রমজান মাসে খাদ্যাভ্যাস- আলোচনা এবং কিছু প্রশ্নোত্তর

এনামুল হক
Published : 17 June 2015, 05:05 PM
Updated : 17 June 2015, 05:05 PM

সংযমের মাস পবিত্র রমজান। সঠিক নিয়মে রোজা রেখে, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময়ে আহার করলে রোজা দিতে পারে আপনাকে চমৎকার স্বাস্থ্য। কিন্তু সংযমের মাসে যে ভোজন উৎসব আমরা করি, তাতে হিতে বিপরীত হয়।
ক্ষুদার্থ শরীর শক্তি উৎপাদনের প্রয়োজনে সঞ্চিত চর্বি ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করতে থাকে, দীর্ঘক্ষণ ক্ষুদার্থ থাকার ফলে শরীরে জমাকৃত আমিষ ভাংতে থাকে, সঠিক নিয়মে সঠিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ না করলে এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে যায়। আর একটি ব্যাপার, রমযান মাস শুধু ডায়েট কন্ট্রোল বা ওজন কমানোর মাস নয়। এতে শারীরিক ব্যাপার থেকে আত্মিক বিষয় বেশি জড়িত। শরীর ও মনের সংযোগে সঠিক উপায়ে সংযম এবং এবাদতের মাধ্যমে রমযানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করা সম্ভব।

রমজান মাসে শারীরিক পরিবর্তন স্বাভাবিক, তা দীর্ঘক্ষণ পানাহার ব্যতীত থাকার সুফল। সেহরির সময়ে খাদ্য গ্রহণ করার পর থেকে ইফতার পর্যন্ত দীর্ঘ ১০-১২ ঘণ্টা বা কোনো দেশে ১৬-১৮ ঘণ্টা সময় খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়। তাই সেহরিতে ভারি খাবার এবং ইফতারে হালকা খাবার থাকা শ্রেয়।

সেহরিতে শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবার শরীরের শক্তি দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে সাহায্য করে। দীর্ঘক্ষণ অনাহারে থাকলেও শরীরের পেশিকে মজবুত রাখে, কোলেস্টেরল রাখে নিয়ন্ত্রণে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ এবং উচ্চ-রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। শরীরে জমাকৃত অতিরিক্ত চর্বি ভেঙ্গে শরীর হালকা হয়। বলা চলে, রমযান মাসে শরীরে এক ধরণের নির্বিষকরণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

এ সময়ে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং প্রচুর পানি পান করা জরুরি। কিডনি যা আমাদের শরীরের পানি ও লবণের ভারসাম্য বিশেষ করে সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, দীর্ঘক্ষণ অনাহারে থাকার ফলে অস্বস্থিতে ভোগতে হতে পারে, বিশেষ করে গ্রীষ্ম প্রধান দেশগুলোতে। তাই সেহরি ও ইফতারে প্রচুর পরিমাণে পানি পান না করলে কিডনি রোগসহ মূত্রনালির নানা সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে।

কখনোই ভরপেট খেয়ে রোজা ভাঙ্গা ঠিক নয়। আহারে সতর্ক না থাকলে রমযান মাসেই যে কারো ওজন অনেক বেড়ে যেতে পারে। দিন শেষে ইফতারে বসে ভুলে গেলে চলবে না, রমযান মাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যই হলো, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মসংযম।

সুষম খাদ্য:
যারা রোজা রাখেন তারা ২৪ ঘণ্টায় অন্তত দুইবার মূল খাদ্য গ্রহণ করেন। সেহরি এবং ইফতারে। খাদ্য তালিকায় বিশেষ পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিক-ভাবে আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তাই যথেষ্ট। যেমন-
ফলমূল, শাকসবজি (ভিটামিন ও মিনারেলস)
রুটি, ভাত, আলু (শর্করা)
মাছ, মাংস বা প্রাণীজ আমিষ
দুধ এবং দুধ জাতীয় খাবার
চর্বি ও চিনি যুক্ত খাবার।

