গুলশান হামলা কি ঠেকানো যেত না?

হাবিব
Published : 11 August 2016, 04:16 PM
Updated : 11 August 2016, 04:16 PM

বাংলাদেশে আইএস এর পতাকা তলে ইসলামিক জঙ্গী ভয়ংকর রুপ ধারন করছে-এমন সংবাদ কি গোয়েন্দা অথবা র‍্যাব এর কাছে ছিল না? আমার মতে কল্যানপুর এ জঙ্গী আস্তানা সম্পর্কে র‍্যাব জানতো। তবে এরা এত ভয়ংকর হবে তা হয়তো র‍্যাব অথবা গোয়েন্দা সংস্থা বুঝতে পারেনি। অথবা সিদ্ধান্তহীনতা, রাজনৈতিক চাপ বা দায়িত্বে অবহেলা এর ফসল হলো-গুলসান হামলা।

ফ্ল্যাশ ব্যাক: গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৪ এ সিরাজগঞ্জ এ ৫ জেএমবি কে বিপুল পরিমান আগ্নেয়াস্ত্র সহ গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। র‍্যাব দাবি করে যে, গ্রেপ্তারকৃত ৫ জন নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছিল।

আরো পেছনে: একই বছরে ঠাকুরগাও জেলার, মুন্সিরহাট এলাকার দুই শিক্ষার্থী ঢাকা থেকে নিখোজ হয়। একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। অপরজন নুরুজ্জামান আরিফ ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। এরা দুজনেই ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধার পর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়।

নিখোঁজ ওই দুই শিক্ষার্থী কল্যানপুরের একই সাথে বসবাস করতো। আরিফ এর ফেসবুক আইডি তে ঢুকে দেখা যায় যে, আরিফ তার ফেসবুক ওয়ালে আইএস'র পতাকার ছবি ব্যবহার করেছে। আরিফ ফেসবুকে যে গ্রুপ গুলোর সাথে যোগাযযোগ করতো, তার সবই উগ্রপন্থী। এছাড়া সে যে স্টাটাস, মন্তব্য এবং ছবি তে লাইক দিয়েছে, তার অধিকাংশই উগ্রপন্থী।

তারা দু'জন ২৮ সেপ্টম্বর তারিখে ঈদের ছুটিতে বাড়ী আসবার জন্য বের হয়েছিল। এরপর রাত ১০ টা থেকে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আরিফ পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকার মোহাম্মদপুর ও কল্যানপুর এলাকায় পনির এর ব্যবসা করতো।

তার ফেসবুক আইডি এর ছবি, পোষ্ট ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে বুঝা যায় যে, আরিফ কোন ইসলামি জঙ্গী গোষ্ঠির সাথে জড়িত। এমন অনুসন্ধানী সংবাদ পত্রিকা অফিসে লিখে পাঠানো হলেও, পত্রিকা সে সংবাদটি ছাপায়নি। তবে, আমার নিজস্ব ব্লগ এ আরিফ জঙ্গী গোষ্ঠির সাথে জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নিবন্ধ লিখি। তার ফেসবুক আইডি থেকে একটি ভিডিও সংগ্রহ করি। (আইনী নিষেধাজ্ঞার কারনে, ভিডিওটি আপলোড করা হলো না)। ওই ভিডিও তে দেখা যায়, ৬ জন কালো মুখোশ পড়া যুবক আইএস'র পতাকা সামনে নিয়ে বাংলা আরবি ভাষায় শপথ গ্রহণ করছে। তারা জঙ্গী গোষ্ঠি আইএস'র সদস্য বলে দাবি করে। তারা দেশ থেকে অমুসলিম, নাস্তিক, ব্লগার সহ সরকার বিরোধী স্লোগান দেয়। কালো মুখোশ পরা ওই জঙ্গীরা কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিধান করেছিল। তারা যে ঘরে শপথ বাক্য পাঠ করছিল এবং শ্লোগান দিচ্ছিল, সে ঘরের মেঝেতে একটি বিছানা ছিল। বিছানার ওপর একটি কম্পিউটার ছিল। বালিশের দু'পাশে দুটি সাউন্ড বক্স ছিল। ওই ঘরের ওয়ালের রঙ ছিল হালকা গোলাপী রঙের।

