মতো তেল আমদানিতেও শীর্ষে আমেরিকা। এরপরে আছে জাপান, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ব্যাপক দেশীয় চাহিদার কারণে ২০১৩ সালে দৈনিক ১২.৩৪ মি. ব্যা. উত্তোলনের পরেও আমেরিকাকে প্রতিদিন আরো ৯.০৮ মি.ব্যা. অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেল উত্তোলন করা সত্ত্বেও তেল ব্যবহারের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চিনকে প্রতিদিন ৫.৪২ মি.ব্যা. (২০১২) তেল আমদানি করতে হয়। এসব তেলের সিংহভাগ রপ্তানি করে ওপেকের দেশগুলো।

বিশ্ব রাজনীতিতে তেল বিশেষ নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে আমেরিকা তার শেল থেকে তেল উত্তোলন বৃদ্ধি করেছে। ফলে ২০০৯ সালে আমেরিকার দৈনিক ১০.৪৩ মি.ব্যা. তেল আমদানি কমে ২০১৩ সালে ৯.০৮ মি.ব্যা. এসে দাড়িয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে আরো কমছে। তেল রপ্তানিকারক ওপেকের দেশগুলোর জন্য এটি মোটেও সুখকর কোনো সংবাদ নয়। তবে, আমেরিকার জন্য এ ধরণের উত্তোলন অব্যহত রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এভাবে উত্তোলনের খরচ অনেক বেশি। তেলের মূল্য আরো পতনের সাথে সাথে এই সকল উত্তোলন কোম্পানিগুলোর অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে।

তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ২০১২ সালে ওপেকের দেশগুলোর উপর দৈনিক ৩০ মি.ব্যারেলের বেশী তেল উত্তোলন না করার প্রতিবদ্ধকতা দেয়া হয়, যা 'সফট ক্যাপ' নামে পরিচিত। তবে, ওপেক-বহির্ভূত দেশগুলোর এমন কোন প্রতিবদ্ধকতা না থাকায় এ নিয়ে ওপেকের দেশগুলোর মধ্যে সবসময় এক ধরণের চাপা ক্ষোভ ছিল। আমেরিকার শেল তেল উত্তোলন বৃদ্ধির সাথে সাথে তেল রপ্তানির বাজার ধরে রাখার জন্য ওপেকের দেশগুলোও 'সফট ক্যাপ' না মেনে দৈনিক প্রায় ৩৩ মি.ব্যা. তেল উত্তোলন শুরু করে। ফলে, চাহিদার বিপরীতে বাজারে তেলের যোগান অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। চাহিদা ও যোগানের এ ভারসাম্যহীনতার কারনে নিয়মিতভাবে তেলের দাম কমছে।

ক্রমাগত দরপতনের ফলে প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর মুদ্রামানের অস্বাভাবিক অবমূল্যায়ন ঘটেছে। কানাডিয় ডলার, ব্রাজিলিয় রিয়াল ও রাশিয়ান রুবল এর মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ভাবেই ব্রাজিলের ত্রাহি মধুসূধন অবস্থা। ১৯৩০'র পরে ২০১৫ সালে ছিল ব্রাজিলের অর্থনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ বছর। ক্রমান্বয়ে জিডিপি কমছে- গতবছর কমেছিল ৩.৮ আর এ বছর কমতে পারে ৩.৫%। বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৬.৭৫ শতাংশ। ২০১২ সালে এক মা.ডলারের বিনিময়ে দুই ব্রাজিলিয় ডলার পাওয়া যেত, এখন চার ডলার পাওয়া যায়- তিন বছরে মূদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে দ্বিগুণ। সরকার প্রধানও অভিশংসনের আশংকায় আছে। রাশিয়াও তেলের মূল্যপতনে ধরাশায়ী। দেশটির মোট আয়ের ৬৭-৭০ ভাগই আসে তেল রপ্তানি থেকে। তেলের দাম এক ডলার পড়লে রাশিয়ার দুই বিলিয়ন মা.ডলারের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ২০১৫ সালে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৩.৮ শতাংশ। কয়েক বছর আগেও এক ডলারে ২৫-৩০ রুবল পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যাচ্ছে ৮২ রুবল। সেখানে মুদ্রাস্ফিতির হার ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার ভেনিজুয়েলাও তেলে ভর্তুকী দিতে দিতে নাজুক অবস্থায় পড়েছে। দেশটিতে বর্তমান মুদ্রাস্ফিতির পরিমান ৬০ শতাংশ।  মার্কিন ও কানাডিয় তেল কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে, এরা বিনিয়োগ বন্ধ করে ব্যাপক সংখ্যায় চাকুরি ছাঁটাইও করতে পারে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক রিজার্ভ থাকার ফলে দরপতনের কোনো প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগবে। যোগান বৃদ্ধি করে তেলের মূল্য পতনে প্রধান নেতৃত্ব দানকারী সৌদি আরব। দেশটি ২০১০ সালে দৈনিক উত্তোলন করতো ১০.৯ মি.ব্যা. যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪ সালে ১১.৬২ মি.ব্যারেলে এস দাড়িয়েছে। দেশটির বর্তমান বৈদেশিক রিজার্ভ ৭০০ বি. মা.ড.। আবার ব্যারেল প্রতি উত্তোলন খরচ মাত্র ৩ মা.ড.। সুতরাং, দেশটি চাইলে অনায়াসে আরো কিছুকাল বিশ্ব বাজারে আরো বেশি তেল সরবরাহ করে তেলের মূল্যহ্রাস ধরে রাখতে সহায়তা করতে পারে।

