স্যার, দুই সের চাল কিনে দেন!

হাবিব
Published : 29 Oct 2011, 06:05 PM
Updated : 29 Oct 2011, 06:05 PM

শনিবার (২৯ অক্টোবর) তখন রাত ৮ টা। দিনের কাজ শেষ। তারপরও দাড়িয়ে আছি জজকোর্ট চত্বরের নিম গাছ তলায়। সাথে বন্ধু ফরহাদ। মাত্র ২শ গজ দুরে পানি সম্পদ মন্ত্রী আওয়ামীলীগ অফিসে প্রায় ২ বছর পরে বসেছেন। লোকে লোকারন্য। সেটাই অনুধাবন করছিলাম। দলীয় প্রোগ্রাম, তাই সংবাদের তেমন কোন উৎস ছিলনা। দু-বন্ধুতে মেতে উঠেছি পেশা আলোচনা আর সুখ দু॥খের কথায়। খুবই ধীর গতিতে জীর্নশিীর্ণ ১৩ বছরের এক বালকের সরাসরি অস্ফুটস্বরে প্রস-াব-স্যার দুই সের চাল কিনে দেন, মার অসুখ, বাবা ভাত না খেয়ে ওষুধ খেতে পারবে না। ছোট বোনটা ভাতের জন্য কাঁদছে। প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লেও মনে হলো-ঠাকুরগাঁওয়ে শিশু মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে। শিশুটির কথা জড়িয়ে আসছিল, চোখের মধ্যে ক্লানি-র ছাপ-তা দেখে নিশ্চিতভাবে মনে হলো শিশুটি মাদকাসক্ত। তুমি কি গাজা-খাও, নাকি অন্য কোন কিছু খাও। গাজা কি স্যার? ইনজেকশন নাও-শিশুটির উত্তর জ্বর হয়েছিল একবার ডাক্তার ইনজেকশন দিতে চেয়েছিল, ভয়ে পালিয়েছিলাম।-একদিকে শিশুটির মুখের কথা জড়িয়ে আসছিল, অন্যদিকে কোনভাবেই সন্দেহ দুর করতে পারছিলাম না। তুমি ভালো করে কথা বলো-বলতেই জবাবে জানালো-স্যার সন্ধার পরে রোড এলাকা থেকে ৩০ টাকা জমায় একটি রিক্সা আনছি- কিন' চালাতে পারছি না। কেন চালাতে পারছো না? খুব ক্ষুধা লাগছে-তাই রিক্সা টানতে পারছি না।

বন্ধু ফরহাদ সহ তাৎক্ষনিক সিদ্ধান- ছেলেটি যাই হোক-মনে হয় ক্ষুধা লেগেছে। পাশের চায়ের দোকানীকে বললাম-একটা পাউরুটি আর চা দাও। শিশুটির গোগ্রাসে খাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ার মত। খাবার পরে শিশুটির আবদার-স্যার দুই কেজি চাল কিনে দেন। বিষয়টি কোনমতেই মিলাতে না পেরে শিশুটিকে বললাম তোমার বাড়ি কোথায়? আকচা গ্রামে। বাবা কি করে-বাবার কিডনির অসুখ, আগে ভ্যান চালাতো এখন আর পারে না। ক-ভাইবোন, দু-ভাই এক বোন, সেই বড়। ছোট বোনটি ব্র্যাক স্কুলে পড়তো। ছোট ভাইটির বয়স ১০ মাস।

আর ভাবতে পারলাম না। ছেলেটিকে বললাম, চল তোমাদের বাড়ি যাবো। রিক্সাটি একটি দোকানীকে জিম্মায় দিয়ে বন্ধু ফরহাদ সহ দুজনে গেলাম ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে আকচা গ্রামে।
গৃহকর্তা কলিম উদ্দীন বারান্দায় একটি প্লাস্টিকের মাদুর পেতে খেতে বসেছেন, সাথে ১০ বছর বয়সী শিশু কন্যা পলি। পাশেই স্ত্রী রুমা ১০ মাসের শিশুট নিয়ে পিড়ায় বসে আছেন। যত্নসহকারে স্বামী আর কন্যাকে খাওয়াচ্ছেন। মাটির কুপির আলো অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে-কলিমের ভাতের থালে কিছু পরিমান ভাত, কিন' ডাল দিয়ে থালা ভর্তি, পাশেই থালার এক কোনায়, এক চিলতে মুলা ভাজি, আর মুলা শাক। কি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন-জবাবে কলিম জানান, বাবা ছেলে আজ রিক্সা চালিয়ে আয় করতে পারেনি। স্ত্রী পাশের বাড়ি থেকে এক মগ (এক পোয়া) চাল ধার করে এনেছে। তাই রেধেছে। আর সাথে ৩ টাকার হাফ কেজি মুলা আর ২ টাকার মুলা শাক আলাদা করে ভাজি করেছে তাই দিয়ে খাচ্ছি। থালার মধ্যে এতো ডাল যে-বাবা এটা ডাল নয়, গরম ভাতের মধ্যে পানি দিয়েছি। সবাই একটু একটু করে খেতে হবে, তাই পানি না দিলে তো পেট ভরবে না !

