আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান: সিলেটের রাজনীতিতে একজন সৎ, মৃত্যুঞ্জয়ী নেতা, বেঁচে থাকবেন কর্মযজ্ঞে, আদর্শে

এনামুল হক
Published : 10 Sept 2015, 05:15 AM
Updated : 10 Sept 2015, 05:15 AM

কিছুদিন পূর্বে নেতা (LEADER) সম্পর্কিত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ফেইসবুকে। সেই স্ট্যাটাসে নেতার অত্যাবশ্যকীয় কিছু গুণাবলীর থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলাম, যে গুণগুলো থাকলে একজন নেতা… জন মানুষের নেতা হয়ে উঠেন। বাস্তব জীবনে এমনই একজন নেতার কথা আজ আপনাদের বলবো।

নেতার অত্যাবশ্যকীয় গুণাবলী বর্ণনা করতে হয়ে স্ট্যাটাসটিতে সেদিন লিখেছিলাম,
LEADER:
L – Loyal (বিশ্বস্ত)
E – Enthusiastic, Elite and Energetic (উত্সাহী, অভিজাত, কর্মতৎপর)
A – Active and Authoritative (সক্রিয়, বিশ্বাসী)
D – Dynamic (প্রগতিশীল)
E – Efficient, Educated and Ethical (দক্ষ, শিক্ষিত, নৈতিক গুণ সম্পন্ন)
R – Responsive and Realistic (প্রতিক্রিয়াশীল ও বাস্তববাদী)

নৈতিক গুণ সম্পন্ন, বিশ্বাসী, দক্ষ, শিক্ষিত, অভিজাত মন-মানসিকতার, কর্মতৎপর, প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহী, প্রতিক্রিয়াশীল, বাস্তববাদী একজন নেতার উদাহরণ আমাদের আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান ভাই।

আজ যখন এই কলামটি লিখছি তখন তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অচিনপুরে। মৃত্যু আমাদের জীবনের চরম বাস্তবতা, সবাইকেই একদিন মরতে হবে, কেউ আগে কেউ পরে। নেতার বয়স হয়েছিলো, দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি রোগাক্রান্ত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, নেতৃত্ব গুণ এবং সৎ চরিত্র তাঁকে করেছে মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান এক চরিত্রের উদাহরণ।

একই পাড়ায় বাসিন্দা হওয়ায় সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি সুফিয়ান ভাই সকালে ঘড়ি ধরে রুটিন মাফিক মর্নিং-ওয়াক করতেন। কোনোদিন মর্নিং-ওয়াকে বের হননি মানে তিনি সিলেটের বাইরে আছেন অথবা অসুস্থ। অফিসে যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিন নেতার সাথে দেখা হতো। কয়েকদিন দেখা না হলে খোঁজ নিতাম, তিনি অসুস্থ কি না। বেশ কিছুদিন আগে মর্নিং-ওয়াকের সময় একটি এক্সিডেন্টে তা পায়ে ফ্রাকচার হয়। তিনি মর্নিং-ওয়াকে বের হননি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তিনি অসুস্থ। নেতাকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, যে গাড়ির সাথে তাঁর দুর্ঘটনা ঘটলো তিনি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন আইনি ব্যবস্থা নিয়ে কি হবে, সে তো আর ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করেনি।
আমি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জেলা পরিষদের প্রধান, তাঁর নির্দেশে পুলিশ মুহূর্তেই সেই ব্যক্তিকে খোঁজে বের করে জেলে পুরতো, কিন্তু তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