সেহরি ও ইফতারে যা খাওয়া উচিত নয়:
পেস্ট্রি কেক, ক্রিম, চকোলেট, বিস্কিট। চা, কফি বা ক্যাফেইন যুক্ত পানীয় (কোলা)। ক্যাফেইন মূত্রবর্ধক, তা শরীর থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে পানি বের করে দেয়। মনে রাখবেন, সেহরির খাবার হওয়া উচিত পরিপূর্ণ পুষ্টিকর, যা আপনাকে সারাদিনের শক্তি যোগান দেবে। আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, মিনারেলস, খনিজ লবণ সমৃদ্ধ, যা আপনাকে রাখবে সারাদিন কর্মক্ষম।

ইফতারে কী খাবেন?
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ অনুযায়ী ইফতার করা উচিত খেজুর দিয়ে। খেজুরে প্রচুর পরিমাণে প্রাণশক্তি আছে যা আপনাকে নিমিষেই চাঙা করে তুলবে। ফলের রসেও এই রকম জীবনী শক্তি আছে। পানিয় দিয়ে ইফতার শুরু করলে একদিকে যেমন সারাদিনের পানি শূন্যতা দূর হবে, অন্যদিকে তৃষ্ণাও মিটবে। তেল জাতীয় ভাজাপোড়া খাবার অবশ্যই ইফতারে বর্জন করা উচিত।

যেসব খাবার ইফতারে পরিহার করা উচিত:
বেশি ভাজা খাবার, যেমন: পাকোড়া, পিয়াজু, বেগুনি, ভুনা চানা বা তেলেভাজা নাস্তা।
তেল চিনিযুক্ত খাবার, যেমন: মিষ্টি, গোলাবজাম, রসগোল্লা, বালুসাই, মিষ্টি বা টক দই।
অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, যেমন: তেলে ভাজা পরোটা, চর্বিযুক্ত তৈলাক্ত তরকারি, পেস্ট্রি।

স্বাস্থ্যকর পরিপূরক ইফতারের নাস্তা যেমন হওয়া উচিত-
বেক করা সমুচা, সিদ্ধ পেঁয়াজু, তেল ছাড়া পরোটা, চাপাতি, গ্রিল করা মুরগীর মাংস, বাড়িতে তৈরি পাতলা খিচুড়ি, যাতে শাকসবজি দেয়া থাকবে। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, সেদ্ধ মটরশুটি/চানা, দুধ বা দুধ সমৃদ্ধ ঘরে তৈরি খাবার, ডিম, ডিমের পুডিং ইত্যাদি।
রমযান মাসে অবশ্যই বর্জনীয় রান্না পদ্ধতিগুলো
অতিরিক্ত ভাজাপোড়া রান্না।
অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করা রান্না।

স্বাস্থ্যসম্মত রান্না পদ্ধতি
কম তেলে হালকাভাবে ভাজা। এতে স্বাদের ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু তা স্বাস্থ্যসম্মত। সম্ভব হলে মাছ মাংস ওভেনে রান্না করা যায়, এতে স্বাদের ভিন্নতা আসবে না, রান্না করা খাবারও স্বাস্থ্য সম্মত হবে।

কিছু জরুরি প্রশ্নের উত্তর…

প্রশ্নঃ ডায়াবেটিস রোগীদের কি রোজা রাখা উচিত?
উত্তরঃ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আহার নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন হয়। রমযান মাসে একটু নিয়ম মেনে চললে ডায়াবেটিস রোগীদের কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। তবে রোগী কী ঔষধ গ্রহণ করছেন, রমযান মাসে সেই ঔষধের মাত্রা এবং খাওয়ার সময় ও নিয়ম কী হবে, তা নিয়ে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ মতে ইনসুলিনের মাত্রা এবং তা ইফতারে নাকি সেহরির সময় নেয়া হবে, জেনে নেয়া উচিত। যাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত, দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে কিডনি, লিভার, পায়ে ইনফেকশন বা অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যধিতে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা না রাখার অনুমতি ইসলামে দেয়া আছে। এ অবস্থায় রোজা রাখতে না পারার কারণে করণীয় কী, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ আলেমের পরামর্শ নেয়া উচিত।

