১১ মে এবারের মাধ্যমিক (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। গড় পাসের হার ৮৮ দশমিক ২৯। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। ফল প্রকাশের তিন সপ্তাহ পার হতে না হতেই জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের আনন্দে বজ্রাঘাত করেছে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক প্রতিবেদন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবেদনটি ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদনটি প্রশ্ন জরিপভিত্তিক। প্রশ্নের মুখোমুখী তেরজন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত মাত্র ছয়জন। প্রশ্নগুলোর বিষয়বস্তু- বাংলাদেশ সম্পর্কে আবশ্যিক সাধারণ জ্ঞান (বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টরের সংখ্যা, স্বাধীনতা দিবস, রণসংগীতের রচয়িতা, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, অপারেশন সার্চ লাইট কী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অবস্থান, বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, স্মৃতিসৌধের অবস্থান)। এ ছাড়া অতিসাধারণ কয়েকটি ভৌগোলিক প্রশ্ন (মাউন্ট এভারেস্টের অবস্থান, নেপালের রাজধানীর নাম)। পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্গত কয়েকটি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন (নিউটনের সূত্র, পিথাগোরাসের পরিচয়, কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কী। দুটি সংক্ষেপণের (জিপিএ, এসএসসি) পূর্ণ রূপ এবং একটি বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ (আমি জিপিএ পাঁচ পেয়েছি)। প্রশ্ন জরিপের শেষে ওই তেরজনের ভুল বা অসংলগ্ন উত্তরের ভিত্তিতে কয়েকজন পথিকৃৎ শিক্ষাবিদের মন্তব্যের মাধ্যমে প্রতিবেদনটির ইতি টানা হয়।
বলা যেতে পারে, প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য জিপিএ-৫ প্রাপ্ত লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর মেধা ও সামগ্রিকভাবে সরকারের শিক্ষানীতি সম্পর্কে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করা। উদ্দেশ্য সফল। দেশব্যাপী জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেছে। জিপিএ-৫ এখন সাফল্যের সোপান নয়, কলঙ্কের বোঝা। যেভাবে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে লোকজন ব্যঙ্গচিত্র তৈরি করছে, ঠাট্টা-তামাশা করছে, তা আর যা-ই হোক, কোনোভাবেই সুরুচির পরিচয় বহন করে না।
নিঃসন্দেহ, এসএসসি পাস করা যেকোনো শিক্ষার্থীর ওইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না জানাটা যথেষ্ট নিন্দনীয়। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। তবে প্রতিবেদনটি প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে আমার কয়েকটি প্রশ্ন রয়েছে। বর্ণনামতে, তেরজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জনের জিপিএ-৫ রয়েছে। অর্থাৎ প্রশ্নের সম্মুখীন মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকের কম শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ প্রাপ্ত। গাণিতিক হিসাবে প্রশ্নের সম্মুখীন এই ছয়জন এ বছরে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের মধ্যে দশমিক শূন্য শূন্য ৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। মোট সংখ্যার এক শতাংশেরও বহু নিচের কোনো অঙ্ক (০.০০৫) দিয়ে বাকি ৯৯-এর অধিক (৯৯.৯৯৫) সংখ্যাকে প্রমাণ করাটা নিতান্তই অবান্তর।
ছয়জনের উত্তরের ভিত্তিতে বাকি ১ লাখ ৯ হাজার ৭৫৫ জনের মেধাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা কোনো প্রতিবেদন পরিসংখ্যানের ভাষায় কতটা যৌক্তিক?
আমরা জানি না, সব প্রশ্ন সবাইকে করা হয়েছে কি না? সবাই কি সব প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়েছে? যাদেরকে ভুল উত্তর দিতে বা উত্তর না দিতে দেখেছি, আমরা জানি না, এরা জিপিএ কত পেয়েছে। এদের মুখমণ্ডল দেখিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা সাংবাদিকতার কোন নীতিতে পড়ে? মুখটাকে অস্পষ্ট করে প্রত্যেক উত্তরদাতার নিচে তার জিপিএ লিখে দিলে হিসাবের অঙ্কটা হয়তো আরো একটু ভালো করে বোঝা যেত। প্রতিবেদনটি দেখলে মনে হয়, কেউই কোনো উত্তর দিতে পারেনি। সত্যিই কি তাই? যদি তাই না হয়, তবে শুধু ভুল উত্তরগুলোকে দেখানো কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়?
বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা রয়েছে। আমরা ভালো করেই জানি, এখন পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন জেলায়, বিভাগে, পৃথক পৃথক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে শিক্ষার মান ভারসাম্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া, আমরা এ-ও জানি না, যাদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়েছে, তারা কি কোনো একটি নির্দিষ্ট স্কুলের, জেলার, বিভাগের, শিক্ষাবোর্ডের, না কি তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন স্থানের? এরা সবাই যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানের হয়, তাহলে তারা কি সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সব স্কুলের, জেলার, বিভাগের, শিক্ষাবোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে? বলা যেতে পারে, হাঁড়ির কয়েকটি ভাত টিপলেই বাকি সব ভাতের অবস্থা বোঝা যায়। এ কথা তখনই সত্য যখন হাঁড়ির নিচে তাপমাত্রা সমানভাবে থাকে। বাংলাদেশের সব স্কুলের, জেলার, বিভাগের, শিক্ষাবোর্ডের সব শিক্ষার্থীকে 'হাঁড়ির ভাত তত্ত্বে' বিবেচনা করা কতটা যৌক্তিক?
প্রতিবেদনটির ভূমিকার কয়েকটি শব্দ চয়ন নিয়ে আপত্তি করা যায়। যেমন : 'জিপিএ-৫ শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানে না জিপিএ মানে কী?' 'অনেকেই' মানে কতজন? তেরজনের ছয়জন (যদি ধরে নেই, এই ছয়জনের কেউই এর উত্তরটি দিতে পারেনি) যা মোট সংখ্যার অর্ধেকের কম? প্রতি ১০০ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্তর দশমিক শূন্য শূন্য পাঁচজন?
এর পরে বলা হয়েছে, 'মুখস্ত বিদ্যানির্ভর পড়াশোনা এবং শুধু ভালো ফলমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের এ অবস্থা বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।' প্রশ্ন হলো- শিক্ষার্থীদেরকে (অনুবাদটি বাদে) যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কোনটির উত্তর মুখস্ত বিদ্যানির্ভর নয়? 'মাউন্ট এভারেস্ট কোথায়?', 'জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে?' … এসব উত্তর কি মুখস্ত রাখতে হয় না? প্রতিবেদনের ভিত্তি যেসব প্রশ্ন সেসব প্রশ্নের উত্তর যদি মুখস্ত বিদ্যানির্ভর হয়, তবে মুখস্ত বিদ্যাকে কাঠগড়ায় তুলে শিক্ষানীতির সামগ্রিক সমালোচনার কোনো ভিত্তি আছে কি?
প্রতিবেদক বলেন, 'পাঠ্য বইয়ে বিভিন্ন সময়ে পড়লেও খুব কম প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে তারা।' অর্থাৎ প্রমাণিত যে, পাঠ্যে কোনো সমস্যা নেই। তবে, সমস্যাটা কোথায়? এক. ওই প্রতিবেদকের মনে নেই- স্মৃতি ধারণ একটি ব্যক্তিগত বিষয়, অন্যের যে পরিমাণ, যত দিন মনে থাকে, আমার তা নাও থাকতে পারে। আমাদের দুজনের দুই রকমের স্মৃতিশক্তির দায় শিক্ষাব্যবস্থা বা ফলাফল কোনোটার উপরই বর্তায় না। দুই. শিক্ষকরা তাদেরকে ঠিকমতো পাঠদান করেননি। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে কোনো সুস্থ সমাধান আশা করা যায় না।
সবশেষে একটি নৈতিকতার প্রশ্ন। প্রতিবেদনটি প্রচারের আগে কর্তৃপক্ষ কি কোনোভাবেই তেরজন কিশোর শিক্ষার্থীর অসম্মানের কথা, তাদের পরিবারের অমর্যাদার কথা এক বারের জন্যও ভেবে দেখলেন না? তেরটি পরিবারের সম্মান না ছিনিয়ে টিআরপি বাড়ানোর আর কোনো উপায় কি তাদের জানা ছিল না? ফেসবুকে এসব নিয়ে যারা যারপরণাই রুচিহীন ঠাট্টা-তামাশা করছেন, তারা কি একটি বারের জন্য হলেও ভেবে দেখবেন, এদের যে কেউ আপনার সন্তান হতে পারত, ছোটভাই-বোন তো হতে পারতে, তাই না? লজ্জা-ঘৃণা সহ্য না করে এদের কেউ যদি কোনোভাবে আত্মহননের পথ বেছে নেয় তবে এর দায়ভার থেকে আমাদের কি কোনো মুক্তি আছে?
শিক্ষানীতিতে, শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি থাকলে তা সমালোচনা করার অধিকার আমাদের সবার আছে। তবে, দয়া করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সে সমালোচনায় বলীর পাঠা বানাবেন না।
========0========