মডেল সাবিরা হোসেনের আত্মহত্যা কোনো রহস্য নয়, অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়, নিছক কোনো দুর্ঘটনাও নয়; বরং এ মৃত্যু ওর জীবনের ঘটনা পরম্পরায় নির্ধারিত একটি নিয়তি মাত্র। সাবিরা আমাদের সমাজে এখন ব্যতিক্রম কোনো নাম নয়। কোনো একটি ঘটনা ঘটে যাবার পরে সে ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিন্দা জানাই, ধিক্কার জানাই, সহানুভূতি প্রকাশ করি ইত্যাদি ইত্যাদি। যেদিন আমরা ঐশীর নাম জেনেছিলাম, ভাবিনি এর পরে নামটি জুনায়েদ; আবার জুনায়েদ কেচ্ছার ছয় মাসের মধ্যে এখন সাবিরা কথন। আর কতো দীর্ঘ হবে ওদের নামের লিস্ট? আমাদের কি ভেবে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই এসব কেন হচ্ছে?
ফেসবুকে ওর বন্ধু-বান্ধবের পোস্টের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ওর বেড়ে ওঠা, জীবন-যাপনের দিকে একটু নজর দিতে পারি। সাবিরার পিতা মনির হোসেন দুবাই প্রবাসী, মাতা দিলশাদ কাদির দেশে পরবাসী। সংসার বিচ্ছেদে স্বামীর গেছে স্ত্রী, স্ত্রীর স্বামী- সাবিরা হারিয়েছে পিতা-মাতা, হারিয়েছে মাথার উপরে এক টুকরো ভালোবাসার ছাদ। স্বাভাবিক কোনো ছেলেবেলা ও দেখেনি, বরং আত্মীয়ের বাসায় কিশোরী বয়সে বা তারও একটু আগেই ওর জীবনে 'মেয়েবেলা' এসেছে। মেয়ে তো, মানুষ নয়; রক্ত-মাংশের পুতুল। পরিবারের ভালোবাসার জালে জড়িয়ে বেড়ে ওঠা সাবিরার জীবন হয়তো এমন নাও হতে পারতো! সুস্থ-স্বাভাবিক একটি জীবন প্রতিটি শিশুর জন্ম অধিকার। এ অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে কাউকে আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া কি হত্যা নয়? এ সমাজ ওর পিতামাতার কি কোনো বিচার করবে? আত্মহত্যায় প্ররোচিত করায় নির্ঝর, প্রত্যয়ের যদি শাস্তি হতে পারে তবে ওকে এমন এক দূর্বিসহ জীবনে ঠেলে দেয়ার জন্য ওর পিতামাতার শাস্তি কেন নয়?
ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়, ভালোবাসায় নিঃসঙ্গ মানুষও তেমনি কাউকে না কাউকে আঁকড়ে ধরে। অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে, সেভাবে পারে সেভাবে ধরে। মন দিয়ে, দেহ দিয়ে যা থাকে তাই দিয়ে ধরে। অশ্লীল জীবন-যাপন, নেশা, যৌনতা এ সমাজে যে যেভাবে ওকে চেয়েছে তাকে সেভাবেই ও আলিঙ্গন করেছে। নির্ঝর এ সমাজের একজন প্রতিনিধি, আমাদেরই একজন। আমি, আপনি, আমরা ক'জন পুরুষ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি নির্ঝদের দুষ্টু প্রেতাত্মারা আমাদের দেহেও আকুপাকু করে না? নিদ্বিধায় বলতে পারি, আত্মহত্যা রেকির ভিডিওটি দেখার সময়েও পুরুষের লোলুপ চোখগুলি যতটা না ওর ছুরির উপরে ছিলো তার চেয়েও বেশী ছিল ওর খোলা শরীরের ভাজে ভাজে।
হোটেল, সাব-লেটের বদ্ধ ঘরের অন্তরালে সাবিরার মজা লুটেপুটে এ সমাজ ওকে কুলটার তকমা দিয়েছে। এ সমাজ যেভাবে সাবিরাকে দেখতে চেয়েছে, ও তো সেভাবে সেজেছে। ওর কী দোষ ছিল! 'বেশ্যা' বলে প্রত্যয়ের পরিবারে ওর ঠাঁই হলো না, আমাদের কোনো পরিবারেরই ওদের ঠাঁই নেই। বেশ্যাদের নিটোল দেহ থাকবে, এটা সুডৌল হতে হবে, ওটা দৃঢ় থাকতে হবে; কিন্তু মন থাকতে পারবে না, জীবন থাকবে না। ওদের এভাবে পারতে হবে, সেভাবে করতে হবে; তবে ওরা কোনো কুলের বৌ হতে পারবে না, কারো মা, বোন, ভাবী কিচ্ছু হবে না। বেশ্যা বলে কথা, বেশ্যা তো বেশ্যাই।
আধুনিকতার নেশার নাম বিলাসিতা। বিলাসিতা ক্রমবর্ধমান এক অভিশাপ। আমরা যত উন্নত হচ্ছি ততটা জোরালেভাবে আমাদের মজ্জায় মজ্জায় অভিলাষের ঘুণপোকা বাসা বাধছে। আর পাঁচজনের সাথে তালমিলিয়ে নামীদামী স্মার্টফোনের বাহারে, দামী দামী পোশাকে রঙ মেখে সঙ সেজে বন্ধু-বান্ধবের সাথে চলতে গিয়ে নেশার জগতে, বিষণ্ণতার আঁধারে, স্বপ্নের গোলকধাঁধাঁয় ওরা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে, হাবুডুবু খাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছে, যাচ্ছেই। মডেলিংয়ে ফাঁদে, চাকুরি প্রলোভনে, প্রমোশনের গ্যাঁড়াকলে, ভালোবাসার নেশায়, হতাশার যাতাকলে ওরা সবাই ধীরে ধীরে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়ে যাচ্ছে।
ওরা আর কেউ নয়- আমার বোন, আপনার সন্তান, স্ত্রী- আমাদেরই স্বজাতি। দু'হাত বাড়িয়ে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, স্নেহ দিয়ে শুধু আমরা পারি, এ সমাজ পারে ওদের পাশে দাড়াতে। পিতামাতার অবহেলায় কোনো ঐশী চাই না, অসৎসঙ্গে কোনো জুনায়েদের শাস্তি না হোক, সংসার বিচ্ছেদে গুঁটিগুঁটি পায়ে আর কোনো সাবিরা যেন মৃত্যুর দুয়ারে কড়া না নাড়ে।
তা না হলে কালকে যে কুঁড়িটি ঝড়ে যাবে সেটি যে আপনার বাগানের নয় তা কি বলা যায়?
=======0======