সুফিয়ান ভাইয়ের নৈতিক গুণ ছিলো অসাধারণ। অনেক নেতাদের নৈতিক গুণ থাকলেও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নেতা-কর্মীদের কারণে এবং ক্ষমতার আবহে সেই গুণ ক্ষয়ে যায়। কিন্তু সুফিয়ান ভাইয়ের সেই নৈতিক গুণ ছিলো আজীবন অক্ষুণ্ণ। সারাজীবন তো অবশ্যই, দল যখন ক্ষমতায়, তখন ক্ষমতাধর হয়ে কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। আমি জানি অনেকেই অনেক অনৈতিক অনুরোধ নিয়ে সুফিয়ান ভাইয়ের কাছে গেছেন, সুফিয়ান ভাই এক বাক্যে সে অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁর এই গুণাবলীর কারণে সিলেটে তাঁর আবহে নেতৃত্বের কখনোই দলীয় কোন্দল হয়নি, রেষারেষি হয়নি। অনেক নেতা-কর্মী সুফিয়ান ভাইয়ের নৈতিকতার কারণের কাছে ঘেষতে সাহস পেতো না। সুফিয়ান ভাইয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই কারো সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। সিলেটের কোনো নেতা এমন কি তাঁর রাজনৈতিক চরম বিরোধী শক্তিও এমনটি দাবী করতে পারবে না যে তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন বা ওয়াদার বরখেলাফ করেছেন।

রাজনীতিতে তাঁর দক্ষতা আওয়ামী পরিবার পেয়েছে বার বার। একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্র-সৈনিক, বিএনপি-জামাত বিরোধী আন্দোলন, ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলন, কিংবা ১/১১ এর চরম দুঃসময়ে তিনি ছিলেন নেতৃত্বে অটল। তার নেতৃত্ব দক্ষতায় আওয়ামীলীগে শুধু সিলেটে নয় পুরো বাংলাদেশে এমন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের দক্ষ নেতা হাতে গোণা।

কর্মতৎপর সুফিয়ান ভাই দলীয় কার্যক্রমে প্রভাব পড়বে এই কারণে তাঁর অসুস্থতার কথা শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিকে বলতেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাস-কয়েক আগে আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন তখনও সীমিত সংখ্যক লোক জানতো তাঁর মূল অসুস্থতার কথা। এমনকি দেশে ফেরার পর কিছুদিন আগেও যখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন তখনও তিনি জানাতে চাননি তাঁর হাসপাতালে ভর্তির খবর।

ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী সুফিয়ান ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্য তাঁর দ্বার সবসময় ছিলো উন্মুক্ত।

নেতার কাছে যখনই নতুন কাজ নিয়ে গিয়েছি, তিনি সব সময়ই উৎসাহ দিয়েছেন। খুব মনে পড়ে কয়েকমাস আগে একটি মেডিকেল ক্যাম্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে অঝোরে কেঁদে ছিলেন। বার বার বলছিলেন, "মানব সেবা তো তোমরা করছো, সারা জীবন বক্তৃতা দিয়ে গেলাম মানব সেবায় কিছু করতে পারলাম না।" আমার বক্তৃতা পর্ব তখন শেষ হয়ে গিয়েছিলো, সুফিয়ান ভাইয়ের অশ্রু ভেজা চোখ দেখে অনুমতি নিয়ে বলেছিলাম, "আপনাদের জন্যই একটি স্বাধীন পেয়েছি, আপনাদের জন্যই চিকিৎসা সেবা প্রদানের এই প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি, আপনারা না থাকলে ডাক্তারি নয়, অন্য কোনো দেশের গোলামীই করতে হতো।" সব সময়ই সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ দিয়েছেন আমাদের নেতা।

২০০৮-০৯ নির্বাচনের একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। নির্বাচনের আগের দিন সুফিয়ান ভাইয়ের বাসায় মিটিং হলো। সেই মিটিং এর সিদ্ধান্ত ছিলো যার যার সেন্টারে সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে। ৫-৬জন করে একেকটি সেন্টারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো অবস্থান এবং পর্যবেক্ষণের যাতে নির্বাচনকালীন সময়ে কোনো কারচুপি না হয়।