একই বছরের ২৯ সেপ্টম্বর তারিখে আরিফের বাবা আবু তালেব ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারন ডায়েরি করে। সাধারন ডায়েরি করার পরে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ আরিফের রুমে যায়। তবে পুলিশ নিখোজ আরিফ সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেনি। আরিফের বাবাও আরিফের সাথে পরিনের ব্যবসা করতো। আবু তালেব তার ছেলে আরিফকে ঢাকায় পনির দিয়ে আসতো এবং বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতো।

পরে ৩১ অক্টোবর তারিখে র‍্যাব সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে ৫ জন জেএমবি সদস্যকে বিপুল পরিমান আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা, ডেটোনেটর, সার্কিট বোমা বানানোর সরঞ্জাম সহ গ্রেপ্তার করে।

নিজস্ব পর্যালোচনা : গত কয়েকদিন আগে পুলিশ কল্যানপুর এলাকায় জঙ্গীর আস্তানায় অভিযান চালিয়ে সেখানে অবস্থান করা জঙ্গীদের ধরার চেষ্টা করে। এতে পুলিশ ও জঙ্গীর গোলাগুলিতে ৯ জঙ্গী নিহত হয়।

পুলিশ নিহত জঙ্গীদের ছবি প্রকাশ করে। প্রায় সব ছবিতেই ওয়ালের রঙ হালকা গোলাপী। মেঝেতে বিছানা। আইএস'র পতাকা। এসব আলামত আগে প্রকাশিত ভিডিও'র সাথে হুবুহু মিল রয়েছে।

আরিফ ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোজ ছিল। সে অনুযায়ি, র‍্যাব আরিফকে ওই দিনই আটক করেছিল বলে মনে হয়। যদিও র‍্যাব দাবি করেছে তাকে ৩১ অক্টোবর আটক করা হয়েছে। সম্ভবত: র‍্যাব আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য জঙ্গীদের ধরা হয়। অথচ আরিফ যেখানে থাকত, অথবা আরিফ কার কার সাথে যোগাযোগ করে এমন তথ্য বিশ্লেষন করা উচিত ছিল। আরিফ ছিল বিবাহিত। তারপরেও সে ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সফটওয়ার এন্ড টেকনলজি বিষয়ে পড়াশোনা করছিল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ কোথা থেকে আসতো। তার স্ত্রী, বাবা-মা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন কি করে ? তারা কেউ উগ্রপন্থী হিসাবে কাজ করে কিনা?

র‍্যাব যদি আরিফকে নিয়ে একটু পর্যালোচনা করতো, তাহলে হয়তো গুলশান হামলা হতো না। অথচ, গুলশান হামলায় যখন ইসলামী জঙ্গীরা ২০ জন বিদেশী নাগরিক হত্যা করলো, ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করলো, তারপরে পুলিশ কল্যানপুরে অভিযান চালিয়ে ৯ জঙ্গীকে হত্যা করতে সমর্থ হলো।

কল্যানপুরে জঙ্গী অভিযানে পুলিশ অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এ অভিযান থেকে বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমার বিশ্লেষনে মনে হয়েছে, র‍্যাব ও পুলিশের মধ্যে তথ্য সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। র‍্যাব আরিফকে গ্রেপ্তারের পরে কল্যানপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালাতে পারতো। আমার বিশ্বাস যে, র‍্যাব বাহিনী আরিফকে নিয়ে তেমন কোন বিশ্লেষন চালায়নি। র‍্যাব সক্রীয় ভূমিকা রাখলে হয়তো কল্যানপুরে জঙ্গীর আস্তানা ভেঙে যেতো। অধিকাংশ জঙ্গী ধরা পরতো। তাহলে হয়তো জঙ্গীদের গুলশান হামলা ঠেকানো যেতো।

জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে এটা আমার নিজস্ব বিশ্লেষন। তারপরেও আমার বিশ্লেষনে জঙ্গী সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, সেসব তথ্যের কোনটাই মিথ্যা প্রমানিত হয়নি। তবে, আফসোসের বিষয় যে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এসব তথ্য বিশ্লেষন করে না।

