রাষ্ট্র ও ধ‍র্ম বনাম রাষ্ট্রধ‍র্ম

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 27 March 2016, 10:33 AM
Updated : 27 March 2016, 10:33 AM

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রসঙ্গে দিন কয়েক আগে একাত্তর টিভির একটি 'টক শো' দেখছিলাম।  আলোচনায় উপস্থাপিকা, আলোচকবৃন্দ বনাম লাইভ অতিথির মধ্যে যে ঝড়ো কূটতর্কের তেলেসমাতি দেখলাম তা বোধ করি না বলাই ভালো।

'টক শো' উপস্থাপনা বা আলোচনায় কেউকেটাদের শালীনতার ঘাটতি থাকতেই পারে, এটা মেনে নিয়ে আমরা তা দেখছি। কিন্তু বিদ্যার স্বরস্বতীকে পানাডোবায় চুবিয়ে ভদ্র মহোদয়-মহোদয়াগণ দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের (!) সঙ্গে এভাবে দিস্তা দিস্তা ভুল তথ্য প্রদানে সিদ্ধহস্ত হয়েছেন- সতিই তা আমার অজানা ছিল।

আলোচনা শেষে জ্ঞানীজনের বাণীতে জানলাম, মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান, মরোক্কো কোনোটাতেই ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম নয় এবং ভ্যাটিকান সিটি বাদে বিশ্বের আর কোনো দেশ রোমান ক্যাথলিসিজমের মাধ্যমে পরিচালিত হয় না ।

ভুল করে অন্য দুই একটি দেশের নাম বললে ভালো হতো। কপাল খারাপ হলে যা হয়, যে কয়টা দেশের নাম এলো তাদের সব কয়টিতেই ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম বা অফিসিয়াল ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। মালয়েশিয়া রাষ্ট্রীয় আচরণে যে ধর্মনিরপেক্ষ তা অস্বীকার করার জোঁ নেই, কিন্তু ইসলাম দেশটির সংবিধানস্বীকৃত ধর্ম।

ওদের সংবিধানের ৩(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, "Islam is the religion of the Federation; but other religions may be practised in peace and harmony in any part of the Federation"।  সংবিধানে ধ‍র্মের উল্লেখ থাকলেও একটি দেশ ধ‍র্মীয় আচরণে কতটা ধ‍র্মনিরপেক্ষ হতে পারে, মালয়েশিয়ার তার এক নিখাঁদ উদাহরণ।  বাকীটুকু বলতে একটু শিবের গীত প্রয়োজন ।

পৃথিবীতে কতজন মানুষ এখন ধর্মে বিশ্বাসী- এ প্রশ্ন নিয়ে যত বেশি গবেষণা হয়েছে লব্ধ ফলে তথ্যের ফারাক তার চেয়েও অনেক বেশি। পিউ রিসার্চ সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের গবেষণার আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। এ প্রতিষ্ঠান ২০১২ সালে বিশ্বের ধর্মাবলীদের সংখ্যা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী। অন্যদিকে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সংখ্যায় বললে, বিশ্বের ১০০ কোটির বেশি মানুষ এখন ধর্মে অবিশ্বাসী। ধর্মে অবিশ্বাসকে যদি ধর্ম বলা যায় তবে সংখ্যা তত্ত্বের বিচারে নাস্তিক্য ধর্ম বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম।

অঞ্চলভেদে ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমেরিকা ও ইউরোপে খ্রিষ্টানের সংখ্যা বেশি এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ধর্মাশ্রয়ী।

বিশ্ব ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যায় প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে আছে যথাক্রমে খ্রিষ্ট, ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম। পরিসংখ্যান বলছে, যদি বতর্মান হারে বিশ্বজনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ ধর্মহীনের সংখ্যা ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে। ২০৭০ সালে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা খ্রিষ্টানদের সমান হবে এবং ২১০০ সালে ইসলাম হবে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম।

ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ধর্মের উৎকর্ষতার চেয়ে এ বৃদ্ধির পেছনে বেশি ভূমিকা রাখছে মুসলমানদের জন্মহার। এখন যেভাবে প্রতি বছর ৩ দশমিক ১ হারে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২১০০ সালে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ (৩৪.৯ শতাংশ) মানুষ হবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্র ধর্মীয় রাষ্ট্র (ভ্যাটিকান, ইসরায়েল, সৌদি আরব) এবং রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্রধর্ম সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হতে পারে আবার অফিসিয়ালও হতে পারে। যদিও রাষ্ট্রধর্মধারী দেশের সংখ্যা নিয়ে তারতম্য রয়েছে, তবুও বলা চলে বতর্মানে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ দেশে ধর্ম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাভোগী।

