লেখার শুরুতেই আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ১৯৭১ সালে পাক-বাংলাদেশ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মহুতি দেয়া মিত্রবাহিনীর হাজারো সদস্যকে, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ এই বাংলার মুক্ত বাতাসে আমি নিঃশ্বাস লই। এবং আমি মনেপ্রাণে এটাও বিশ্বাস করি যে ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য না করলে হয়তো ৯ মাসে নয়, ৯ বৎসরেও স্বাধীন হত না। এককোটি উদ্বাস্তুকে নিজ দেশে জায়গা দিয়ে, খাদ্য চিকিৎসা বাসস্থান দিয়ে যে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ভারত আমাদের দেখিয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজির বিহীন।
৬০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান বিপক্ষে যুদ্ধের দগদগে ক্ষত নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করে ভারত আর এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করে একটি মধুর আর চমৎকার প্রতিশোধ নেয়।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি, ফারাক্কা বাঁধ, বাংলাদেশের জন্য আজ যা একটি অভিশপ্ত নাম। ১৯৭০ সালে ভারত ফারাক্কা বাধের কাজ সমাপ্ত করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে ১০ দিনের জন্য গঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। লক্ষ্য করুন ৫ বছর পর ভারত অনুমতি পেয়েছিলো। সেই থেকে শুরু এবং আর তারপর ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ বাংলাদেশ। চেষ্টা তদবির কম হয়নি, বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপিত হয়েছে, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে পানি চুক্তি হয়েছে, হয়েছে শত বৈঠক। ভারত প্রতিবারই বন্ধুর মতো সবকিছুই আমাদের দিয়েছে কিন্তু তা কাগজে কলমে। শুষ্ক মৌসুমে পানি অপসারণের বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূলত মরুভূমিতে পরিনত হয়।
ভারতের নতুন বাঁধ পরিকল্পনা টিপাইমুখ বাঁধ। এই বাঁধের প্রভাবে ফারাক্কা বাঁধের মতই সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়বে তা নিশ্চিত। (বাংলাদেশ অনেক বুদ্ধিজীবী অবশ্য এই কথার বিরোধীতা করেন, যেমন বঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে অনেক বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন ফারাক্কা হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না)
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতের ভূমিকা বন্ধুত্বসুলভ নয়, আগ্রাসনমূলক। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ন্যূন্যতম বন্ধুত্বপূর্ণ আচরন ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ পায়নি। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সীমান্তে বিএসএফ গড়ে প্রতি তিনদিনে একজন করে বাংলাদেশী হত্যা করে। সীমান্ত এলাকায় পাখির মতো যারা মারা যাচ্ছে এরা মূলত চোরাকারবারী এবং স্থানীয় জনগন যারা অন্নের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় এলাকায় কাজ করে। সীমান্ত অবৈধ অতিক্রম কালে অনেক বড় অপরাধ করে আমি মানি, কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশের আইনেই অন্ততঃ বুলেট প্রাপ্য নয়।
প্রায়ই শুনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিরীহ গ্রামবাসীদের লুটপাট,মারধর, হত্যা ইত্যাদি জঘন্য কার্যকলাপ করে। কি নতজানু পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে এই দেশে আমরা বাস করছি যে কোনো কালেই কোনো সরকারই এইসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। আজও ভারত আন্তর্জাতিক আইন নীতিমালা লঙ্ঘন করে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরী অব্যাহত রেখেছে।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে আমরা বেরুবাড়ি হস্তান্তর করেছি অনেক আগেই, কিন্তু ফিরে পাইনি তিনবিঘা করিডোর । এই অঞ্চলের মানুষ স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও গত আজও উম্মুক্ত জেলখানায় বাস করছে, গতিবিধি সীমিত এবং সংরক্ষিত। পান থেকে চুন খসলেই বুলেটের ভয়। হায় স্বাধীনতা!!!
