ইউক্রেইন যুদ্ধ ও সভ্য বিশ্ব

শামস্ রহমানশামস্ রহমান
Published : 24 Feb 2012, 12:19 PM
Updated : 11 July 2022, 02:34 PM

যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার 'যেড' সংকেত লাগানো জলপাই রঙের সাঁজোয়া যানের বহর বেলারুসের সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেইন প্রবেশ করে। এ অভিযানের প্রায় সাড়ে চার যুগ আগে আমি নিজেও ঠিক সে পথেই গিয়েছিলাম ইউক্রেইনে। প্রথমে মিনস্ক থেকে বেলারুসের সীমান্ত পেড়িয়ে কিয়েভ। তারপর কিয়েভ থেকে আরও দক্ষিনে মালদোভার রাজধানী কিশিনিয়েভে। রাশিয়ার সাঁজোয়া যানগুলো ইউক্রেইন সীমান্তে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, অথচ আমরা সেদিন নির্বিঘ্নে পৌঁছে গিয়েছি আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এমনকি আমার এক ইউক্রেইনিয় বন্ধু কিয়েভ ট্রেন স্টেশনে এসেছিল আমাদের স্বাগত জানাতে।

তারপর কিশিনিয়েভ থেকে গিয়েছি মালদোভার গ্রাম-গঞ্জে, যৌথ-খামার হয়ে ওদেসা বন্দর নগরীতে। হাই স্কুলে উঠে ভূগোল পাঠে আমার হাতেখড়ি 'দ্য ওয়ার্ল্ড' নামের এক পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে। সেখানে দুনিয়ার নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত উপত্যকা, দেশ-বিদেশের মানচিত্র থেকে শুরু করে খুঁজে পাই দন‌বাসের খনিজ সম্পদের খনি। যুদ্ধ শুরুর পরপর দু দুবার বেলারুসের যে অঞ্চলে রাশিয়া-ইউক্রেইনের মাঝে শান্তি আলোচনা হয় তার নাম গোমেল ওব্লাস্ত। মিনস্ক থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেখানেও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। বন্ধুদের সাথে গ্রীষ্মের দিনে নদীতে ঝাঁপিয়েছি বহুবার। এককথায়, এই পুরো অঞ্চলটি আমার অত্যন্ত পরিচিত। আন্তরিকতার সাথে খুঁজলে চার যুগের পুরনো বুটের তলায় এখনও হয়তো মিলবে ইউক্রেইনের গমের দানা, সূর্যমুখি ফুলের সোনালী পাঁপড়ি, বেলারুসের ইয়াগাদির গন্ধ আর মালদোভার ফল-ফুলের শুক্র।

তখন অবশ্য রাশিয়া, বেলারুস, ইউক্রেইন আর মালদোভা সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সবাই রুশ ভাষায় কথা বলতো। সবাই একই উৎপাদন আর বিতরণ ব্যবস্থায় সাজিয়েছিল তাদের সমাজ ও সংসার। দীর্ঘ ছয় বছরের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, সে সমাজে মানুষে মানুষে প্রীতি আছে। একে অপরের সাহায্যে অনায়াসে এগিয়ে আসার অভিলাষ দেখা যেত। এখন তাদের মাঝে শুধুই যুদ্ধ, ধ্বংস, আর মৃত্যু।

গত কয়েক মাস ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে পূবে-পশ্চিমে লেখালেখি হয়েছে অজস্র। এ যুদ্ধ কেন, কিভাবে এ যুদ্ধের শুরু, তা বিশ্ব মানুষ ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছে যে যার মতো করে। তাই দোষী-নির্দোষীর সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য নতুন কিছু লেখার সুযোগ যেমন সীমিত, আমার তাগিদও তেমনি কম। তবে যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সামাজিক মিডিয়া থেকে পাওয়া কোন এক অজানা কবির নীচের কবিতাটি শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি। যুদ্ধে কি ঘটছে এবং ঘটবে তারই এক চিত্র ফুটে উঠেছে বলে আমার ধারণা। কবিতাটি এমন –