প্রশ্নঃ মাইগ্রেনের রোগীদের কি রোজা রাখা উচিত?
উত্তরঃ আজকাল বাজারে মাইগ্রেনের ভালো ঔষধ পাওয়া যায়, যা সেবনে মাইগ্রেন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ঔষধ সেবন করলে রোজা রাখতে কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্নঃ উচ্চ রক্তচাপ কিংবা নিম্ন রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের কি রোজা রাখা উচিত?
উত্তরঃ উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ মত ঔষধ সেবন করে রোজা রাখা যাবে। রমযান মাসে ঔষধের মাত্রা এবং সেবনের সময় জানা জরুরি। নি¤œ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীরা অন্য কোনো রোগে না ভোগলে রোজা রাখতে কোনো প্রকার সমস্যা হয় না। তবে তাদের সুষম খাবার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা উচিত।

প্রশ্নঃ গর্ভবতী মহিলারা কি রোজা রাখতে পারেন?
উত্তরঃ অবশ্যই পারেন, যদি তারা যথেষ্ট পরিমাণ সুস্থতা বোধ করেন। গর্ভবতী অবস্থায় অনেক মহিলাই অত্যধিক কাহিল এবং ঘন ঘন বমি করেন। এ ক্ষেত্রে ইসলামই তাদের রোজা রাখা থেকে বিরত থাকার অনুমতি দিয়েছে। তবে বাদ পড়ে যাওয়া রোজাগুলো পরে (ক্বাজা) রাখতে হবে।

প্রশ্নঃ শিশুরা কি রোজা রাখতে পারবে?
উত্তরঃ হ্যাঁ পারবে, সেই ক্ষেত্রে শিশুর বয়স আট বৎসর হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে শুরুতে শিশুদের ক্ষেত্রে ঘণ্টা হিসেবে রোজা রাখানো শ্রেয়। যেমন ৪ ঘণ্টার রোযা, ৬ ঘণ্টার রোযা। এতে একটি পূর্ণ দিন রোজা রাখার জন্য তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যাবে।

প্রশ্নঃ রোজা রেখে হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে কি?
উত্তরঃ ইনহেলার একটি জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় ঔষধ। শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য অপরিহার্য। ইনহেলার ব্যবহারে এর ঔষধ ফুসফুসে পৌঁছায়, পাকস্থলীতে নয়। তাছাড়া ইহা খাদ্য হিসেবে গ্রহণও করা সম্ভব নয়। তাই ইনহেলার ব্যবহারে কোনো বাধা নেই।

প্রশ্নঃ হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালনরত কেউ রোজা রাখতে পারবেন কিনা?
উত্তরঃ চিকিৎসারত রক্ত গ্রহীতা রোজা রাখতে পারবেন না। যখন রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন নেই, তখন তারা রোজা রাখতে পারবেন। কারো জীবন রক্ষার জরুরি প্রয়োজনে রক্ত প্রদানকারীও রোজা রাখা থেকে বিরত থাকা উচিত।