আমার দায়িত্ব ছিলো পাঠানটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সকাল থেকে আরো কয়েকজন মিলে ঐ বিদ্যালয়ে অবস্থান নেই, সুফিয়ান ভাই সবগুলো সেন্টার ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন আর নেতা কর্মীদের কাছে থেকে ভোটের আপডেট খবর নিচ্ছিলেন। সকাল থেকে একাধিক বার আমার সেন্টারে এসেছিলেন তিনি। দুপুরে সবাই ভাত খেতে চলে গিয়েছিলো, আমি তখনও সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে। অনেক নেতাই আসছিলেন খবর নিতে, কোনো নেতা এসে যদি কাউকে না পান তবে বদনাম হবে বা রাগ করবেন এই ভেবে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তিনটার দিকে সুফিয়ান ভাই আবার এসে যখন আমায় ফুটপাতে দাঁড়ানো দেখলেন তখন তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন দুপুরের ভাত খেয়েছি কি না। আমি বললাম সিঙ্গাড়া খেয়েছি লিডার, কিছুক্ষণ পর খেতে যাবো। তিনি তখন আমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে আমার ফুটপাতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, দলের জন্য কষ্ট করছো দেখে ভালো লাগছে, তবে যদি আমরা নির্বাচনে জিতি তবে দেখবে এই ফুটপাতেই তোমার আমার পাশে অনেককেই দাঁড়াবে, অনেকেই থাকবে সুবিধাবাদী। তুমি তো অবশ্যই, এমনকি আমি নিজেও ঐসব নেতাদের ধাক্কাধাক্কিতে নিচে পড়ে যাবো, ক্ষমতা বড় অদ্ভুত জিনিষ।

আজ সুফিয়ান ভাই নেই, কিন্তু তাঁর এই কথাগুলো কতটা বাস্তব তা মর্মে মর্মে টের পাই। তবে সুফিয়ান ভাইই বলতেন, "নিজে কি পেলাম সেটা বড় কথা নয়, দল… দেশের মানুষকে কি দিতে পারলাম তাই বড় কথা… তাই আসল রাজনীতি।"

সুফিয়ান ভাইকে ঘিরে অসংখ্য স্মৃতি আছে, প্রায় সবগুলোই শিক্ষণীয়, যা লিখলে রীতিমতো একটি বই হয়ে যাবে। কথা দিলাম পরবর্তীতে বিভিন্ন কিস্তিতে সুফিয়ান ভাইয়ের সাথের স্মৃতিগুলো শেয়ার করবো।

বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) যখন নেতার মৃত মুখ দেখে ঘরে ফিরছিলাম তখন অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি… কেঁদেছি, অন্তর থেকে কেঁদেছি। এই কান্নার বিয়োগ ভালোবাসার কান্না, যে ভালোবাসার মধ্যে কোনো স্বার্থ ছিলো না, ছিলো নেতার আদর্শের ছোঁয়া। আমার সাথে আমার বৃদ্ধ বাবা ছিলেন, ফেরার পথে বার আফসোস করছিলেন, বড় ভালো মানুষ ছিলো, বড় ভালো মানুষ ছিলো।

সুফিয়ান ভাইয়ের পরকালের শান্তি কামনা করে আমি দৃঢ় কণ্ঠে সাক্ষ্য দেই… আমার নেতা সৎ ছিলেন, নৈতিক গুণ সম্পন্ন, বিশ্বাসী, দক্ষ, শিক্ষিত, অভিজাত মন-মানসিকতার, কর্মতৎপর, প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহী, প্রতিক্রিয়াশীল, বাস্তববাদী একজন নেতা ছিলেন… যার আদর্শে সত্যিকার অর্থে অনুপ্রাণিত হই, দুর্নীতিবাজদের নিয়ে গড়ে উঠা কলুষিত সমাজে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি, সাহস পাই।

নেতা বেঁচে থাকবেন তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞে,নেতা বেঁচে থাকবেন তাঁর আদর্শে।