কোন এক ধূসর প্রভাতে

এ যুদ্ধও শেষ হবে

তখন শীতের কোকুন থেকে বসন্তের

প্রজাপতি হয়ে উড়া আর

ঝরা পাতা ঘেরা কোন এক রাজপ্রসাদে

সেনাপতিরা একে অপরের বাহুবদ্ধ হবে সানন্দে

অকৃত্রিম হাসি হাসবে

হয়তো ব্রেজনেভ-হোনেকারের মত দীঘল চুম্বনেও আবদ্ধ হবে

দুচুমুক বিশুদ্ধ সুরা সেবনের প্রভাবে।

স্মার্ট যুদ্ধ-প্রযুক্তির ক্ষত তখনও লেগে থাকবে –

বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে

বলশেভিক্‌ দেয়ালে

সভ্যতার দম্ভে।

শহীদ সন্তানের প্রত্যাবর্তনে মা তখনও প্রতিক্ষায়

প্রহর গুণবে –

'খোকা নিশ্চয়ই ফিরবে'!

অষ্টাদশী মেয়েটি!

প্রেমিকের পথ চেয়ে কাটাবে সময়

ঘুরে ফিরে সূর্যমুখীর ভিড়ে যেখানে কেটেছে মধুময় লগ্ন;

আর সেই সন্তানেরা

যারা জনকের বুকে মাথা রেখে

রূপকথার গল্পে দেখেছে রঙিন স্বপ্ন!

জনকের পদধ্বনির প্রতিক্ষায় বিনিদ্রায় তখনও

কাটাবে তারা নিরংশু আঁধার –

'আবার দেখা হবে তো পিতার?'

সংসার আজ তার দেবতার 'বিসর্জনের অর্ঘ্য'

কে ফেলেছে 'ন্দিয়েপারে' সূদীর্ঘ ধিওরের ফাঁদ? –

অতি পরিচিত জানিত মুখ অথচ অজানা

তবে কে দিচ্ছে মূল্য, তা জানা।

কবির সাথে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন। দেবতারা অত্যন্ত চেনা-জানা অথচ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আর ইউক্রেইন যে 'বিসর্জনের অর্ঘ্য' তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর প্রমাণ মেলে 'দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে' সম্প্রতি ছাপা এক প্রবন্ধতে। প্রবন্ধকার লেখেন – 'Good going, Vlad. Thank you for strengthening NATO. If only the price, measured in Ukrainian pain and suffering, weren't so high'। যার মানে – 'ভালোই করেছ, ভ্ল্যাদ (ভ্লাদিমির পুতিন)। ন্যাটোকে শক্তিশালী করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এ জন্য যতটা মূল্য দিতে হলো, তা ইউক্রেইনিয়দের দুঃখ ও দুর্দশা। তবে তা (ন্যাটোর শক্তিশালী হওয়ার তুলনায়) খুব বেশি নয়'।

(Max Boot, The Washington Post, 17 May 2022)।

অবশ্যই। পৃথিবীর পরাক্রমশালী দেশের কাছে ইউক্রেইনিয়দের দুঃখ-দুর্দশা আর এমনকি! ছয় মিলিয়নের অধিক অধিবাসী দেশ ছাড়া হয়েছে আর প্রায় চোদ্দ মিলিয়ন দেশের মধ্যেই গৃহ হারা (The Conversation, 7 June, 2022) তাতে 'দেবতা'দের কি যায়-আসে! তাদের যা পাওয়ার, তা তারা পেয়ে গেছে। অন্যদিকে, রঙিন পর্দার ভাঁড়, ইউক্রেনিয়দের নেতা দুঃখ ও দুর্দশা আর ধ্বংসের মাঝেও ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মত লাফাচ্ছে প্রতিদিন।

