ফেসবুকে ধর্মপ্রচার, না অপপ্রচার?

মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
Published : 13 July 2016, 11:37 PM
Updated : 13 July 2016, 11:37 PM

ঈশ্বর কী নিয়মিত ফেসবুকিং করেন? তাঁর কী কোনো ফেসবুক একাউন্ট আছে? যদি ফেসবুক একাউন্ট থাকে, তবে সেটির আইডি কী? আইডি জানা থাকলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতাম।  রিকোয়েস্ট একসেপ্ট না করলে ফলো করতাম।  বিষয়টি বুঝতে অনেক দেরী হলো। এতদিনে ঈশ্বর বোধ হয় আমাকে ব্লক করে দিয়েছেন। তবুও, 'বেটার লেইট দ‍্যান নেভার'।  ধর্ম যেটাই হোক, অন্তত কোনো একটার লাইনে আপাতত ফলোয়ার হলেও চলবে।

আমার নিজের ফেসবুকে বিভিন্ন ধর্মের বন্ধু-বান্ধব আছে। এদের পোস্ট বা শেয়ার থেকে সময়ে সময়ে ধর্মের খাতায় নাম লেখানোর সুযোগ এসেছিল, কাজে লাগানো হয়নি।  এ রকম অনেক দাওয়াত পেয়েছিলাম- "মুসলমান হলে পোস্টটিতে লাইক না দিয়ে যাবেন না", "মুমিন হলে পোস্টটি শেয়ার করুন", "খাঁটি ঈমানদার মুসলমান হলে শেয়ার করুন", "মুসলিম হলে উত্তর দিন"।  আরও সহজ করে এমসিকিউয়ের মতো অপশন দিয়েছিলো, "আপনার রব কে? ১। আল্লাহ ২।  ভগবান"।  তারপরে বলেছিল, "কমেন্টের ঘরে মতামত দিন"।  এক বা দুই কোনোটাই লেখা হয়নি।

কেউ কেউ বাবা লোকনাথ, ভোলানাথের কৃপা নিয়ে এসেছিল, "রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও-আমিই রক্ষা করিব"।  'রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে'র কথা বললেও ফেসবুকে স্মরণের কথা তিনি বলেননি, তাই স্মরণ করিনি। গর্ব করা পাপ, তাই "গর্বের সাথে বলো 'আমি হিন্দু"- স্বামী বিবেকানন্দের এমনি এক পোস্টে কিছুই বলা হয়নি। এক পোস্ট থেকে জানলাম, "শ্রীমদ্ভগবদগীতা এমনই একটি নির্ভুল ধর্মগ্রন্থ, যা ৫০০০ বছর পরও একটি বর্ণও বিকৃত হয়নি"। এর নিচে লেখা ছিল 'হরে কৃষ্ণ' বলে 'সবাই শেয়ার করুন'।  শিবের ভক্ত হওয়ার সুযোগ এসেছিল, শ্রীকৃষ্ণের অমোঘ বাণী ফেসবুকে ট্রল করতে করতে হারিয়ে ফেলেছি। বারংবার পোক করে হতাশ মা লক্ষীর হাত ধরে ফিরে গেছে সিদ্ধিদাতা গণেশ।  শেষমেষ 'গীতার সারাংশ' পোস্টটি পেয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল- "যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে। যা হবে তা ভালই হবে। "

এরই মধ‍্যে ফেসবুকে শাক‍্যমুনি বুদ্ধের পায়ের ছাপে ত্রিশরণ এলো- "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামিঃ ধম্মং শরণং গচ্ছামিঃ সংঘং শরণং গচ্ছামি"; অর্থ 'আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম। আমি ধর্মের শরণ নিলাম। আমি সংঘের শরণ নিলাম।' যদি তিনি বলতেন, 'ফেসবুকং শরণং গচ্ছামিঃ', তবে আমি ফেসবুকের শরণ নিতাম। 'লাইক' বাটনটি চেপে দিতাম। বাটনটি ক্লিক করতে পারিনি, কারণ বুদ্ধ তাঁর আরেক পোস্টে আমায় বারণ করে বলেছিল, "পরের কৃত ও অকৃত কার্যের প্রতি লক্ষ্য না রেখে নিজের কৃত ও অকৃত কার্যের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। "

যখন আমি ত্রিশঙ্কুতে বিদগ্ধ তখনই যিশুর পোস্ট এলো, "আমিই পথ, সত‍্য আর জীবন। আমার মধ‍্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারবে না।" ভাগ‍্যিস তিনি এটা বলেননি যে, 'ফেসবুকের মধ‍্য দিয়ে না গেলে…', তাহলে তো মহা কেলেংকারীতে ফেঁসে যেতাম কারন সে পোস্টের আবেদনেও তো আমি সাড়া দিতে পারিনি।

