হরতালের দুঃখগাঁথা!

হাবিব
Published : 13 Dec 2012, 02:04 PM
Updated : 13 Dec 2012, 02:04 PM

এই শীতে পিঠা পুলি বানালেই ফোন চলে আসে "এই তোর পছন্দের-নারকেল দিয়ে পিঠা বানিয়েছি, সাথে কিন' খেজুরের গুড় দিয়েছি-মোটেও দেরি করবি না, ঠান্ডা হয়ে যাবে না হলে"। এখন শীত এসেছে-এবার হয়তো এমন মায়াভরা ফোন পাবো না। শৈশব থেকে স্কুল, তারপর কলেজ তারপর মেডিক্যাল কলেজ প্রায় সব জায়গাতেই মায়াময়ী ছোয়া ছিল আমার বোনটার। বা শিক্ষক ছিলেন। ৭ ভাই বোনের সংসারে আমাদেরকে বাবা খুব স্বচ্ছলতা দিতে না পারলেও স্বচ্ছন্দে ছিলাম আমরা। এখন আমি ডাক্তার হয়েছি, তারপরও সে সামর্থ আমার কিংবা ওই বোনটার সংসারের নেই যে, ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে বোনটার বোনমেরম্ন ক্যান্সারের চিকিৎসা করানোর। প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস শয্যাশায়ী সে। জানতাম সে খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবে। মারা গেলেনও তাই। মঙ্গলবার বিকেলে খবর পেলাম রংপুরের মিঠাপুকুরে নিজ বাড়িতেই মায়াময়ী বোন আমার মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু শয্যাপাশে থাকতে পারিনি-কিন' আমি ছুটে যাবার চেষ্টা করলাম-বোনটাকে শেষবারের মত একবার দেখবো। বিদায় জানাতে হবে আমাকে। প্রথমে এম্বুলেন্স নিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম, রাস্তা অবরোধ, চারদিকে ভাংচুর আর হরতাল, ওরা অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙছে, তাই পেলাম না এম্বুলেন্স, শহরে এলাম একটি গাড়ি ভাড়ার জন্য, ব্যার্থ হলাম। এভাবেই কেটে গেলো পুরোটা বিকাল আর সন্ধা। সন্ধায় কবর দেয়া হয়ে গেলো বোনকে আমার। একমুঠো মাটি তার কবরে দেবার সৌভাগ্য আমার হলো না। সারারাত উৎকণ্ঠায় শেষ করে ভোর বেলা গিয়ে মা-বাবা, ভাই ও অন্যান্যদের সাথে দেখা করে এলাম। বোনটার কবরের পাশে যেতেই বুকটা ফেটে গেলো। পারলাম না তাকে শেষবারের মত দেখতে-হরতাল আমাকে আমার ৪০ বছরের বন্ধন, আমার মায়াবতী বোনটাকে দেখতে দিলো না।

বৃহষ্পতিবার সকালে এ প্রতিবেদকের সামনে এভাবেই আক্ষেপ করে অঝোর নয়নে ডুকরে ডুকরে কাঁদলেন ঠাকুরগাঁও স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ আলম মন্ডল। আশপাশে আরো কয়েকজন, সবার চোখেই পানি। ডাঃ আলমের এ অনুযোগের কোন সান্ত্বনা উপস্থিতি সেখানে কেউ দিতে পারেননি। সবাই কাঁদলেন। অস্ফুট স্বরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এডভোকেট এনতাজুল হক বললেন-আর কতকাল আমরা এমন হরতালের শিকার হবো। কেন এ হানাহানি? এমন মায়াময় ৪০ বছরের বন্ধন কি হরতাল ফিরিয়ে দিতে পারবে ?

উল্লেখ্য, বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তারের পর পরই ঠাকুরগাঁওয়ে গত সোমবার সন্ধা ৭ টা ৩০ থেকে হরতাল চলে এবং তা শেষ হয় গত বুধবার দুপুর ১২ টায়। তারপর আবার বৃহস্পতিবার সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত হরতাল চলে। এ সময় ঠাকুরগাঁও-ঢাকা মহাসড়ক ছিল একেবারেই অবরুদ্ধ। শহরে থেকে কোন যানবাহন কোথাও যেতে পারেনি বা শহরের বাহির থেকে দূর পাল্লার কোন যানবাহন শহরে ঢুকতে পারেনি। কার্যতঃ ঠাকুরগাঁও পরিনত হয় দেশের ভেতরের বিচ্ছিন্ন একটি শহরে।