দিনি কেটেও দুঃখ ঘোচেনা ওদের

হাবিব
Published : 26 Oct 2011, 05:47 PM
Updated : 26 Oct 2011, 05:47 PM

প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অগ্রহায়ন-পৌষ মাসের পরিবর্তে এখন আর্শ্বিন-কার্তিক মাসেই ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। কৃষক আর কৃষি শ্রমিকদের চোখে মুখে আনন্দ আর কন্ঠে আনন্দের গান। কিন' তারা কি ভালো আছেন? তারা কি পারছেন জীবন নির্বাহ করতে ?

মুজিবুৃল, মেজারউদ্দীন, বৈশাগু, টুনি, শহিদুল আর আলম। ওরা ছয় জন মিলে মোট ২২ বিঘা জমির ধান কেটেছে। শর্ত গেরহস-কে দিতে হবে ২০ কাঠা (প্রতি কাঠা ৫ সের) আর নিজেরা পাবে ৩ কাঠা। তাদের মতে প্রতি মনে (৪০ সেরে) তারা ৬ সের পান। কাগজে কলমে এ হিসেব মেটাতে গিয়ে তারা দেখেন যদি উৎপাদন হয় ২৩ মন তবেই তারা পান ৩মন। অর্থাৎ প্রতি মনে তারা পান ৫ সেরের কম। হিসেব দেখে তারা রীতিমত চমকে উঠলেও বললেন আদিকাল থেকেই তারা ঠকে আসছেন। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামে গঞ্জে কৃষি মজুররা চুক্তিভিত্তিক এ হিসেবে ধান কাটাকে বলেন দিনি কাটা।

দিনি কেটে কত ধান সংগ্রহ করতে পারেন ?-জবাবে কৃষি শ্রমিক মুজিবুল জানালেন, শুধু ধান কেটেই তাদের কাজ শেষ নয়। ধান কেটে মাঠে ফেলে রেখে শুকাতে হয় কমপক্ষে আট দিন। সে আট দিন ওই ধান ক্ষেতেই তাদের পালা করে দিন রাত পাহারা দিতে হয়। তারপর সেগুলো ছোট ছোট আটি বাধতে হয়। সে আটিগুলো বোঝা বেধে গেরহসে-র বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পালা দিতে হয়। তারপর সেগুলো মাড়াই করতে হয়। মাড়াই শেষে ধান মেপে গেরহসে-র ঘরে তুলে দিতে হয়। খড়গুলো পুনরায় পালা দিতে হয়। সবগুলো কাজ করে তারা পান প্রতি মনে ৫ সেরের কম ধান। এ বছর আমন কেটে তারা ৬ জন পেয়েছেন ৪৩ মন ধান আর গেরহস- পেয়েছেন ২শ৮৫ মন ধান। তাদের প্রতিজনের ভাগে পড়েছে প্রায় ৭ মন। প্রায় ১ মাস দিন রাত এমন কঠোর পরিশ্রম করে মাত্র ৭ মন ধান পেয়েছেন এর জবাবে তারা জানান, এ সময় অন্য কোন কাজ নাই তাই যতটা পারা যায় সবাই আমরা ধান কাটা মারার কাজে ব্যস- থাকি। এতে কমপক্ষে ২ মাসের খাবার জোটানো সম্ভব হয়। এই এক মাস কাজ করেই আবার প্রায় দু-মাস কোন কাজ থাকে না। বাড়িতে ভাত থাকলে বাকিটা চলে যায় কোন রকমে। ধান কাটা মারা করার সময় দিনি কাটার চুক্তিটা এমনই যে, দিন রাত যত কাজই আমরা করি না কেন এতে গেরহস- কোন খাবার খরচ দেন না। খাবার নিজেদের বাড়ি থেকে আনতে হয়। ব্যস- সময় কাটে বলে এমন কঠিন কাজকে কাজ মনে হয় না। বাপদাদারাও এভাবেই দিনি কেটে এসেছে।

দিনি প্রথাটা কখন থেকে চালু হয়েছে-এর একটা সম্ভাব্য সময় জানা না গেলেও জানা যায়, এই দিনি প্রথাটি চালু হয় জমিদারি আমলে। সে সময়ে তৎকালীন জমিদাররা এলাকার দিনমজুরদের জন্য এ প্রথাটি চালু করেন। এত কঠিন পরিশ্রম আর প্রতি মনে মাত্র ৫ সেরেরও কম ধান পান কৃষি মজুররা-এমন প্রথার সমালোচনা করে অনেকেই জানান, সময় উপযোগি প্রথা বা মজুরী চালু করা দরকার।

ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে জেলার ৫ টি উপজেলায় এবার মোট ২ লাখ ৮৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ রয়েছে। কতজন কৃষক এবং কৃষি মজুর কাজ করছে এমন পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও আনুমানিক প্রায় ২ লাখ কৃষক ও কৃষি শ্রমিক এ ধানকাটা মারার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হলদিবাড়ি, কালমেঘ, সদর উপজেলার লক্ষীপুর, ভাওলারহাট সহ আরো কয়েকটি এলাকার কৃষি শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে তারা কেউ এ দিনি প্রথাটিতে সন'ষ্ট নন। তারা ধান কাটা মারার সঠিক মূল্য চান।