নাহ্, ফেসবুকের পোস্ট শেয়ার করে, লাইক বাটন ক্লিক করে ঈশ্বরের ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে বা ফলোয়ার লিস্টে আর যাওয়া হলো না।

এখানেই শেষ নয়।  ফেসবুক খুললেই পাপ আর পাপ। মাছে, গাছে, মেঘে, মাংসে কোনো লেখা দেখে, "হিন্দু … ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন …" জাতীয় লেখা দেখে বা বিরাট কোহলির ছবিতে "রুকুর দোয়া পাঠরত বিরাট কোহলি" লেখা দেখে 'সুবহানাল্লাহ' লিখছি না। "শয়তানকে পাথর মারার ইচ্ছা আছে" কী না তার উত্তরে 'হ‍্যাঁ' বা 'yes' লিখছি না; রহমত বর্ষণের কোনো সংবাদের নীচে "কেউ Amin না লিখে যাবেন না" কথাটি বেমালুম ভুলে গেছি। কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের কাজ করা জঘন‍্য ধরণের দু'একটা ছবি দেখে, দোজখে শাস্তির ছবি দেখে 'নাউজুবিল্লাহ' লিখছি না। "যারা ইসলাম ও নবীজিকে নিয়ে কটুক্তি করে তাদের জিভ কেটে দেয়া উচিত। আপনি কি একমত?" প্রশ্নের নীচে কখনো লিখতে পারিনি ইসলাম শান্তির ধর্ম, এখানে হানাহানির কোনো সুযোগ নেই।

মাঝে মাঝে মোবাইল কোম্পানিগুলোর মতো বড়সড় অফারও আসে। "এই দোয়াটা ২০ জনকে send কর ইনশাহ আল্লাহ আজকে রাতে কোনো Good news পাবে আর যদি Avoid কর তাহলে আগামি ১০ বছরে অনেক কষ্ট করতে হবে PLZ ২০ জনকে send কর"; "আপনি যদি একবার শেয়ার করেন ইনশাল্লাহ আপনার নামাজের দাওয়াত হয়ে যাবে"।  দু'এক বার ধর্মীয় প্রতিযোগিতার পোস্টও দেখেছি- "দেখি জিতে কে? ইসলাম=কমেন্ট, হিন্দু = লাইক"।

শ্রী মায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দির, কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দির ইফতারের আয়োজন করেছে। মুসল্লীরা সেখানে ইফতার করছে, ইফতার শেষে নামাজ পড়ছে। এসব পোস্ট দেখতে দেখতে নতুন একটি পোস্ট পেলাম যার শিরোনামে "বিধর্মীদের বিতরণকৃত খাবার থেকে সাবধান!" ও নিচে লেখা "ইফতারের প‍্যাকেট দেখে হসনে খুশি আড়ালে তাদের বিদ্বেষ হাসে"। একেবারে সাক্ষাত চারণ কবি মুকুন্দরাম।

ফেসবুকে ধর্মান্তরের প্রচারণায় হিন্দুধর্মও কম নয়। "সনাতন ধর্ম গ্রহণ করলেন হালিমা আক্তার।  সবাই এই নতুন দিদিকে আশির্বাদ করুন। শেয়ার করে সুখবরটি সবাইকে দিন"। "যজ্ঞ করে ইসলাম ছেরে রফিক এখন হিন্দু রাজু। দেখা মাত্রই পোস্টটি শেয়ার ও দাদাকে আশির্বাদ করুন"। "আমি নিজের ইচ্ছা তেই ইসলাম ত‍্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছি। আমি মনে করি হিন্দু ধর্মই প্রকৃত ধর্ম। পোস্টটি শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুজুক দিন"। "আসলাম ছেরে সনাতন ধর্ম গ্রহণ সালমা এখন সপ্না আচার্য‍্য। সর্বচ্চ শেয়ার করুন এবং আশির্বাদ করুন"। "এবার সনাতন ধর্ম গ্রহণ করলেন নওয়াজ শরিফ এর ভাতিজি। সবাই আশির্বাদ ও শেয়ার করুন এদের জন‍্য"। বলা বাহুল‍্য, কম্পিউটার সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ বলতে পারবেন এসব সংবাদের সত‍্যতা ও ছবির কতটুকু যথার্থতা রয়েছে।