আর সহ্য হলো না। বন্ধু ফরহাদ চোখের পানি লুকাতে দ্রুত চলে গেলেন একটু আড়ালে। তার পরে কলিমের ঘরের ভেতর থেকে ফরহাদ ডাক দিলেন-দেখে যান। দ্রুত সেখানে গেলাম-খুব বেশি হলে ১০ হাত লম্বা একটি খড়ের ঘর। একপাশে একটি চৌকি পাতা। পাশেই দড়ি টানানো, সেখানে স্ত্রীর শাড়ি,মেয়ের কাপড় সহ ১০ বছরের শিশুটির ছোট ছোট কাপড়ের খন্ডবিশেষ ঝুলছে। বিছানায় একটি ছেড়া কাঁথা পাতানো রয়েছে।

ঘরের এক পাশে একটি সিলভারের পাতিল, আর এক পাশে বস-ায়বাধা আছে শীতের দুটি মাত্র কম্বল। এখানে সবাই থাকেন-জবাবে কলিম জানান, ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্ত্রী বিছানায় থাকে আর আমি পাটি নিয়ে মাটিতেই পড়ে থাকি। সামনে শীত-নির্বাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, দুইটা কম্বল আছে! এই দুটোতে শীত যাবে? জবাব নেই কলিমের।

কলিম জানালেন, বাবার দেয়া ৪ একরের মত জমি ছিল। ভাই আর চাচারা কৌশল করে সব লিখে নিয়েছে। তারপর বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তাদের। শশুড় বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন-সেখানে লোকসংখ্যা বাড়াতে
ইসরাফিল নামক এক ব্যক্তির জমিতে একটি ঝুপড়ি ঘর করে বাস করছেন।

বাড়ি বলতে একটি ঝপড়ি ঘর, পাশেই খোলা আকাশের নিচে একটি চুলা। আসবাবপত্র বলতে ৩ টি সিলভারের পাতিল, কয়েকটি থালা আর দু-তিনটি বাটি। পানি খেতে হয় আর পানির কাজ সারতে হয় প্রতিবেশির টিউবওয়েল থেকেই।

কিডনির অসুখ-প্রতিদিন ওষুধ লাগে ৫১ টাকার। চাল লাগে আড়াই কেজি, তারওপর তেল, নুন, তরিতরকারি। সবমিলে ২শ টাকার নিচে হয় না। ১৩ বছরের ছেলে কতই বা আর আয় করবে-সব মিলে কোনদিন ১শ টাকা আবার কোনদিন ১শ৫০ টাকা আয় করে। এক বেলা উপোষ আর এক বেলায় গরমভাতে পানি মিশিয়ে খাবার অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের। ১০ বছরের সন-ানটির ভরসা হলো ভাতের ফ্যান আর মায়ের বুকের দুধ।

এটা কার্তিক মাস। চারদিকে অভাব। এখনো ধান কাটা মারা ঠিকমত শুরু হয়নি। ধান কাটতে পারলে হয়তো ৩/৪ মন ধান পাওয়া যেতো। সরকারি সাহায্য, রিলিফ পাননি-কলিম উদ্দীন জানান, গত নির্বাচনে শরীরের খারাপ অবস্থার জন্য কাজ করতে পারিনি। ভোট দিয়েছি-তারপরও পাইনি কোন সাহায্য। গরিবেরও একটা শ্রেনী আছে। কিন' শহরের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে এমন হতদরিদ্র-জীবনসংগ্রামে লিপ্ত মানুষ এখনো অন-তঃ একবেলা না খেয়ে থাকে-বিষয়টির যেন কোন জবাব নেই। পকেট হাতরে দু-বন্ধুর পকেট থেকে ২শ টাকা বের হলে-১৩ বছরের রিক্সা চালক শিশু জুয়েলের হাতে তা নিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান করতে হলো।