ন হন্যতে

বিনয় দত্ত
Published : 7 Feb 2012, 01:52 AM
Updated : 24 Jan 2021, 07:45 AM

১.

"কোন কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।"
– নারী: কাজী নজরুল ইসলাম।

কাজী নজরুল ইসলামের 'বিজয় লক্ষী নারী' এখন অবহেলিত, ঘৃণিত, অপমানিত। সময় বদলেছে। বদলেছে মানুষের রুচি-অভিরুচি। বদলেছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এত পরিবর্তনের ভিড়ে মানুষের মানসিকতা আরো অধঃপতিত হয়েছে। নজরুল সেইসময় নারীকে প্রেরণার শক্তি-ভক্তি হিসেবে তুলনা করেছেন। কিন্তু এখন আসলে নারীকে ছোট করে দেখা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কটূক্তি করার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই একটা শ্রেণি। তাদের আমরা চিনি জানি। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের চিনতে চাই না।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড গোয়ালপুরা গ্রামের সন্দ্বীপপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইয়াছমিন আকতার (৩০) ও তার স্বামী মো. রাছেল (৩৫)। ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ভোর রাতে যৌতুকের দাবিতে রাছেল প্রথমে ইয়াছমিনের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। এরপর মোটর সাইকেলের পেট্রোল ঢেলে ইয়াছমিনের যৌনাঙ্গ ঝলসে দেয়। ইয়াছমিনের শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে। শরীরে আগুন দেওয়ার পর রাছেল তার শ্বশুর হারুনুর রশিদকে ফোন দেয়। এ সময় মুঠোফোনে বলে, 'তুর মেয়েকে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছি, এসে নিয়ে যা।' (প্রথম আলো, ২০.১১.২০২০)

গত ১৭ বছরে যৌতুকের জন্য শুধু ঢাকায় ৩৭৪ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবছর ঢাকাতে গড়ে ২২ নারীকে হত্যা করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গত এক বছরে যৌতুকের জন্য ১৪ জন নারী হত্যার শিকার হন। (প্রথম আলো, ১২.১০.২০১৯) বিষয়টা যৌতুক হলেও আদতে এর পিছনে আরো কারণ আছে। সেই কারণগুলো আমরা জানব।

মূলত, নারী প্রতি কটূক্তি, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, শ্লীলতাহানী, হত্যা সবই এখন সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। এগুলো আসলে ইটের উপর ইট গাঁথার মতো। সমাজে এত বেশিমাত্রায় কটূক্তি, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন, শ্লীলতাহানী, হত্যা হচ্ছে, যে কেউই এখন যেকোনো অজুহাতে নারীর প্রতি সহিংসা দেখাতে সাহস পাচ্ছে। দেশের জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যক্তি সবাই নারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছে। প্রশ্ন হলো, তারা কীভাবে এই সাহস সঞ্চয় করল?

বগুড়া-৭ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মো. রেজাউল করিম বাবলু। রেজাউল করিম ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলে, 'ধর্ষণের সঙ্গে টি-শার্ট পরে রাস্তায় বের হওয়ার সম্পর্ক আছে। আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবেই নারী ও পুরুষের মাঝে আকর্ষণের সৃষ্টি করেছেন। যখনই কোনো যৌবনপ্রাপ্ত নারী অশালীন পোশাকে রাস্তায় চলাফেরা করবেন, তখন কুরুচিসম্পন্ন মানুষ তাদের কুদৃষ্টিতে দেখবে।' (ডেইলি স্টার, ১৯.১১.২০২০)

পোশাক ব্যবসায়ী ও অভিনেতা অনন্ত জলিল ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তায় জানায়, 'অশালীন পোশাক ধর্ষণের কারণ, শালীন পোশাক পরা নারী কখনোই ধর্ষণের শিকার হন না।'

তারও আগে ২০১৩ সালে হেফাজতের প্রয়াত আমীর আহমদ শফী বলেছিল, 'মেয়েরা তেঁতুল – তাদের দেখলে পুরুষের দিলে লালা ঝরে।'

