মুনির-তপন-জুয়েল

এনামুল হক
Published : 27 August 2012, 09:53 AM
Updated : 27 August 2012, 09:53 AM

ছোটবেলা প্রায়ই একটি দেয়াল লিখন চোখে পড়তো,

"মুনির জুয়েল তপন
বিপ্লবের হৃদস্পন্দন"

রাজনৈতিক পরিবারে বড় হয়েছি, তাই এই তিনটি নাম সেই সময় নিত্য উচ্চারিত হতো আমার কানে।
সিলেট শহরের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। সালটা ১৯৮৭-৮৮। পোস্টটা লিখার আগে সেই সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় বর্তমানে প্রবাসী আমার দুই বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ আমার সব ঘটনা পুরো মনে নেই। বছরদুই আগে পড়া একটি জাতীয় দৈনিক আমার স্মৃতিতে আবার নাড়া দিয়ে যায়। সিলেট শহরের শত শত সদ্য নেতাদের পেটে বোমা মারলেও তারা মুখে বলতে পারবে না কে এই মুনির-তপন-জুয়েল।
সিলেটের রক্তাক্ত রাজনীতির শুরু মুনির-তপন-জুয়েল দিয়ে।
সিলেটে স্বাধিনতা বিরোধীদের রাজনীতির শুরু এই তিন তরুনের তাজাপ্রান হরণের মধ্য দিয়ে।

কি হয়েছিলো সেইসব দিনেঃ
সাল-১৯৮৭-৮৮
এরশাদ সরকারকে বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। চারিদিকে একই সুর স্বৈরাচার হঠাও। আর আন্দোলনের কেন্দ্রে ছাত্ররা। স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলনের জন্য সিলেটের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনকে একত্রিত করে গঠিত হয়েছিল "ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ"। জামাত শিবিরের নামে যারা তখন এই শহরে রাজনীতি করত তাদের খুজে বের করতেও দূরবীন প্রয়োজন ছিলো সেই সময়ে। শিবির শহরের কয়েকটি ছাত্রাবাস কেন্দ্রীক রাজনীতি করতো, আর জামায়াত রাজনীতি সচল ছিলো নেতাদের বাসা পর্যন্ত। জামায়াতের বড় ভাইয়েরা তখন স্কুলে স্কুলে গিয়ে লিফলেট আর ফুলকুঁড়ি আসর নামে একটি অঙ্গ-সংঘটনের মাধ্যমে সচল রেখেছিলেন তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম।

তারপরও কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে সিলেটের রাজপথে নামলেন শিবিরের ক্যাডাররা।
১৯৮৭-৮৮ সালেই প্রথম সিলেটে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জামায়াত-শিবির প্রকাশ্য আসে। অস্ত্রসহ মিছিল আর সাথে ব্যাকআপে পুলিশ। ১৯৮৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেটের ছাত্ররাজনীতিতে তাণ্ডব চালায় শিবির ক্যাডাররা। ৭ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ও আওয়ামী-ছাত্রলীগ নেতা খসরুজ্জামানের ওপর হামলা চালায় শিবির ক্যাডাররা। মৃত ভেবে খসরুজ্জামানকে ফেলে রেখে যায় ক্যাডাররা।

৮, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র মহড়ার চলে সারা শহরময়। সিলেট শহর এমনিতেই ছোট আর তখনকার সিলেট শহর ছিলো মাত্র কয়েকটি গলির আর চৌরাস্তার সমাহার। শহরময় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, শিবির এসেছে শহরে!!! প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সিলেট শহরে চলে অঘোষিত ১৪৪ ধারা। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ান জামাত শিবিরের ক্যাডাররা। রাজনৈতিক অস্থিরতার নামে বন্ধ করে দেয়া হয় সিলেটের সবগুলো কলেজ। এ পরিস্থিতিতে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে সিলেটের "ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ" ২৪ সেপ্টেম্বর মৌলবাদ ও স্বৈরশাসন প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেয়।

নির্ধারিত দিনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন নিজ নিজ ব্যানারে মিছিল করে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে পৃথক পৃথকভাবে এম,সি কলেজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা। এ ঘটনায় নিহত হয় মুনির-তপন-জুয়েল।

-২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮-
"ভোরে ছাত্রশিবির কর্মীরা এমসি কলেজে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পেরে কলেজের আশপাশে জড়ো হতে শুরু করে। এ ছাড়া সিলেট আলিয়া মাদ্রাসাকে নিজেদের হেডকোয়ার্টার বানিয়ে ছাত্রশিবির নগরীর বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি, মোটরসাইকেল ও টেম্পোযোগে সশস্ত্র মহড়া দিতে শুরু করে। শিবিরের এই আকস্মিক ক্যাম্পাস দখলের ফলে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁরা কলেজের আশপাশে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