এসব সরাসরি 'জীবনের মূল্য'। তার পাশাপাশি আছে দেশের সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি? সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে যে গত ১০০ দিনে ইউক্রেইনের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে প্রতিদিন রাশিয়ার খরচ হচ্ছে প্রায় দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। আর উন্নয়নশীল দেশের মানুষ যারা এ যুদ্ধের ধারে-কাছে নেই, স্বল্প সম্পদে সংসার চলে যাদের, তারা পরোক্ষভাবে বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি আর সাপ্লাই চেইনের ব্যাঘাতে মরতে বসেছে। তাদের নিয়ে কারও কোন মাথা নেই, বরঞ্চ যুদ্ধে দেবতাদের পক্ষ না নেয়ার ফলে আজ তারা প্রচণ্ড চাপের মুখে। যদিও জুনিয়ার বুশের মতো বলছে না যে, 'You are either with us or with them', তবে হাবভাবে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।

এখানে নেলসন ম্যান্ডেলার একটা মন্তব্য স্মরণ করার মতো। সময়টা ১৯৯০। দীর্ঘ ২৭ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ম্যান্ডেলা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। এবিসি নিউজ- এর এক বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেই অনুষ্ঠানে রিগ্যান প্রশাসনের প্রাক্তন কূটনীতিক কেনেথ অ্যাডেলম্যান মন্তব্য করেন যে, মানবাধিকার ইস্যুতে কাস্ত্রো, আরাফাত এবং গাদ্দাফির প্রশংসা করার জন্য তিনি ম্যান্ডেলার উপর হতাশ এবং প্রশ্ন করেন তারা কি তার মানবাধিকার নেতৃত্বের মডেল? জবাবে ম্যান্ডেলা বলেন, "One of the mistakes which some political analysts make is to think that their enemies should be our enemies"।

ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের কথাই ধরুন। মেরুকরণের প্রশ্নে উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে। স্বীকার্য যে গ্লোবালাইজড অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, তাই বলেই তারা যা বলবে তাই শুনতে হবে? রাশিয়া, পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর শত্রু বলে উন্নয়নশীল দেশগুলোরও শত্রু হতে হবে?

এবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাই ধরুন। যখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে আর অস্ত্রে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে নিশ্বংসভাবে হত্যা করে, তখন কোথায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আর মানবাধিকার? তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জারের জিও-পলিটিক্যাল স্বার্থই ছিল মুখ্য। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের কী হবে বা হতে পারে ইয়াহিয়ার পাশবিক পদক্ষেপে, তাতে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। কিসিঞ্জার বলেছিলেন – "No one has [yet] understood what we did in India-Pakistan and how it saved the China option which we need for the bloody Russians. Why would we give a damn about Bangladesh? (Gary Bass, 2013, The Blood Telegraph, p. 342)। জীবনের পরিহাস, সেই চীনই আজ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

একাত্তরে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়াতো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জাতিসংঘে তিন বার ভেটো না দিতো, নিঃসন্দেহে অনিশ্চিত হয়ে যেত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তথাকথিত সভ্য দেশগুলো কথায় কথায় গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা বলে বটে, তবে যুগ যুগ ধরে ধ্বংস করে আসছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর স্বাধিকার আন্দোলন, সেই সাথে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার আন্দোলন। এটা শুধু ১৯৭১- এ বাংলাদেশের বেলায় নয়। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান, ইরাক, কিউবা, চিলি, কঙ্গোসহ উন্নয়নশীল বহু দেশের বেলায় একই ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব কি এটাই প্রমাণ করে না যে, বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলোই আসলে কর্তৃত্ববাদের ধারক-বাহক? গণতন্ত্র আর মানবাধিকার বিষয় দুটো নিছক ছুতো; কর্তৃত্ব বজায় রাখার অস্ত্র। আসলে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় নয়; বিশ্বব্যাপী তাদের আধিপত্য বিস্তারের মানসেই মানবাধিকার ইস্যুতে পক্ষপাতমূলকভাবে ব্যবহার করে থাকে। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ মন্তব্য করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের 'hypocrisy suggests that it is at least partly global hegemony, not values, that is really at stake' (Joseph Stiglitz, How the US could lose the new cold war, Jun 17, 2022, Project Syndicate).