বিভিন্ন ক্ষেত্রের তিনজন আলাদা পুরুষের বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। এই তিনজনকে অনেকেই চেনেন। একজন দেশের জনপ্রতিনিধি, একজন ব্যবসায়ী ও অভিনেতা, আরেকজন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনজন তিন অঙ্গনে কাজ করে। তিনজনের শিক্ষা এবং বেড়ে ওঠাও আলাদা আলাদা জায়গায় কিন্তু নারী সম্পর্কে তিনজনের চিন্তা এক। যদিও আহমদ শফী এখন মৃত, কিন্তু তার চিন্তাভাবনা সমাজের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে অন্তত কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে তো বটেই। এই ভাবনা এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, তা সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে।

২.

২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ (সংশোধন) বিল, ২০২০ পাস হয়। এতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধর্ষণের মহামারী বন্ধে এই আইন কার্যকরী হবে বলে সবাই আশা করছেন।

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হলেও, ধর্ষকের মন পরিবর্তন বা শুদ্ধতার যে কার্যক্রম তার জন্য কোনো বিধান বা আইন রাখা হয়নি। নারীর প্রতি সমাজের প্রতিটি স্তরে পুরুষের যে ঘৃণা বা ক্ষোভ জন্মেছে এইটা কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাবে তা সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এইবার অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা বলি।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটনা। বাসা থেকে বের হয়েছি। দ্রুত পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে। চোখের সামনে অল্পবয়সী একটি মেয়েকে ফ্ল্যাক্স হাতে যেতে দেখলাম। যে বয়সে মেয়েটির হেসে খেলে বেড়ানোর কথা সেই বয়সে সে চায়ের ফ্ল্যাক্স হাতে নিয়ে চা ফেরি করছে। তার বাবা কি তাকে জোর করেছে? হয়তো। নাকি সে স্বেচ্ছায় এই পথে নেমেছে। তাও হয়তো। নাকি তার স্কুল বন্ধ দেখে সে পরিবারকে সহযোগিতা করছে। হতে পারে।

যে প্রয়োজনেই সে চা ফেরি করুক না কেন নিঃসন্দেহে তার ইচ্ছা, শ্রম, আকাঙ্ক্ষা সবই সৎ। একজন বয়স্কলোক মেয়েটির কাছাকাছি বয়সী একটি ছেলেকে চা খেতে বলে। ছেলেটি চিৎকার করে বলতে থাকে, ''মাইয়া মাইষের হাতে যে বেডা চা খায়, হে বলদ।'

কথাটা বলতে বলতে সে মসজিদের দিকে আগাল। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটি সেই কথা শুনেছে কিন্তু সে ভ্রূক্ষেপ করেনি। তার মুখ হাসিতে ভরা। এই হাসিটা বড়ই সরল। মধুর।

এই ছেলেটি যেখানে বড় হয়েছে, যে পরিবেশে সে মানুষ হয়েছে, যাদের সে দেখছে অর্থাৎ যাদের সে আদর্শ মানছে সব জায়গায়ই নারীদের এইভাবে দেখা হয়। এই যে মননের অধঃপতন, এই সংকট সমাধানে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই বললেই চলে।

আমি প্রায়শই সমাজের চারপাশটা দেখি। রাস্তায়, দোকানে, অফিসে, আড্ডায় সবজায়গায় নারীর চলন-বলন, আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক নিয়ে অসংখ্য কথা হচ্ছে। যারা এইসব কথা বলছে তারা প্রত্যেকেই কারো দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। যারা এদের প্রভাবিত করছে তারাই হলো একজন রেজাউল করিম, একজন অনন্ত জলিল, একজন আহমদ শফী বা অন্যকেউ। যাদের একটি কথা সমাজকে ভিন্নদিকে নিতে পারত। কিন্তু তারা নারীর পোশাক নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাদের মগজে-মননে কখনো ভালো চিন্তার উদয় হবে না। ফলে শূন্যতার জায়গাটা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে।

৩.

'গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কারগিল গার্ল' (Gunjan Saxena: The Kargil Girl) নামের একটি চলচ্চিত্র ২০২০ সালে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটির পরিচালক শরণ শর্মা। চলচ্চিত্রটি মূলত ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময় প্রতিনিধিত্বকারী একজন বৈমানিকের গল্প। সেই বৈমানিক একজন নারী এবং তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম মহিলা অফিসার। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী দুটি বড় পরিকল্পনা করেছিল। এই দুই পরিকল্পনার মধ্যে একটি ছিল অপারেশন বিজয় এবং অপরটি অপারেশন সাফেদ সাগর। অপারেশন বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট গুঞ্জন সাক্সেনা। গুঞ্জন হেলিকপ্টার নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করে প্রবল সাহসীকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত ভারতীয় সৈন্যদের উদ্ধার করেছিলেন।

চলচ্চিত্রে একজন নারীর সেইসময়ের প্রতিবন্ধকতাগুলো যেভাবে ফুটে উঠেছে তা সত্যিই অকল্পনীয়। প্রতি মুহূর্তে ভয়ানক প্রতিবন্ধতা মাথায় নিয়ে গুঞ্জন তার লক্ষ্যে পৌঁছেছে। চলচ্চিত্রটি অনবদ্য।

আমার এখনো মনে আছে, দেশের প্রথমসারির গণমাধ্যমে আমি কাজ করতাম। সেই প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠান বিভাগে নারীদের ওয়াশরূমে নারীদের জন্য বেশিরভাগ দিনই টিস্যু দেয়া হত না। ক্লিনারকে বললে সে মাথা চুলকে দিতে আসত। অথচ এইটা ছিল তার কাজ এবং দায়িত্ব। এই অবহেলাটা ছিল ইচ্ছেকৃত। সেই একই অফিসে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আলাপে জেনেছিলাম তারা আসলে নারীদের কতটা হীন চোখে দেখে। এটি একটা নমুনা মাত্র। এইরকম শত শত ছোট-বড় ঘটনা, প্রতিক্ষণে নারীদের হেয় করা কথা বলা, ওয়াজীদের প্রতিনিয়ত নারীদের অপমান করা আর নারীর পোশাকের পিছনে পড়ে থাকা জাতির কারণে বাকিদের মধ্যে ক্রোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

যে রাছেল তার স্ত্রী'র গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে কি শুধু যৌতুকের কারণে দিয়েছে? নিশ্চয় নয়। যে ছেলেটা মেয়েদের হাতে চা খাওয়াটাকে বলদামি হিসেবে দেখছে সে কি এমনিতেই এই চিন্তা করছে? নিশ্চয়ই না। এরা প্রতিনিয়ত এইসব বিষয় দেখছে। ফলে তাদের মগজে-মননে এই বিষয়টা জেঁকে বসেছে। তাদের কথাই হলো, মেয়ে মানুষ মানেই হলো নির্যাতন, নিপীড়ন বা হেয় করা বা অপমান করে কথা বলার সর্বোচ্চ জায়গা। মজার বিষয় হলো, এরা সবসময় এসবই দেখছে, শুনছে এবং জানছে। আবার এদেরকে প্রভাবিত করেছে কোনো না কোনো রেজাউল করিম বা অনন্ত জলিল। যারা প্রতিনিয়ত নারীকে তাচ্ছিল্য করে। যে কাজটা তারা নিজের বাসায় করত, সেই কাজটা জনসমাগমে বা গণমাধ্যমে জানিয়ে করেছে। এর প্রতিকারের ইচ্ছা প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের নেই। যদি থাকত, তবে রেজাউল করিমকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হোত। একজন সাংসদ কখনোই এই ধরনের কথা বলতে পারে না।

১৯৭৪ সালে বিখ্যাত লেখক মৈত্রেয়ী দেবী'র 'ন হন্যতে' প্রকাশিত হয়। 'ন হন্যতে' শব্দের অর্থ হলো, যা মরে না বা হত্যা করা যায় না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, নারী মূলত ন হন্যতে। শত, সহস্র, লক্ষাধিক মন্তব্য আসলেও নারী তার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। তাকে দমন করা সহজ নয়।