তবে তেলের মূল্যপতনে কারো যে লাভ হচ্ছে না, তা অবশ্য নয়। ভারত ও চিন এ দরপতনে সবচেয়ে লাভবান কারণ তাদের বিপুল পরিমাণ তেল আমদানির বিপরীতে খরচ হচ্ছে অনেক কম। এমনকি বাংলাদেশও এর সুফল পাচ্ছে। এ মাসে বৈদেশিক রিজার্ভ আবারো ২৭ বি.মা.ড. ছাড়িয়েছে যার অন্যতম কারণ তেলের আমাদনিতে খরচ কমে যাওয়া। তবে বাংলাদেশের একটি আশঙ্কা রয়েছে- যদি এভাবে দরপতন হতে থাকে এবং এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মুদ্রা সংকুচিত হয়, তবে সেটা আমাদের রেমিটেন্সের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে।

তেলের বাজার স্থিতিশীল করার উপায় এখন একটাই- চাহিদার বিপরীতে তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ বা সরবরাহ বৃদ্ধির অনুপাতে চাহিদা বৃদ্ধি করা। ওপেক-বহির্ভূত দৈনিক তেল উত্তোলন ০.৬৬ মি.ব্যা. কমতে পারে। গতমাসে ওপেক-ভূক্ত দৈনিক সরবরাহ ০.২১ মি.ব্যা. কমে ৩২.১৮ মি.ব্যারেলে এসে দাড়িয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালে দৈনিক তেলের চাহিদা ১.২৬ মি.ব্যা. বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪.১৭ মি.ব্যা. হবে। এসবই একটি স্থিতিশীল তেলের বাজারের জন্য ইতিবাচক।

এর পরেও আরো দুইটি ঝুঁকি আছে। এ বছরের জানুয়ারিতে ইরানের উপর থেকে মার্কিন কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উত্তোলন করা হয়েছে। এরই পরে  ইরান দৈনিক উত্তোলন পাঁচ লাখ ব্যারেল বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, ইসলামিক স্টেটের (আইএসআইএস) সস্তায় কালো বাজারে তেল বিক্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইএস  প্রতিদিন ৫ মি. মা.ডলারের সমপরিমাণ তেল কালোবাজারে বিক্রি করছে। এসব মিলিয়ে ২০১৬ সালে ওপেক-ভূক্ত দৈনিক সরবরাহ ০.১৭ মি.ব্যা. বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তেলের উপর ভাসছে বিশ্ব তেল রাজনীতি। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। ত্যালা মাথায় তেল, না কি ন্যাড়া মাথায় বেল?

========

* ওপেক-ভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত, ভেনিজুয়েলা, কাতার, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, ইকুয়েডর ও অ্যাঙ্গোলা।

মি.ব্যা- মিলিয়ন ব্যারেল; মা.ড.- মার্কিন ডলার; মা.ড./ব্যা- ব্যারেল প্রতি মার্কিন ডলার

=========