প্রশ্নঃ নিয়মিত ঔষধ সেবন করার ক্ষেত্রে কি রোজা রাখা যাবে?
উত্তরঃ যদি রোজা রাখা অবস্থায় ঔষধ সেবনের অতীব প্রয়োজন হয় তবে রোজা রাখা যাবে না আর ইসলামেও সে সুযোগ দেয়া আছে। যদি স্বল্প সময়ের চিকিৎসার জন্য ঔষধ সেবনের প্রয়োজন হয় তবে সেই রোজাগুলো সুস্থ হওয়ার পর পালন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করে সেটা পরিবর্তন করা যেতে পারে, যেন রোজা পরবর্তী সময়ে সেটা সেবন করা যায়। যদি আপনার অসুস্থতা গুরুতর অথবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তবে রোজা রাখবেন না। ঔষধ সেবনের জন্য পরবর্তীতে অনাদায়কৃত রোজা আদায় করবেন বা যারা অক্ষম তারা কাফফারা আদায় করবেন। রোজার কাফফারা বিষয়ে জানতে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন।

প্রশ্নঃ বুকের দুধ খাওয়ালে রোজা রাখা যাবে কিনা?
উত্তরঃ ইসলামী রীতি অনুযায়ী, খুব বেশি শারীরিক দুর্বলতা না থাকলে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় মা রোজা রাখতে পারবেন। একান্ত অপারগতায় ক্বাযা আদায় করবেন।

প্রশ্নঃ রোজা রাখা অবস্থায় ট্যাবলেট গ্রহণ, ইনজেকশন নেয়া অথবা প্যাচ ব্যবহার করা যাবে?
উত্তরঃ ট্যাবলেট গ্রহণ করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু ইনজেকশন (স্যালাইন নয়), প্যাচ, ব্যবহারে রোজা ভঙ্গ হয় না। কারণ এগুলো খাদ্য বা পানীয় কোনটিই নয়। কানের ড্রপ, চোখের ড্রপ যদি অল্প পরিমানে ব্যবহার করা হয়, যে পরিমাণ ব্যবহারের ফলে সেটা কণ্ঠনালি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় না, তাহলে রোজা অবস্থায় ব্যবহার করা যায়। আর পরিমানে বেশি হয় এবং গলায় স্বাদ অনুভূত হয়, তাহলে রোজা অবস্থায় এসব ড্রপ ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামিক আইনে অসুস্থ ব্যক্তিদের রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।

প্রশ্নঃ পানিশূন্যতার কারণে কি রোজা ভঙ্গের মত পরিস্থিতি আসতে পারে?
উত্তরঃ হ্যাঁ। রোজা শুরু করার পূর্বে ঠিকমত পানি পান না করা হলে অতিরিক্ত পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। বৈরী আবহাওয়া, এমনকি দৈনন্দিন কার্যকলাপও (যেমন হাঁটাচলা, গৃহস্থালি কাজকর্ম) পানি-স্বল্পতাকে ক্রমশ খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদি প্রশ্রাবের পরিমাণ খুব অল্প হয়, অথবা প্রশ্রাব না হয়, যদি আপনি বেশি অস্বস্তি বোধ করেন অথবা পানিশূন্যতার কারণে অজ্ঞান হয়ে যান, তখন আপনার উচিৎ রোজা ভঙ্গ করা এবং পানি অথবা পানিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা। ইসলাম কখনোই স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে সিয়াম পালনকে সমর্থন করে না। এমন পরিস্থিতিতে রোজাটি রমযানের পরে কাজা আদায় করতে হবে।

প্রশ্নঃ ডায়ালাইসিস চলাকালীন সময়ে কি রোজা রাখা যাবে?
উত্তরঃ পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস চলাকালীন সময়ে রোজা রাখা যাবে না। সাধারণত সপ্তাহে তিনদিন হিমোডায়ালাইসিস করা হয়, যার ফলে শরীরে তরল লবণের পরিমাণের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রে রোজা রাখা মোটেও উচিৎ নয়। এক্ষেত্রে সুস্থ হবার পর ক্বাজা আদায় করতে হবে। আর যদি কখনো আর পরিপূর্ণ সুস্থ না হন, সে ক্ষেত্রে কাফফারা আদায় করতে হবে, যেমন একটি রোজার পরিবর্তে একজনকে তিন-বেলা খাওয়ানো।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