তখন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টেম্পোযোগে একদল সশস্ত্র কর্মী নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় জড় হওয়া জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর চারপাশ থেকে সশস্ত্র হামলা চালায়। মুনিরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে কোপাতে তারা রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। তপনকে ধরে রেখে বাকিরা পাথর দিয়ে তার শরীর থেতলে দেয়। আক্রমণ শেষে শিবির ক্যাডাররা টেম্পো ও মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গেলে স্থানীয় এলাকাবাসী মুমূর্ষু অবস্থায় মুনির ও তপনকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। একই সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এমসি কলেজে প্রবেশে করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। অথচ কলেজ ক্যাম্পাসে সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থানরত ছাত্রশিবির কর্মীদের পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে নিরাপদে রাখা হয়। একপর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে মুনির, তপনরে উপরে ছাত্রশিবির শাহী ঈদগাহ এলাকায় হামলা করেছে এই খবর পৌঁছালে টিলাগড়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একপর্যায়ে তাঁদের চাপের মুখে পুলিশ প্রহরায় শিবির ক্যাডাররা এমসি কলেজ ত্যাগ করে। এই বিষয়ে বলতে গিয়ে সিলেট মহানগর জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাকির আহমদ বলেন, 'দৃশ্যটা ছিল এ রকম, শিবির মিছিল করে যাচ্ছে, তাদের সামনে ও পেছনে পুলিশের গাড়ি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মিছিল তখন পাহারা দিচ্ছে আইনের লোকজন।'

শিবিরের এই মিছিল থেকেই পরবর্তী সময়ে নগরীর আম্বরখানায় স্কুলছাত্র এনামুল হক জুয়েলকে ধাওয়া করা হয়। জুয়েলের জন্য শিবির স্কুলগুলোতে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছিল না বলে তার ওপর তাদের ক্ষোভ ছিল। অস্ত্রধারী শিবির ক্যাডারদের ধাওয়া খেয়ে স্কুলছাত্র জুয়েল তখন দৌড়ে একটা মার্কেটের ছাদে উঠে যায়। অস্ত্র নিয়ে তার পেছনে পেছনে ধাওয়া করতে থাকে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে নিরুপায় জুয়েল কোনো রাস্তা খুঁজে না পেয়ে মার্কেটের এক ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ছাদে লাফ দিতে গিয়ে নিচে পড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এদিন ইসলামী ছাত্রশিবির পুলিশের সহায়তা নিয়ে নগরীর নানা স্থানে স্বাধীনতার পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়।" "তথ্যসুত্র-১"

মামলাঃ মুনির-তপন-জুয়েল খুনের অভিযোগে শিবিরের প্রায় ৫ শতাধিক জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের হয়। কিন্তু কাউকেই শাস্তি দেয়া যায়নি। অর্থ আর ক্ষমতার কাছে বিকিয়ে যান অনেক নেতা। সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মামলা হয়ে যায় পানির মতো পাতলা। আদালতের রায়ে সব আসামি্রাই খালাস পেয়ে যান। শান্ত সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাসে বর্বরোচিত ঘটনা ও রাজনীতির মোড় পরিবর্তনকারী এই ট্রিপল মার্ডারের খুনিরা পার পেয়ে যান সহজেই। সাক্ষি, আইনজীবি সহ বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ বিক্রি হয়ে যান টাকার কাছে। শুনেছি তখন নিয়মিত মিটিং বসতো তখনকার অনেক নামকরা নেতার বাসায়।

আরেকটি অদ্ভুত তথ্য শোনেন, এই মামলার রায়ে সব আসামী খালাস পেয়ে যাবার পরও আপিল হয়নি উচ্চতর আদালতে (অনেকে বলবেন করা যায়নি)
ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি অভিযুক্ত সেইসব হত্যাকারীদের, ব্যবসা-বানিজ্য থেকে শুরু করে একদম জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত হয়ে দেশ সেবা করে যাচ্ছেন। বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে কয়েকটি নাম, সিলেটের সবাই তাদের চিনে, জানে এবং তারা এখন স্বীয়-স্থানে প্রতিষ্ঠিত।

মুনির-তপন-জুয়েল তিনটি নাম মুছে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে সিলেটের রাজনীতি থেকে, ইতিহাস থেকে। আজকাল আর দেয়াল লিখন চোখে পড়ে না মুনির-তপন-জুয়েলের নামে।

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডে হারানো তিন তরুনকেঃ
মুনির ই কিবরিয়া চৌধুরী
তপন জ্যোতি দে এবং
এনামুল হক জুয়েল।

তথ্যসুত্রঃ
১।তথ্যসুত্র-১ কালেরকন্ঠ রাজকূট ২২ সেপ্টেম্বর ২০১০ (http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=Tax&pub_no=289&cat_id=3&menu_id=77&news_type_id=1&index=3&archiev=yes&arch_date=22-09-2010#.UDvge6B5sfl)
২।মুনির সম্পর্কে জানতে পড়ুনঃ http://www.opest.net/2064
৩।ছবিঃ আন্তঃজাল