তবুও বলা যায়, এসব নির্দোষ গণপ্রচার। বিষয়টি তখনই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় যখন কোনো দুর্ঘটনাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কটাক্ষ করা হয়। যেমন, হজের সময়ে সৌদি আরবের দুর্ঘটনার একটি ছবির পোস্টে লেখা আছে "পৃথিবীর স্রেষ্ঠ মালাউন ধর্মের কাবা শরিফ ভেংগে ১৮০ জনের মৃত‍্যু। অনুগ্রহ পূর্বক সবার মাঝে শেয়ার করুন।" কোনো এক নারীর ছবিতে লেখা "ভারতের যেই সকল নারীরা ধর্ষণ এর সিকার হয়।  ধর্ষক দের ৯৯% হচ্ছে মুসলিম"। অন‍্য একটি ছবিতে টুপি পড়া একজন লোককে ইঙ্গিত করে লেখা "শিব ভক্ত লোকটির জন‍্য লাইক ও শেয়ার হবে। মুসলিম হয়েও বাবা ভোলানাথ কে মাল‍্যদান ও পূঁজা করেন প্রতিদিন। কমেন্টে লিখুন জয় বাবা  ভোলানাথ"।

মুসলমানদের মতো হিন্দুরাও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধর্মীয় শব্দাবলী ছাপা খুঁজে পায়।  এমনকি মাটির নীচের আদাও হয়ে ওঠে গণেশের প্রতিমূর্তি- "মাটির নিচে পাওয়া গনেশ আকৃতির আদা। প্রকৃতি সব সময় সনাতন ধর্মের কথাই বলে"।

ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ধর্মীয় পোস্টগুলোর অন‍্যতম দাবী। ইসলামের একটি পোস্টে লেখা "পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম হল ইসলাম ধর্ম। একমত হলে 'ইয়েস' লিখুন"। অন‍্যদিকে হিন্দু ধর্মালম্বীদের একটি পোস্ট বলছে "সনাতন ধর্ম'ই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। …শেয়ার করে অন‍্যকে দেখার সুযোগ করে দিন"। বৌদ্ধ ধর্ম আর বাদ যায় কেন? তারাও শ্রেষ্ঠত্বের দাবী তুলে পোস্ট করলো, "বৌদ্ধধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম নির্বাচিত"।

যার যার ধর্ম তার কাছে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ ধর্ম হতে হবে, তা না হলে সে তো আর সে ধর্ম পালন করবে না।  এটি খুব সহজ, স্বাভাবিক একটা বিষয়।  ধর্মীয় প্রচারণা চালানো ধর্ম পালনের অংশ বিশেষ।  আমরা শুদ্ধ প্রচারণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।  কিন্তু প্রচারণার নামে কুৎসা রটানো, মিথ্যা ছড়ানো, অন্য ধর্মকে ছোট করার চেষ্টা করা কী কোনভাবে পরিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রচারণা হতে পারে?  সকল ধর্মের দায়িত্বশীল সবার কি বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত নয়?

লক্ষ্য করলে দেখা যায় এ ধরণের প্রচারণা ছবি ভিত্তিক এবং সাধারণত ব্যক্তি বিশেষের প্রোফাইল থেকে এ ধরণের ছবি আপলোড করা হয় না। এ সব ছবি আপলোড করা হয় বিভিন্ন ধর্মের নামে চালানো কিছু ফেসবুক পেজ, গ্রুপ থেকে। বিভিন্ন ধর্মের এসব পোস্ট দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে ধর্মের প্রচারণা ব্যতিরেকে এগুলোর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য আছে। এরা পেজের লাইক, শেয়ার, কমেন্ট বৃদ্ধি করে পেজে বিজ্ঞাপন পাবার জন্য এ ধরণের মুখরোচক, চটকদার ছবি আপলোড করে। এরা ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়টি উদ্দেশ্য হলো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অস্থিতিশীল সময়ে এ ধরণের পোস্টের আধিক্য বেড়ে যায়। কোন একটি গোষ্ঠী নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জনগণের মধ্যে এ ধরণের উস্কানীমূলক পোস্ট ছড়াতে থাকে।

আমরা 'লাইক', 'শেয়ার' বা 'মন্তব‍্য' করা থেকে বিরত হলেই এ জাতীয় অপপ্রচার বন্ধ হতে পারে। প্রত‍্যেকে স্ব স্ব ধর্মকে নিয়ে সকল ধরণের অপপ্রচার রোধে পদক্ষেপ নিলেই এসব ধর্ম ব‍্যবসায়ীরা খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না। ঈশ্বরকেও ফেসবুকে সারাদিন ভক্তদের কাছ থেকে 'লাইক', 'শেয়ার' বা 'মন্তব‍্য' পাবার আশায় বসে থাকতে হবে না। তিনিও জগৎ-সংসারের কাজে আরো বেশী মনযোগি হতে পারবেন।

                                                                                         ——-

বিঃদ্রঃ- সকল ছবি ফেসবুক হতে সংগৃহীত।  বিভিন্ন পোস্ট থেকে সংগৃহীত লেখা হুবহু তুলে ধরার জন‍্যে পোস্টের বানান ও লেখার ধরণ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

 =====০=====