রোজা রাখার ফলে উদ্ভূত কিছু সাধারণ জটিলতা প্রতিরোধ ও প্রতিকার-

রোজা এবং এসিডিটি (অম্লদাহ/বুকজ্বালা)
রোজা সাধারণত পাকস্থলীর এসিড কমায়। সেটা খাবার হজম ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। খাবারের চিন্তা করা বা গন্ধ নেওয়ার ফলে মস্তিষ্ক পাকস্থলীকে বেশি এসিড উৎপাদনের জন্য আদেশ দেয়। যারা প্রতিদিন বদহজমের জন্য ঔষধ গ্রহণ করেন যেমন এন্টাসিড, এন্টি হিস্টামিন বা প্রোটন পাম্প নিরোধক, তাদের তা চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। আর খাবারের আগে তা গ্রহণ করার ভাল সময়।
অম্লদাহ এবং ঢেকুর তোলা নিয়ন্ত্রণ করাকে সাহায্য করবে তৈলজাতীয়, ভাজা-পুড়া বা বেশি ঝাল খাবার নিয়ন্ত্রণ করা বা ছেড়ে দেওয়া। ভোজ্য তৈল দিয়ে তৈরি খাবার ঢেকুর তোলা এবং পেটের প্রদাহকে কমাবে এবং বালিশ দিয়ে উঁচু হয়ে ঘুমানো দীর্ঘকালীন ওজন হ্রাস ও বুকজ্বালা প্রতিরোধে সাহায্য করবে।

রোজা এবং অনিয়ন্ত্রণ ডায়বেটিস
অল্প বা দীর্ঘদিন ধরে যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন তাদের জন্য রোজা থাকার ক্ষেত্রে এবং যাদের ডায়াবেটিক ঔষধ সেবনে নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাদের অবশ্যই রোজা শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিদিন নিজে রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। রক্তে গ্লুকোজ লেভেল কমে যাওয়া বিপদজনক এবং এতে মাথা ঘুরানো বা বেহুশ হয়ে যেতে পারে যদি তা চিকিৎসা করা না হয়।
মাথা ঝিমঝিম করা, ঘামানো এবং বাকরোধ হওয়া গ্লুকোজ কমে যাওয়ার লক্ষণ। যদি ডায়াবেটিক রোগীদের এই লক্ষণগুলো থাকে তাহলে তাদের অবশ্যই রোজা ভঙ্গ করে চিনির শরবত খেতে হবে অথবা তাদের জিহ্বার নিচে চিনি বা মিষ্টি রাখতে হবে।

রোজা এবং মাথা ব্যথা
এই সাধারণ সমস্যার অনেক কারণ রয়েছে। রোজার সময়ে ক্ষুধা এবং পানিশূন্যতার কারণে মাথা ব্যথা হতে পারে। এছাড়া অল্প বিশ্রাম অথবা নেশা-দ্রব্যের অনুপস্থিতি যেমন ক্যাফেইন বা নিকোটিনের (যারা এগুলোতে অভ্যস্ত) কারণেও হতে পারে। সুষম আহারে সেহরি, যথেষ্ট পানি পান করা এবং প্রয়োজনে সেহরিতে ব্যথা নিবারক যেমন প্যারাসিটামল মাথা ব্যথার ঝুঁকি কমাতে এবং প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া সূর্যের আলোতে না গিয়ে, টুপি পরে বাইরে গিয়ে, সূর্যরশ্মি থেকে বাঁচার জন্য সানগ্লাস পরে এবং শক্ত ঘাড়ের মাংসপেশিকে হালকা ম্যাসেজ করেও মাথা ব্যথা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

