বাতির নীচে অন্ধকার- ১

হাবিব
Published : 9 May 2017, 11:24 AM
Updated : 9 May 2017, 11:24 AM

আসলে অধিকার আদায়ের পথটা অনেক রুক্ষ। বিশেষ করে যখন জাস্টিস কালো মোড়কে ঢাকা থাকে।

সাংবাদিক হবো বা সাংবাদিকতা করবো, এটা আমার মিশন ছিল না। স্কুল জীবনে অনেক রকম বই পড়তাম। বই পড়া আমার নেশা ছিল। তখনকার সময়ে বাজারে দুটি নোট বইয়ের প্রচলন ছিল। একটি হচ্ছে কিশোর লাইব্রেরী আর অপরটি কলকণ্ঠ। মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শীরা কিশোর লাইব্রেরীর বই কিনে সবই মুখস্থ করতো। এটা আমার পছন্দের ছিলনা। তাই কলকণ্ঠ নোট বই পড়তাম। কিশোর লাইব্রেরীর নোট বইয়ে যে উত্তর মাত্র এক পাতা বা অর্ধেক পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, ওই একই জিনিস কলকণ্ঠের মধ্যে কমপক্ষে তিন পৃষ্ঠা থাকতো। এত বড় বড় উত্তর কখনও মুখস্ত করা সম্ভব ছিলনা। সে বই পড়ে অতঃপর সেখান থেকেই গুছিয়ে লিখতে হতো।

এটা উদাহরণ দেবার পেছনে যে কারণটা তা হলো, জীবনে আজ পর্যন্ত কোন সরল পথ ধরে এগুতে ভালো লাগেনি। আমাকে নিয়ে ভাববার কেউ নাই। তারপরেও যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন তারা প্রায়শঃই বলেন সহজভাবে গ্রহণ করার জন্য।

না, এটা আমার কোন জেদ নয়। আমি কোন মনীষিও নই। তারপরেও বিশ্লেষণ আর ব্যবচ্ছেদে আমার মন টানে। আমার মন পরে থাকে ওই ছেড়া, বস্ত্রহীন মানুষদের মাঝখানেই। তারাও তো জীবনের শর্টকাট পথ না পেয়ে এইভাবে জীবন কাটাচ্ছে। হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ থাকলেও, দিনে দিনে সবই যেন অস্পৃশ্য হয়ে উঠছে। স্ত্রী পর হয়েছে অনেক আগেই। সন্তানও হয়তো পর হয়ে যাচ্ছে, হয়তো যাবে। তারপরেও সরল পথে আসতে পারছিনা। ছোট ছোট অনেক কথা আমার জন্য বড় বড় কষ্টের কারণ হয়।

আমি তো রোদ্দুরও হতে চাইনি বা কোন কবি-লেখকও হতে চাইনি। তবে, আমি প্রায়শঃই বলি, আমার চেয়ে ভাল শ্রোতা আপনারা আর পাবেন না।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পরে গেলো। তখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। দুরন্তপনার সবটাই ছিল। আব্বা শিক্ষকতা করতেন আর মা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তা। মা হচ্ছেন মাটির মানুষ। তখনকার দিনে চামড়া বা প্লাস্টিক গোছের নাগড়া বা এরকম চটি জুতা পাওয়া যেতো। সেগুলো বেশ মজবুত আর আভিজাত্যও বহন করতো। তখন মোটর সাইকেলের প্রচলন একেবারে ছিল না বললেই চলে। আব্বা সাইকেলে চেপে স্কুলে যেতেন। আব্বার সাথে একটা জায়গায় আমার অনেক মিল ছিল। যা হচ্ছে, আব্বা রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত শুনতেন। এটা অনুকরণ কিনা জানিনা, তবে আমার ভালবাসার তালিকায় রবীন্দ্র সংগীত তখনও আর এখনও এক নম্বরে রয়েছে।

অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই অন্যান্য কয়েকশত বইতো পড়েছি, সেই সাথে মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, মাওসেতুং মনে দাগ কেটে গেছে। মোক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাসটা বা বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা সহ শরৎ চন্দ্রের প্রায় সব বই, কাজী নজরুলের সঞ্চয়িতা, বুদ্ধদেব গুহ ঠাকুরতার লেখা সমগ্র, নীলিমা ইব্রাহীমের বিদ্ধস্থ নীলিমা, আরও কঠিন কঠিন সব বই পরে ফেলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল সেসব লেখা বুঝেওছিলাম। বই পড়াতে আব্বা রাগ করতেন না। তবে স্কুল ফাঁকিতে অনেক ক্ষুব্ধ হতেন। ঘটনা আর যাই হউক, ধরা পরতেই হতো। আর ধরা পরলেই সেই নাগড়া জুতার শপাৎ শপাৎ আঘাত বরাদ্দ ছিল। এরকম মার খাবার পরেও বন্ধুদের বলতাম, জুতার বাড়িটা যখন দেয় এটার শব্দ হয় অনেক, কিন্তু লাগেনা। আসলে এটা ছিল মিছে কথা। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলেও প্রেসটিজ রক্ষার্থে ভালো থাকার ভান করতেই হতো।

সিনেমা তো দেখতেই হবে। তাই এক মামার পাল্লায় পরে মাঝে মাঝেই বিকেলের শো দেখতে গিয়ে রাত হয়ে যেতো। সন্ধ্যার পরপরই পড়ার টেবিলে বসার নিয়ম ছিল বাধ্যতামূলক। নইলে জুতার ব্যবহার চলতো। যেদিন নেহায়েতই রাত হয়ে যেত সেদিন কি আর করা, সন্ধ্যার শো দেখেই বাড়ি ফিরতাম। কারণ, সন্ধ্যার পরে ফিরলেও জুতার বাড়ি খেতে হবে আর তার কিছু পরে গেলেও জুতার বাড়ি। তাই, দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিতাম।

স্কুল বেলাতেই কমরেড লেলিনের মুর্তি বুক পকেটে লাগাতে বেশ গর্ববোধ হতো। অবশ্য এ কারণে শিক্ষকদের গালিগালাজ যে শুনতে হয়নি তা নয়। তবে লক্ষ্য করলাম যে, আব্বা আর আগের মত মারপিটের দিকে যাচ্ছেন না। তিনি এসব বই পড়তেও বাধা দিচ্ছেন না। তবে, প্রায়শঃই বলতেন, পরীক্ষায় পাশ হবে তো? মুখস্থ বিদ্যা ছাড়াই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রেজাল্ট দেখে তিনি আনন্দই পেতেন বলে মনে হতো।

যা বলছিলাম, আমি একজন ভালো শ্রোতা বটে। এটার একটা প্রমাণ রয়েছে। সিনেমা দেখা, আড্ডা মারা এসবের জন্য আব্বা আর জুতা হাতে না নিলেও, তিনি কৌশল পাল্টালেন। আমি যখন ঘরের ভেতরে ঢুকি তিনি তার পরই ঠিক দরজার সামনে দাড়াতেন। অতপর সর্বনিম্ন এক ঘন্টা কোন কোন ক্ষেত্রে দুই বা তিন ঘন্টা এক নাগারে বকাঝকা করতেন। আর সেই সময়টা আমি ঠাই দাড়িয়ে থাকতাম।

আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতো না। বরং এক সময় আব্বা বকাঝকা বন্ধ করে চলে যেতেন। একনাগারে  কি করে এভাবে দাড়িয়ে থাকি এর রহস্যটা জানবার জন্য বন্ধু-বান্ধবরা প্রায়ই বলতেন, কিভাবে তুই এতক্ষন দাড়িয়ে দাড়িয়ে বকাঝকা শুনিস?

আসলে রহস্যটা ছিল এরকম 'আব্বা শিক্ষক মানুষ। অনেক বেশি কথা বলবেন এটাই নিয়ম। প্রতিবাদ করলে কথার পৃষ্ঠে কথা বেড়ে গিয়ে আরো বেশি সময় বকাঝতা শুনতে হবে। তাই প্রতিবাদহীন আমি ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকতাম আর সে সময়টাতে কমরেড লেলিনের রেভিউলেশন, মাও সেতুংয়ের অসির শক্তি, মুক্তির পথের সকল বিবর্তনবাদের মধ্যে ডুবে যেতাম। তাতেই কেটে যেতো দু-এক ঘন্টা।'