২০০৫ সালের আগস্ট মাসে জঙ্গীরা দেশব্যাপী বোমা হামলা চালায়। ওই বছরের মার্চ মাসে দেশের ১৭৩ জন জঙ্গীর পরিচয় উল্লেখ করে একটি অনুসন্ধানী সংবাদ লিখেছিলাম। পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা এসব জঙ্গীদের বিষয়ে কোন খোজ খবর নেয়নি। সংবাদ প্রকাশের পরে যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তবে,দেশব্যাপী বোমা হামলা হতো না বলে আমি বিশ্বাস করি।

রাজনৈতিক প্রসঙ্গ : বিএনপি'র কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা মন্তব্য করেছেন যে, "কল্যানপুরে জঙ্গীদের না গ্রেপ্তার করে হত্যা করা হলো কেন" ? এমন বক্তব্যের কারণে বিএনপি নেতাদের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে। তারা এ সম্পর্কে কোন বিশ্লেষন করেনি। অবশ্য তারা না জেনে বলেছে, এ কথাও ঠিক নয়।

এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য লিখতেই হয়। দেশে যেভাবে উগ্র জঙ্গীর তৎপরতা বাড়ছে, তার অনেকটাই দেশের উত্তরাঞ্চলের ভূমিকা রয়েছে। এই উত্তরাঞ্চলেই জঙ্গী গোষ্ঠির মদদদাতা, অর্থ যোগানদাতার বসবাস। জঙ্গী নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানের এর কর্মকান্ড বিস্তার ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলে। তৎকালীন সময়ে মিজানুর রহমান, মেজবাহ উদ্দীন, আসাদ, ফজলে রাব্বী, ওয়াহেদুর রহমান সহ ভয়ংকর জঙ্গীরা বিএনপি তে যোগ দেয়। ঠাকুরগাও জেলার রানীশংকৈল উপজেলা বিএনপি সভাপতির ভাই মালেশিয়া গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এখন পর্যন্ত নিখোজ ওই ব্যক্তি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে যে, সে মালেশিয়া সহ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পরেছে। আরআইএইচএস নামক মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংস্থাটির প্রধান পরিচালকের বাড়ি হরিপুর উপজেলায়। আল রাবেতা নামক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের বাড়িও হরিপুর উপজেলায়। কুয়েত ভিত্তিক একটি সংস্থা ঠাকুরগাও জেলা সহ বিভিন্ন স্থানে আহলে হাদিস এর মসজিদ নির্মান করেই চলছে। গ্রামে গ্রামে তাদের প্রচারনা অব্যাহত রয়েছে। কট্ররপন্থী জামায়াত-শিবির কর্মীদের অধিকংশই জঙ্গী গোষ্ঠিতে যোগদান করছে।

বিএনপি শুধু জামায়াতের আশ্রয়দাতা নয়, বিএনপি জঙ্গী গোষ্ঠির পৃষ্ঠপোষক। বিএনপির ভেতরে মুখোশ পরে আছে জঙ্গীরা। তাই জঙ্গী নিধন করলে বিএনপি নেতারা কষ্ট পান। এরা জেনে শুনেই পুলিশের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করছেন। অথচ, একটু অনুসন্ধান করলেই জানা যাবে যে, ধরা পরা বা নিহত হওয়া জঙ্গীদের পরিবার কোন না কোন ভাবে বিএনপি'র সাথে জড়িত। এমনও ঘটনা আছে যে, কোন জঙ্গীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পরে. ওই জঙ্গীকে মুক্ত করতে বিএনপি'র কিছু মন্ত্রী তদবির করেছেন। জঙ্গী ব্যক্তি সম্পর্ক সাফাই দিয়েছেন।

আমার এমন বিশ্লেষন এর অর্থ এই নয় যে, আমি আওয়ামীলীগ এর সাথে জড়িত। আওয়ামীলীগ এর রাজনীতি ও দ্বৈত নীতির সাথেও মত পার্থক্য রয়েছে। জঙ্গী আরিফকে যেন আদালত জামিন দেয়, সে কারনে, আওয়ামী লীগ'র একজন ক্ষমতাধর সংসদ।