তথাকথিত সভ্য, হাতেগোনা কয়েকটি, দেশ একে অপরের স্বার্থে নিজেদের মাঝে যুদ্ধ বাঁধায়। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও অসভ্যের মতো হত্যা করে একে অপরকে, ধ্বংস করে সমাজ-সংসার। ইউক্রেইনের যুদ্ধ কি তাই প্রমাণ করে না?

বিংশ শতাব্দীতে ওইসব দেশ বাঁধিয়েছিল আরও দুটো যুদ্ধ। পশ্চিমা ইতিহাসবিদরা এ দুই যুদ্ধকে আখ্যায়িত করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে। আসলেই কি এগুলো বিশ্বযুদ্ধ? নাকি স্রেফ ইউরোপের কয়েকটি তথাকথিত সভ্যদেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব- যা রূপ নেয় যুদ্ধে, যেখানে এক পর্যায়ে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণেই এই যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তে 'ইউরোপ মহাযুদ্ধ' বা তথাকথিত 'সভ্যদের যুদ্ধ' বলাই অধিকতর যথোচিত নয়কি? বিশ্বের শতকরা ৭৫-৮০ ভাগ মানুষ দৈহিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিকভাবে এসব যুদ্ধ থেকে বহুদূরে ছিল। যে যুদ্ধে না ছিল তাদের কোন স্বার্থ, না ছিল কোন বিবাদ। এককথায়, তাদের কাছে এ যুদ্ধ ছিল অপ্রাসঙ্গিক এবং অসংশ্লিষ্ট। অথচ তাদের উপরও নেমে আসে ধ্বংস, দুঃখ-দুর্দশা। এমন কি বিষাক্ত গ্যাস এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয় কেবল ইউরোপে নয়, মধ্যপ্রাচ্যে ও ভারতে। কথিত যে তখন উইনস্টন চার্চিল যুদ্ধমন্ত্রী থাকাকালীন বিষাক্ত গ্যাস এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। যুদ্ধমন্ত্রী চার্চিল এক সরকারি মেমোতে লিখেন – 'chemical weapons should be used against recalcitrant Arabs as an experiment."

সেই সাথে আরও লেখেন-

I am strongly in favour of using poisoned gas against uncivilized tribes' (Peter Harrison, Was Churchill advocate of chemical weapons' use in Middle East? Al Arabiya, 19 Feb., 2015)।

উপরের সেসব ঘটে 'ইউরোপ মহাযুদ্ধ- ১' বা তথাকথিত 'সভ্যদের যুদ্ধ -১' এর সময়। এবার ইউরোপ মহাযুদ্ধ- ২ বেলায় দেখুন। আগের মতোই, যুদ্ধ লাগায় ইউরোপে আর দুর্ভিক্ষ ঘটায় বাংলায়। গবেষকদের মতে, বাংলায় ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, যাতে ৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, ঘটে মূলত যুক্তরাজ্যের অমানবিক নীতির কারণে, যাকে বলা হয় 'denial policy' বা 'প্রত্যাখ্যান নীতি' । Churchill's Secret War- গ্রন্থের লেখক মধুশ্রী মুখার্জি উল্লেখ করেন যে একদিকে চার্চিল ভারতের গমের চাহিদা মেটাতে অস্বীকৃতি জানায়, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রচেষ্টায় ইন্ধন জোগাতে ভারতের চাল রপ্তানি করেন ইউরোপে। শুধু তাই নয় যুদ্ধে জার্মানি এবং ইতালির কব্জা থেকে ইউরোপীয় বেসামরিক নাগরিকদের মুক্ত করার পর তাদের খাওয়ানোর জন্য গমের মজুদ তৈরি করার নির্দেশ দেয় যুক্তরাজ্য। মধুশ্রী মুখার্জি বলেন – এ কারণেই ১ লাখ ৭০ হাজার টন অস্ট্রেলিয়ান গম ক্ষুধার্ত ভারতকে বাইপাস করে – খাওয়ার জন্য নয়, ইউরোপে সংরক্ষণের জন্য (Madhusree Mukerjee, Churchill's Secret War: The British Empire and the Ravaging of India during World War II, 2010)। এটা শুধুই 'denial policy' বা 'প্রত্যাখ্যান নীতির' বিষয়ই নয়, এখানে চার্চিলের বর্ণবৈষম্যের দিকটিও উন্মোচিত হয়।

