ঢাবি‘র ১১ শিক্ষার্থী এবং অতিরঞ্জিত খবর কি স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার?

এনামুল হক
Published : 12 Nov 2014, 05:48 PM
Updated : 12 Nov 2014, 05:48 PM

গতকাল রাতে আরটিভিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ড. তুহিন মালিকের বক্তব্য আমায় ব্যথিত করেছে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আমাদের সবার জানা, সময় সুযোগে আওয়ামী-সরকারকে একহাত দেখে নিতে কখনোই দ্বিধাবোধ করেন না। এটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাজনীতিতে মত-বিভেদ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। গতকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দুটি বিষয়ে কথা বলেছেন,
এক, পর্নো সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১জন গ্রেফতার
দুই. নেকাব পরা এবং নামাজ পড়ায় বাধা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল থেকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এই বিদ্যালয়কে নিয়ে কথা বলার পূর্বে ড. তুহিন মালিককে দ্বিতীয়বার চিন্তা করা উচিত ছিলো। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আঙ্গুল তোলার পূর্বে ভেবে দেখা উচিত ছিলো কোনো ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র স্থলনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটা দায়ী। আমি নিশ্চিত তিনি তথাকথিত ইসলামিক দলীয় বা জাতীয়তাবাদী অনলাইন নিউজ নিয়মিত পড়েন। অনলাইনে নিউজটি যেভাবে বিকৃতভাবে উপস্থাপন হয়েছে তিনি একইভাবে টক-শোতে বর্ণনা করেছেন, পর্ণো সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১জন গ্রেফতার। মূল নিউজটি ছিলো, "হোটেল থেকে ৪ তরুণীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে আটক হয়েছে। এসময় তাদের কাছ থেকে ভিডিও ক্যামেরা, পর্ণ ম্যাগাজিন, ল্যাপটপ ও পর্ণ সিডি উদ্ধার করা হয়। আটকের সময় তাদের সঙ্গে ছিল আরো ৫ ব্যক্তি।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ১১জন নয়, তা ২ জনই। হোক ২ জন, এই ধরণের অনৈতিক কাজে জড়িত ব্যাপারটি অতি অবশ্যই লজ্জার। কিন্তু এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দোষারোপের আঙ্গুল তোলা শুধু মাত্র নিজ হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর শত শত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রী সবার নৈতিক চরিত্র ভালো কিংবা তারা একটি ভালো পরিবার থেকে উঠে এসেছে তা প্রমাণ করে না। আর সব ভালো ছাত্রের নৈতিক চরিত্রও ভালো হবে তা আশা করাও ঠিক নয়। ভর্তি হওয়া শত শত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে কয়েকজন এই রকম পারভার্টেড হবে না, অনৈতিক হবে না কিংবা মানসিক ভাবে অসুস্থ হবে না তা দাবী খোদ বিশ্ববিদ্যালয় এমন কি ঐ ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারও করতে পারবে না। এটা আসলে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর মানসিকতার বিষয়। যারা পর্ণোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত তারা আসলে ঐ লেভেলের পরিবার থেকেই এসেছে বা ঐ ধরণের সঙ্গের সহিত তাদের উঠবস । ঢাবিতে চান্স পেয়েছে হয়তো ভাগ্যের জোরে। আর এখন তাদের চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।

প্রমাণের ভিত্তিতে শব্দটি ব্যবহার করলাম কারণ বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্ম পদ্ধতি আমাদের সবার জানা। মাত্র কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাদের কিছু লোক যদি হত্যাকাণ্ডের মত ঘৃণ্য কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে তবে দুই-একজনকে শত্রুতাবশতঃ ঐ রকম কুৎসিত মামলাতে ফাঁসিয়ে দেয়াও কোনো ব্যাপার নয়। লক্ষ্য করুন, আমি আটক ছাত্র দুইজনে পক্ষাবলম্বন করছি না, বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলছি। ছেলে দুটিকে নির্দোষ দাবী করছি না, অবশ্যই বিশ্বাস করতে চাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সঠিক সময়ে সঠিক অপরাধীকেই গ্রেফতার করেছে।

ড. তুহিন মালিক নিশ্চয় দারুণ খুশি হতেন যদি ঐ দুটি ছাত্র যদি সরকার দলীয় ছাত্র সংঘটনের সমর্থক বা কর্মী হতেন, টক-শোতে গলাবাজি করে আরো বাহবা পাওয়া যেতো।
একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, প্রায়শই বিভিন্ন মাদ্রাসাতে নাবালকদের সাথে শিক্ষক নামের কিছু পশুর অনৈতিক সম্পর্কে স্থাপনের জঘন্য খবরও কিন্তু পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। এইজন্য আমি যদি মাদ্রাসাকে বা তাবৎ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে দোষারোপ করি তবে ব্যাপারটা অবশ্যই উদ্দেশ্যমূলক এবং আমার ব্যক্তিগত বা কোনো নির্দিষ্ট-গুষ্টির স্বার্থসিদ্ধির দুর-সন্ধিমূলক হীন বুদ্ধি হিসেবেই বিবেচিত হবে।

দ্বিতীয়, ড. তুহিন মালিকের অভিযোগ মতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে শারীরিক ও মানসিকভাবে যেভাবে নির্যাতন চালানো হলো তা সত্যিই ন্যক্কারজনক ও দুঃখজনক। নামাজ পড়লে, কোরআন-হাদিস, ইসলামী বই রাখলে এবং পর্দার বিধানসহ ইসলামী অনুশাসন মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার দরুন ছাত্রীদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ঘটনাটি ঘটে শামসুন্নাহার হলে।

তুহিন মালিক সাহেব ঘটনাটি আরটিভিতে বলার আগেই ফেইসবুক মারফত তা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ফেইসবুক নিউজফিডের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, তাই ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু তুহিন মালিকের মত মানুষ যখন ঘটনাটি নিয়ে টিভি পর্দায় কথা বলেন তখন ইচ্ছে হলো ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করি। আমার পরিচিত যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন তাদের কাছে ঘটনাটি সম্পর্কে তারা কিছুই বলতে পারলেন না। তারাও আমার মত অনলাইনে নিউজটি দেখেছেন।

আমার প্রশ্ন হলো, এই রকম ঘটনা যদি থাকে তবে শুধু ঐ দুই ছাত্রীর ক্ষেত্রেই কেনো ঘটলো?? আমার পরিচিত অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রী নিবাসে থাকেন, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ঐ দুই ছাত্রী কি নামাজ এবং ধর্মীয় আবহের আড়ালে কোনো নির্দিষ্ট দলের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কাজ করছেন?

একটি ঘটনা বললে কি বলতে চাচ্ছি পরিষ্কার হবে। ঘটনাটি আমার এক বন্ধুর মুখে শুনা, ২০১৩সালের উত্তাল সময়ের। হরতালের দিন আমার বন্ধুটি তার এলাকার মসজিদে আসরের নামাজের জন্য গেছে। ফরজ নামাজ শুরুর পর যখনই সবাই রুকুতে গেলো তখন তার সামনের কাতারের কারো কোমর থেকে সশব্দে ধাতব কিছু নিচে মেঝেতে পড়ে গেলো। সাথে সাথে নামাজ ভেঙ্গে সেই ছেলেটি সেই ধাতব "কিছু" সাবধানে তুলে নিলো। আমার বন্ধুর চোখ পড়ে যাওয়ায় সে ঠিকই চিনতে পারলো সেই ধাতব বস্তুটি একটি আগ্নেয়াস্ত্র। আর সেই ছেলেটি হরতাল সমর্থনকারী তথাকথিত "ইসলামী" দলের সদস্য।

যারা নিজ দলের স্বার্থে ইবাদতের স্থানের মত পবিত্র জায়গায় "অস্ত্র" নিয়ে প্রবেশ করতে পারে, যারা ধর্মকে ঢাল বানিয়ে নিজ দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, ধর্মের নামে রাজনীতি করে হরতালের মত অধর্মীয় কার্যপন্থা অবলম্বন করে দেশের নিরীহ মানুষের কষ্টের কারণ হয় তারা আর যাই হোক অন্তত ইসলামের বন্ধু নয়। (আজ পর্যন্ত দেখিনি, হরতালে কোনো সরকারের কোনো প্রকার ক্ষতি হতে, যা হয় তা সাধারণ মানুষেরই হয়)।
যাই হোক, ছাত্রী হলের সেই ঘটনায় ফিরে আসি। যদি এই ধরণের ঘটনা সত্যিই ঘটে থাকে, আন্তরিকভাবে অবশ্যই চাইবো মূল ঘটনার তদন্ত হোক। কেনো, কাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করা হলো, কারা করলো, কখন করলো, তখন হোস্টেল/হল কর্তৃপক্ষই বা কোথায় ছিলেন? শত শত ছাত্রী থাকতে ঐ দুই ছাত্রীকেই কেনো?? নাকি ঘটনার সাথে তাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা জড়িত???

একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, বর্তমান সময়ে চুন থেকে পান খসলে সবকিছুতেই ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির হীন চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সব ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে। কারা কি উদ্দেশ্যে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে কি করতে চাই আমরা সবই জানি এবং বুঝি। আমরা বুঝলে তো হবে না, ব্যাপারটা বুঝতে হবে সরকারের, প্রশাসনের। দেরি করলে, অতীতের মত অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। নিকট অতীতে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে কি পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে সেই স্মৃতির ক্ষত এখনো দগদগে।

সবাইকে অনুরোধ করবো, অনলাইনে যা পড়বেন, সবই বিশ্বাস করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। শুধু একটি বার স্থির চিত্তে পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন, খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করবেন। ছাপার অক্ষরে যা থাকে তা সব সময় পুরোটা সত্য নাও হতে পারে।সবার বুদ্ধির বিকাশ ঘটুক, সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার অন্তর চক্ষু খোলে দিন, এই কামনাই করি।