রোজা এবং পানিশুন্যতা
রমযানের সময় পানিশুন্যতা একটি সাধারণ বিষয়। শরীর থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘাম এবং প্রশ্রাবের সাথে পানি ও লবণ বের হয়ে যেতে থাকে। যদি আপনি রোজার আগের যথেষ্ট পানি পান না করেন, তাহলে পানিশূন্যতার ঝুঁকি বাড়ে। বয়স্ক ব্যক্তি এবং মূত্রবর্ধক ঔষধ গ্রহণকারীদের এই ঝুঁকি বেশি থাকে। যদি আপনি মাথা ঘোরার জন্য দাঁড়াতে না পারেন অথবা শারীরিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগেন, তাহলে আপনার অবশ্যই নিয়মিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে পানির সাথে চিনি এবং লবণ মিশিয়ে পান করতে হবে। যদি আপনি পানিশূন্যতার কারণে অজ্ঞান হন, তাহলে অন্য কাউকে আপনার মেঝে শুইয়ে দিয়ে পা'কে উপরের দিকে তুলতে হবে। যখন আপনি জ্ঞান ফিরে পাবেন, তখন আপনাকে উপরোক্ত নিয়মে জরুরি ভিত্তিতে পানি পান করতে হবে ।

রোজা এবং কৌষ্টকাঠিন্য
রমজান মাসে প্রচুর পরিমাণে পানি পান এবং আঁশযুক্ত খাবার আপনাকে এই ধরণের অসুবিধা থেকে মুক্তি দিতে পারে। প্রয়োজনে ইসবগুলের ভুষি খান। ইসবগুলের ভুষি ভিজিয়ে না রেখে ইফতার বা সেহরিতে তৎক্ষণাৎ পানিতে মিশ্রিত করে খাবেন। এতে ভালো ফল পাওয়া যায়।

সতর্কতা
সেহরি এবং ইফতারে অত্যধিক পরিমাণে খাওয়া দাওয়ার কারণে শরীরের ওজন রমযান মাসে কমার বদলে বেড়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে রমযান মাস সংযমের মাস। সারাদিন ক্ষুদার্থ ছিলাম তাই ইফতারে বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে ইফতারে হালকা পরিমাণে খেয়ে তারাবীহ'র নামাজ পড়ার পর আরও সামান্য পরিমাণে খাওয়া যায়। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, শুধু মাছ মাংস নয়, সাথে শাকসবজি, ফলমূল, দুধ সহ সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে।

রমজান মাস এবং ধূমপান ত্যাগ
যারা ধূমপায়ী তারা জানেন ধূমপান ত্যাগ করা কতোটা কষ্টকর। ধূমপায়ীদের জন্য রমযান মাস ধূমপান ত্যাগের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। সেহরির পর থেকে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় যারা ধূমপান ত্যাগ করে থাকতে পারেন, তারা অবশ্যই ইফতারের পরেও ধূমপান করা ছাড়া থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তিটাই যথেষ্ট।

ঈদ এবং ভোজন উৎসব
সারা মাস রোজা ছিলেন, ঈদের দিন খেয়ে একমাসের খাওয়ার সাদ মিটিয়ে দেবেন; এমন মন-মানসিকতা কখনোই সঠিক নয়। এটা শরীর এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর। দীর্ঘ এক মাসে এক ধরণের খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে, ঈদের দিন ভোজন উৎসব না করে বরঞ্চ হালকা নাস্তার উপরই থাকা ভালো।

অনুরোধ
পুরো রমযান মাসে আমাদের উচিত যারা খেতে পারে না, অসহায়, দরিদ্র তাদের পাশে দাঁড়ানো। খেয়াল রাখতে হবে তাদের যেনো অনাহারে রোজা না রাখতে হয়। ঈদের আনন্দ সেই সব নিপীড়িত মানুষের সাথে ভাগ করে নিলে সেই ঈদের মহাত্ম্য এবং আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যায়। সুস্থ শরীর এবং সুন্দর মননে রোজা পালন করুন এই কামনাই করি। রমযান মোবারক!

(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আমার ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ এবং বন্ধু Sam Ahmed​ । আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বাংলা ম্যাগাজিন "সমীক্ষা"র জন্য লিখিত)