আমার এমন ধৈর্য্যশক্তি আমাকে হয়তো অনেকদূর এগুতে দেয়নি। তবে, আমি যে মানবতার শিক্ষা পেয়েছি, তা আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে গর্ব করি। কারো ধন্যবাদের আশা কখনও করিনা। আমার কমরেডরা আমাকে শিখিয়েছেন, আমি প্রতারিত হবই, আমি ক্ষুধার্ত থাকবই, আমি প্রতিবাদী হবই, কারণ আমি আসলে তাদের অধিকারের কথা ভাবছি। আমাকে নিয়ে কখনই ভাবছিনা।

সম্প্রতি জীবনের পট পরিবর্তনে জীবনটাই ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমি আদালতে গিয়েছি, বিচার পাইনি; আমি প্রেস কাউন্সিলে গিয়েছি, বিচার পাইনি; আমি তথ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি, বিচার পাইনি। তারপরেও আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়নি। আমি জানি এই বিচার হীনতার কারণে হয়তো আমাকেই একদিন টেরোরিস্ট উপাধী দেওয়া হবে। তাতেও আমি ধৈর্য্যহারা হবো বলে মনে হয়না।

এইতো ক'দিন আগে তথাকথিত একজন স্যালিব্রিটির মুখোশ খুলতে উদ্যত হয়েছিলাম। আভাস বুঝতে পেরে, আমার সাংবাদিকতার গুরু আমাকে ফোন করে নিবৃত করার চেষ্টা করেছেন। ঘন্টার পরে ঘন্টা কথা বলেছেন। নীতিকথা বলেছেন। অথচ, সেদিন তিনিও ঠায় বসেছিলেন। যেদিন আর চারপাশে কতগুলো হায়েনা নির্লজ্জ দাঁত বের করে যাচ্ছে তাই খিস্তি করলেন। আমি সেদিন এতটুকু হতবাক হইনি। বরং তাদের মুখের ওপরই বলে উঠেছিলাম, আমি বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী। ঝগড়া করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমার এই দুই বাক্য শুনে সেই স্যালিব্রিটি প্যান্টের বেল্ট বারবার করে ওপরে টানতে টানতে বলছিলেন, আমাদের জ্ঞান দিচ্ছ। তোমার এতবড় সাহস। তখন আমি চারদিকে তাকালাম। আমার গুরুর মস্তক ছিল অবনত, আর বাকীরা সেই স্যালিব্রীটির চোখে চোখ রেখে করণীয়ের কথা ভাবছে। তার আগেই বলে উঠেছিলাম, আমি অধিকার আদায় করার সব পথই বিশ্বাস করি। আর যারা নিজের সত্ত্বা হারায়, তাদের আমি ঘৃণা করি। আমি দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। তাদের পিছুডাকে আমি সায় দেইনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, একদল অভুক্ত হায়েনা আর শুকরের দল, রক্ত মাংস পান করতে উদ্যত হয়েছে।

আমার সাংবাদিকতার গুরু কিছু সময়ের জন্য আমাকে নিবৃত করতে সমর্থন হয়েছেন। আমার মনে হয়েছে যেটুকু সময় আমি মৌন ছিলাম, তার সবটা গুরুদক্ষিণা বলে উৎসর্গ করেছি।

আমার বুকের ভেতরে লেলিন, মার্কস, সেতুং খোদাই করে দিয়েছে, তাদের সকল মতবাদ। সম্প্রতি আমার একজন শ্রদ্ধাভাজন লিখেছেন, সবাই কম্প্রমাইজ করতে পারেনা। হ্যা গুরু, আপনি সত্য। আমার মৌনতা দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিয়েছি। আর প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে লিপ্ত। আসলে অধিকার আদায়ের পথটা অনেক রুক্ষ। বিশেষ করে যখন জাস্টিস কালো মোড়কে ঢাকা থাকে। কিছু রক্ত ঝড়ার অর্থ কিন্তু যুদ্ধ নয়, কিছু প্রাণের ক্ষয় হওয়াটাও কিন্তু যুদ্ধ নয়। এটা আন্দোলনের একটা অংশ মাত্র। অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কারো না কারো তো রক্ত ঝড়বেই। আর এটাকেই ওয়ার না বলে রেভিলিউশন বলে আখ্যায়িত করতে হবে হয়তো। যা হয়ে আসছে, তা হয়তো আরও শতাব্দীকাল ধরে ঘটতে থাকবে।

কষ্টটা সেখানেই কাপালিকের আসনে বসে আছে একদল হায়েনা। স্থানটা পবিত্র করতে হায়েনাদের বধ করা জরুরি।