মূলত যেসব ধর্ম বিভিন্ন দেশে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে আছে, সেগুলো হলো- খ্রিষ্ট, ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি। ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী রাষ্ট্রগুলোর অর্ধেকই ইসলাম, ও বাকি অর্ধেকের ৮০ শতাংশই খ্রিষ্ট ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র। ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্ম যদি বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি ধর্ম হয়, তাহলে তা থেকে অনুমান করা যায়, যেকোনো রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে সেই ধর্মের অবিচ্ছেদ্য পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সূত্রে সখ্য গড়ে ওঠে।

উপর্যুক্ত উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বে যেসব রাষ্ট্র ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে টিকে আছে, সেসব দেশে ওই বিশেষ ধর্মের গড় লোকসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো দেশে কোনো ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি হলে সেই রাষ্ট্রে ওই ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বিবেচনার দাবি ওঠাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়। ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে অবৈধতাকে বৈধতায় রূপান্তর করার সুযোগের বিষয়টা না হয় বাদ দিলাম।

রাষ্ট্রধর্মের বিষয়ে কিছু দেশ আবার দুই কাঠি সরস।  যেমন- ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি ও রাশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার কথা ধরা যাক। মুসলিম জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র হলেও ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮৭ দশমিক ২ শতাংশ।

ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভকারী পূর্ব তিমুরের ৯৯ দশমিক ১ শতাংশই খ্রিষ্টান। মুসলমান ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ খ্রিষ্টান, ১ দশমিক ৭ হিন্দু আর বাকিটা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় ছয়টি ধর্মকে অফিসিয়াল ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে- ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্যাথলিসিজম, প্রোটেস্ট্যানিজম ও কনফুসিয়াসিজম। জার্মানিতে লুথেরানিজম ও রোমান ক্যাথলিসিজম উভয়েরই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আছে। ১৯৯৭ সাল থেকে রাশিয়া খ্রিষ্ট, ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্মকে অফসিয়াল ধর্মের মর্যাদা দিয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিরোধী যুক্তিও আছে। বিশ্বে এমন কতগুলো রাষ্ট্র আছে যেখানে কোনো একটি ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৯৫ শতাংশের বেশি থাকলেও রাষ্ট্র সেই ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। হন্ডুরাস, পানামায় ১০০ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। তুরস্ক, আজারবাইজান, গাম্বিয়া ও কসোভোয় মুসলমানদের সংখ্যা ৯৫-৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ। নেপালে হিন্দুদের সংখ্যা ৮১ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু এসব কোনো দেশেই কোনো ধর্ম এখন রাষ্ট্রধর্ম নয়।

ধর্ম বা বিশেষ কোনো মতাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম জারি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম চালু হলে এখনই বিশ্বের কয়েকটি দেশের নাস্তিক্যবাদকে সে দেশের রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিতে হবে। যেমন, ভিয়েতনাম (৮০.৮%) নেদারল্যান্ডস (৪২%), দক্ষিণ কোরিয়া (৪৩.৩%), চীন (৫২.২%), চেক প্রজাতন্ত্র (৩৪.৫%) ও এস্তোনিয়ায় (৫৪.১%) ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা যেকোনো ধর্মালম্বীর চেয়ে বেশি। তাই বলে এসব দেশ নাস্তিকতাকে রাষ্ট্রধর্মে আসীন করেনি।

'টক শো'র মতো টক-মিষ্টিতে ফিরে আসি। পৃথিবীর বৃহৎ কোনো ধর্ম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জন্মলাভ করেনি। ধর্মীয় ইতিহাসে দেখা যায়, প্রতিটি ধর্মের সূচনাতেই রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন ছিল। আরব শাসনকর্তারা মুসলমানদের মেনে নেয়নি, খ্রিষ্টানদেরকে রোমান সম্রাটদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে, মিশরের রাজারা ইহুদিদেরকে আরব সাগরের ওপারে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

এটাও সত্য যে, কখনো ধর্মকে আশ্রয় করে রাষ্ট্র (ভ্যাটিকান সিটি, ইসরায়েল) আবার কখনো রাষ্ট্রকে আশ্রয় করে ধর্ম (হিন্দু ধর্ম) বেড়ে উঠেছে। ভ্যাটিকানের কাছ থেকে রোমান ক্যাথলিসিজম কেড়ে নিলে ভ্যাটিকান নির্বীজ আর হিন্দু ধর্মের কাছ থেকে ভারতকে কেড়ে নিলে ধর্ম নির্জীব হয়ে যাবে।

ধর্ম সত্য হলে সে সত্যকে, বিশ্বাস সত্য হলে সে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকবে। রাষ্ট্রধর্ম থাক বা না থাক ধর্ম থাকবে, সংবিধানে থাক বা না থাক ধর্মের বিশ্বাস নিয়ে রাষ্ট্র টিকে থাকবে।

——০——-