আমি কিন্তু নিশ্চিত নই যে, এর পরের কোনো বিসিএসে আবারও ভাইভা দিতে পারবো! এ সময়, এ সুযোগ বার বার আসতে চায় না। আবার সেই লাখো লাখো প্রিলি. পরীক্ষার্থীদের ডিঙিয়ে, হাজার হাজার লিখিত যোদ্ধাদের পিছনে ফেলে, কয়েক হাজারী ভাইভার ঘরে প্রবেশ করাটা মোটামুটিভাবে দুঃসাধ্য। যারা এ অসাধ্য সাধন করে বা করবে তাদেরকে আমি সাধারণের কাতারে ফেলতে পারি না, ওরা অসাধারণ পরীক্ষার্থী।
ওরা চাকুরি পাবে বলেই বার বার ফিরে আসে, আসতে পারে। সবাই ফিরে আসতে পারে না। জানি অনেকে পারে, তবে এটাও সত্য যে, একবারের সুপারিশকৃত প্রার্থীদের বেশীর ভাগই পরবর্তীবারে ফিরে আসে না। আমার বেলায় এর ব্যতিক্রম ঘটাবে এমন আশা করাটা যৌক্তিক ভাবছি না। অস্বাভাবিক নয় যে, বিসিএস চাকুরিতে প্রবেশের এটাই আমাদের একমাত্র অথবা শেষ সুযোগ।
দিনে দিনে এই সুযোগটি আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে না তো? মাত্র তো মাস খানিক, দেড়েক বা দুই বাকী! কোথায় আছি আমি, কেমন আমার প্রস্তুতি! যা করছি তা কি যথেষ্ট, আর কিছু কি করার বাকী আছে? আমি পিছিয়ে যাচ্ছি না তো!
কেন পিছিয়ে পড়বো? নিজের ভালোমন্দ না বোঝার মতো অতটা নাবালক আমি নই। আমি, আমরা সবাই সব বুঝি। তবুও, তবুও যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাবেস্বপ্নের বিসিএসটা এ বারের মতো অথবা চিরকালের মতো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, কোনো এক সময়ে এটা জেনে-বুঝেও হয়তো অসহায়ের মতো চুপ করে থাকবো। আমরা সেটা পারি কারণ আমাদের এটা পারতে হয়।
তবে চুপ থাকলেই কি বুকের ভেতরকার যন্ত্রণাটাকে লুকোতে পারবো? কোনো প্রবোধে কি বন্ধ হবে হৃদয়ের গহীনে নিভৃত রক্তক্ষরণ? সামাজিক বঞ্চনা, গ্লানি দুমড়ে-মুচড়ে দেবে না আমার স্বত্ত্বাকে? আমার আমি কি আমার সামনে নতজানু বসে থাকবে না, পোষা কুকুরটি যেমনি করে মনিবের পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে থাকে।
'সই কেমনে ধরিব হিয়া, আমার বধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া'…কেমনে, কাকে, কি বোঝাবো? মা-বা, ভাই-বোন, মাসী-পিসী, নানা-দাদা, নানী-দাদী, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবী, পাড়া-প্রতিবেশী –কে শুনবে আমার এই অসহায়ত্ত্বের কথা! কেনই বা শুনবে? প্রিলি., লিখিত পাস করে তিলে তিলে আমিই তো তাদেরকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছি, আমাকে ঘিরে প্রতিনিয়ত তারা কতই না স্বপ্নের জাল বুনেছে। একটি চাকুরি হবে,ভালো একটি চাকুরি, সরকারি চাকুরি- প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার চাকুরি।
'বাবা আমার গা ছুঁয়ে বলেছিলেন- / দেখিস, একদিন আমরাও- /বাবা এখন অন্ধ / আমাদের দেখা হয়নি কিছুই'… হায়রে স্বপ্প, স্বপ্নের বিসিএস! তোকে এবারও যদি না পাই, তবে তুই আর কবে ধরা দিবি? তোকে পাবার ধুঁকুনিতে আমার মা আজ বড় ক্লান্ত, বাবা পরিশ্রান্ত। বুকভরা হতাশা নিয়ে, বিষাদ নিয়ে আমার অসুস্থ পিতা, বৃদ্ধ মাতা সবাই ওপারে চলে গেলে তবেই কি তুই আসবি? তখন তোকে নিয়ে আমি কি করবো? বিজয়ের সেই হাসি তখনকে দেখবে, আনন্দে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে তখন কে কাঁদবে? অমূল্য বিসিএস, আমার কাছে তখন তোর আর কোনো মূল্য নেই।
জানি, সফলতা সবার জন্যে আসে না। তারপরেও অনেকেই তো এবার সফল হবে। তবে, কেন আমি, আপনি, আমরা ওদের দলে থাকতে পারি না, কী নেই আমাদের! আমরাও তো ওদের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি, সব বাঁধা পেরিয়ে, সবাইকে ছাড়িয়ে আজ এক মঞ্চে, একই কাতারে দাড়িয়ে আছে। তবে কেন আজ বিভেদ হবে, কেনই বা তা হতে দেব?
'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী'! আমি আরো একবার লড়তে চাই, প্রাণপণে। আমাকে ঘিরেই যাদের সব স্বপ্ন আমি তাদের সে সব স্বপ্ন নিয়েই লড়তে চাই। ওদের স্বপ্নই আজ আমার সবচে' বড় শক্তি। একবার হলেও তাদের বলতে চাই, তোমাদের স্বপ্নকে আমি কখনো হারতে দেইনি, হেরে যাবার আগে আমি এখনো হেরে যাইনি।
'মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত'…যে দিন আমার অশান্ত হবার আর কোনো কারণ থাকিবে না।