তালপট্টি নামটা অনেকের কাছেই পরিচিত। অনেকে চিনবেন নিউমূরে বললে। বাংলাদেশের জলসীমানায় জেগে উঠা এই দ্বীপ জোরপূর্বক দখলে রেখেছে ভারত। কবে কোন কালে বাংলাদেশ জোর গলায় দাবি করেছিলো এই দ্বীপের মালিকানা!!!!???? বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ নীলফামারী, পঞ্চগড় এবং আরও অনেক জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে হাজার হাজার একর জমি ভারতের দখলে।
বাংলাদেশের সীমানা ঘেষে বাংলাদেশে পাচারের জন্য তৈরী হয়েছে হাজার ফেনসিডিলের কারখানা, রয়েছে মদ আর বিয়ারের ব্যবসা। আরও আছে জাল নোট তৈরীর কারখানা। সবই চলছে ভারত সরকারের দৃষ্টি সীমানার ভিতরে, তাদের নজদারিতে। কবে কোনকালে ভারত সরকার এইসব অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করেছিলো??!!! যেনো এইসব তৈরীই হচ্ছে বাংলাদেশকে ধ্বংশ করার জন্য। আহা বন্ধুত্ব…বিনিময়ে প্রতিদিন পাচার হয়ে যাচ্ছে ডিজেল, সার সহ লাখ লাখ ভর্তুকি ভুক্ত দ্রব্যাদি। সীমান্তের দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে কাঁচা টাকাটাই মুখ্য সবসময়, দেশপ্রেম নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এইসব ক্ষেত্রে বিএসএফ এর রাইফেল কথা কয় না। সারাবছর ধরেই চলে মাদকের অবাধ চালান।
ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়েছে সবসময়। অস্ত্র দিয়েছে, দিয়েছে অর্থ। অথচ নিয়মিত ভারতীয় অভিযোগ, বাংলাদেশের মদদে ভারতে বোমা-হামলা হয়েছে,সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, ইদানিং মুম্বাই দাঙ্গায়ও তারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা খুজে পায়। এটা অনেকটা বাঘ আর হরিণের নদীতে পানি খাওয়ার মতো, বাঘ উজানে পানি খেয়ে ভাটিতে থাকা হরিণকে দোষারোপ করে পানি ঘোলা করার। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এদেশের বিগত ৪১ বছর ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার ভারতকে বন্ধুর মর্যাদায় আসীন করে তার প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে। বিভিন্ন সরকার এতেই ক্ষান্ত হয়নি, কি কি দিয়ে ভারতকে আরও শক্তিশালী আরও সমৃদ্ধ করা যায় সেই চিন্তায় যেনো ছিলো বিভোর, সুযোগে সদ্ব্যবহার করে ভারতও বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সরাসরি করেছে হস্তক্ষেপ।
বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারত সবসময় সুযোগ নিয়েছে বাংলাদেশের কাছ থেকে, বিপরিতে নূন্যতম সুযোগও দেয়নি বাংলাদেশকে। রহিম-আফরোজ ব্যাটারী আসাম-মিজোরামে ব্যবসা প্রসার করতে গিয়ে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। বাংলাদেশের সাথে ভারতের রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। ভারতের আরোপিত শর্তের কারণে এদেশীয় পণ্য ভারতে রপ্তানী করা যায় না। আর আমাদের বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজার। ভারত ইচ্ছে করলেই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানী বাড়াতে পারে, পণ্যের উপর ধার্যকৃত শুল্ক কম করতে পারে কিনবা তুলে নিতে পারে, কিন্তা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত তা কখনোই করেনি, এবং আমার বিশ্বাস তা করবেও না।
বাংলাদেশ থেকে চাকরী দেবার লোভ দেখিয়ে লাখ লাখ কমবয়সী যুবতী মেয়েদের সহজেই সীমান্তের অপারে নিয়ে দেহ ব্যবসায় লাগানো হচ্ছে। ভারত সরকার চাইলেই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা বন্ধ করতে পারে। শুধুমাত্র সীমান্ত অতিক্রমের মতো অপরাধে বছরের পর বছর হাজারো বাংলাদেশী আটক রয়েছেন ভারতের জেলহাজতে। তাদের কন্ঠস্বর কেউ শোনে না, না এদেশের মানবাধিকার সংস্থা, না ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা।
"ফেলানী" নামটা আজকাল সিম্বলিক হয়ে গেছে। নামটা শোনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কাঁটাতার, আর সেই কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী লাশ। কতই বা বয়স!! ১২? ১৪? আমরা জানি বুলেট লাগার কয়েক ঘন্টা পরও লাশটা ঝুলে ছিলো কাঁটাতারে এবং তখনও দেহে প্রান ছিলো। দূর থেকে নড়াচড়া দেখেছে সবাই, বিএসএফ এর নওজোয়ানরা নিশানা ঠিক মতো লাগানোর পর পাখিটা কিভাবে ছটফট করে মারা গেলো তা বাইনিকোলার লাগিয়ে দেখেছে। আমি এইসব দেখার পরও কেনো যে বেচে আছি নিজেও জানি না। আত্মহত্যা যদি পাপ না হতো তবে আজই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতাম, এই সুখকর স্বাধীনতার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।
বেশ কিছুদিন আগে ছোট একটি কবিতা লিখেছিলাম, তাই দিয়ে শেষ করি-
রঙ্গিন পর্দা জুড়ে থাকে শীলার যৌবন নৃত্য
নগ্ন নাভীমূল, ফর্সা উরু—
মুন্নির বদনামের দৃশ্য হা করে দেখি
কখনো শেষ, কখনো শুরু—
ফেলানির লাশ কাঁটাতারে পড়ে রয়
আর যাই হোক,
এ স্বাধীনতা নয়
এ স্বাধীনতা নয়
এ স্বাধীনতা নয়।
(উন্নতমানের খিচুড়ি-আসুন সবাই মিলে খাই-পরি চুড়ি, হিজড়া সম্প্রদায় চুড়ি পড়ে)
-এনাম, ২৮শে অগাস্ট/২০১২-মধ্যরাত্রি
সাহায্য নিয়েছিঃ বিভিন্ন ব্লগিয় অনুসন্ধান, গোগল অনুসন্ধান, দৈনিক পত্রিকাসমূহ ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে লিখা যারা আড় চোখে দেখছেন তাদের জন্য স্যারের একটি বাণী বোনাস হিসেবে – "পাকিস্তানীদের আমি অবিশ্বাস করি, তারা যখন গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও"