সু চি-র ভাবমূর্তি উদ্ধারে মিয়ানমারে সামরিক শাসন?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 Feb 2012, 11:30 AM
Updated : 2 Feb 2021, 04:47 PM

তিনি যে খুব দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় ছিলেন তা বলা যাবে না। সামরিক বাহিনীর বেঁধে দেওয়া পথেই হাঁটতে হয়েছে। কিন্তু সেটুকুও আর রইল না। সেনারা সেটুকুও কেড়ে নিল। মিয়ানমারের ৭৫ বছর বয়সী অং সান সু চিকে আবারও গৃহবন্দী জীবনে ফিরে যেতে হলো। কিন্তু কেন এমনটা হলো? মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তো সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার অংশীদার ছিল, বরং সু চিকে সামনে রেখে তারা তাদের অপকর্মগুলো ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিল। সেনারা দুর্নীতি, হত্যা, গণহত্যা সবকিছুই চালাচ্ছিল আপন খেয়ালে, সুচির সুরক্ষা ও সমর্থনে, তাহলে তাদের কেন সরাসরি ক্ষমতা কেড়ে নিতে হলো? এর পেছনে কোন রাজনীতি কাজ করছে? বলা হয়, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার ঘুঁটি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও তেমন কিছু নয় তো?

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর সেই প্রশ্ন এসেছে। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। একজন জেনারেলকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেশের প্রধান নেত্রী অং সান সু চিসহ আটক করা হয়েছে সে দেশের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্তকেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর মতে, দেশের প্রথম সারির রাজনীতিকদের অনেকেরই নাকি হদিশ মিলছে না।

নতুন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে দেশটিতে নতুন করে সেনাশাসন কায়েম করা হলো। এর আগে, ১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত, প্রায় পাঁচ দশক মিয়ানমারে সেনা শাসন কার্যকর ছিল। ২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। সেনাবাহিনী অবশ্য সাংবিধানিকভাবেই দেশটির ক্ষমতার ভাগীদার ছিল। সু চির দলের সঙ্গে তারা বোঝাপড়ার মাধ্যমেই চলছিল। দেশের প্রধান নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে রেখেই দেশটিতে এক ধরনের 'গণতান্ত্রিক' ব্যবস্থা চালু ছিল। মাত্র তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের নভেম্বরে দেশটিতে সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে জিতে পুনরায় সরকার গঠন করে সু চির এনএলডি। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। তার পর থেকেই মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ও ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছিল। সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনী উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা রয়েছে যার মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য। সামরিক বাহিনীর সেই 'সাংবিধানিক' ক্ষমতার জোরেই আজ সু চি কারাবন্দী হলেন।

সু চিকে একসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মানবাধিকারের বাতিঘর বলা হতো। যিনি একজন আপসহীন অধিকারকর্মী হিসেবে দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতায় থাকা নির্দয় সামরিক জেনারেলদের চ্যালেঞ্জ করতে নিজের স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় এবং তাকে "ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতার অনন্য উদাহরণ" হিসেবে সম্বোধন করা হতো। তখনও তিনি গৃহবন্দীই ছিলেন। এর পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি এনএলডি'র নেতৃত্ব দেন এবং যাতে বড় ধরনের জয় পান তিনি।

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সু চি যে ধরনের দৃঢ়তা দেখিয়ে গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আইকনে পরিণত হয়েছিলেন, ক্ষমতার উঠোনে বসে তিনি তার সেই ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারেননি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের আপসের মধ্য দিয়েই তিনি তার রাজনৈতিক জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। দেশের পশ্চিমে রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উচ্ছেদ এবং গণহত্যার অভিযোগে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মহলে সু চি-র ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও দেশীয় রাজনীতিতে আগের মতোই জনপ্রিয়তা ছিল তার। কিন্তু নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ ঘিরে সম্প্রতি আঙুল উঠতে শুরু করে তার দিকে। দেশের নির্বাচন কমিশন যদিও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী তা মানতে নারাজ।

মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি কারণ তার সন্তানেরা বাইরের দেশের নাগরিক। তবে ৭৫ বছর বয়সী সু চি দেশটির প্রধান নেত্রী হিসেবে সুপরিচিত। তবে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তার নেতৃত্বকে দেশটিতে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন।

২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ স্টেশনে প্রাণঘাতী হামলার পর রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অথচ সু চি এই ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ গণহত্যা রুখতে কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর নিন্দা কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি। ২০১৯ সালে হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপের বিষয়ে তার উপস্থাপিত বক্তব্যে তিনি সেনাবাহিনী অভিযানের পক্ষেই যুক্তি দেন। এর পর তার আন্তর্জাতিক সুনাম বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। মানবতার অপমানকে উপেক্ষা করে, নিজের বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কেবল ক্ষমতাপন্থী হয়ে টিকে থাকতে সু চি এত কিছু করলেন। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও তাকে আবার সেই অন্তরীণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতেই হলো!

মিয়ানমারে সেনাবাহিনী যেভাবে যা চাইছিল, মোটামুটি সেভাবেই দেশ চলছিল। তারপরও সেখানে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের কারণ কি? আসলে রাখাইনে হত্যা এবং নির্যাতনের তদন্তসহ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে মিয়ানমারের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছিল। সেনাবাহিনী আর সু চি-র সরকারের ওপর ভরসা করতে পারেনি। আর ভৌগলিক রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমার প্রতিটি শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্বে নিন্দা ও সমালোচনা হলেও রাতারাতি যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ হবে, সেই সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মহলের দাবি মেনে সামরিক সরকার হয়তো কয়েকমাস পর আবার সু চি-র দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করে দেবে। হয়তো নতুন নির্বাচনও হবে। ততদিনে রাখাইনে হত্যা-মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগটা একটু ফিকে হয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিটিও পেছনে পড়ে যাবে।

ওদিকে কয়েকদিনের 'নির্জন অবকাশ' জীবন কাটিয়ে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সু চি যখন আবারও ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের সুযোগ পাবেন, তখন রোহিঙ্গা-ইস্যুতে সৃষ্ট কালিমালিপ্ত ভাবমূর্তি ধুয়েমুছে বেশ একটা গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে। যার সঙ্গে, ভারত, চিন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধে অর্থবাণিজ্যের খেলায় অংশ নিতে পারবে। জো বাইডেনের আমেরিকা থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে সু চি আবার গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠবেন। ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে উদ্বিগ্ন, ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে বিভক্ত, খাদ্যের অভাবে জর্জরিত দেশটিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের অন্য কোনো তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।