এরপরও দুর্ভিক্ষের জন্য দোষ দেওয়া হয় ভারতীয়দের। চার্চিল ভারতীয়দের দোষারোপ করে এই বলে যে –

Indians were "breeding like rabbits", and asking how, if the shortages were so bad, Mahatma Gandhi was still alive.

ভাবুন, কী ধরনের রুঢ় মন্তব্য তথাকথিত সভ্য সমাজের একজন রাষ্ট্রনায়কের পক্ষ থেকে। আজ তারাই দাবি করছে যে ইউক্রেইনের কৃষ্ণ সাগর বন্দরগুলোর রাশিয়ান অবরোধে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে এবং তাতে নাকি উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন অংশের কয়েক ডজন দেশ খাদ্য সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে! হয়তো সত্য, তবে এটা কি এক ধরনের ভণ্ডামি নয়? ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের 'hunger game' দায়ী নয় কি? তাই প্রশ্ন হচ্ছে, গত একশ বছরে পশ্চিমা দেশগুলো প্রকৃত অর্থে আদৌ কি সভ্য হয়েছে?

আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি – বিশ্ব মানবতা আর মানবাধিকারের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর অবদান বলে আছে কি কিছু? দূর-দূরান্ত থেকে এসে শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের বন্দরে নোঙর করে তাদের জাহাজ লুণ্ঠন ও শোষণ করে সম্পদ। ক্রীতদাস বানিয়ে শোষণ করে শ্রম, পশু-পাখির মতো বিক্রি করে পশ্চিমের হাটে বাজারে। এখানেই শেষ নয়। ধ্বংস করে আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি; টেকসই জীবনধরনের পদ্ধতি। তাদের অমানবিক ও বর্বর কীর্তি-কলাপের কথা বলা যান আরো অনেক, কিন্তু কী বলতে চাচ্ছি তা নিশ্চয়ই পরিষ্কার।

অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা রাশিয়া তৃতীয় বিশ্বের বন্দরে হানা দেয়নি, লুণ্ঠন করেনি অন্যের সম্পদ, ধ্বংস করেনি তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি। ১৯১৭- এর বলশেভিক বিপ্লব মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যেমন লোভ-লালসার বিপরীতে আর ব্যক্তিবাদী তত্ত্বের বাইরে গিয়ে অন্য ধরনের সমাজ গড়তে চেয়েছিল। স্বীকার্য যে উৎপাদন আর বিতরণের সে অভিনব ব্যবস্থা ৭০ বছরেই ধসে পড়ে, তবে মানবতা আর মানবাধিকারের প্রশ্নে বিশ্ব মানচিত্রে তার প্রভাব অস্বীকার করা দুরূহ। ঔপনিবেশিক সমাজ সচেতন হয়েছে এ বিপ্লবের প্রভাবে। তাদের মাঝে জাগে আত্মবিশ্বাস, যা রূপ নেয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনে। এ প্রচেষ্টায় পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি ঔপনিবেশিক অঞ্চল স্বাধীনতা অর্জনে সফল হয়। শুধু ঔপনিবেশিক অঞ্চলই নয়, বলশেভিক বিপ্লবে প্রভাবিত হয় ঔপনিবেশিক শক্তির সমাজও। উৎপাদন-বিতরণে না হলেও প্রভাব পড়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অনেক সামাজিক অঙ্গনে।

এসব অতীতের কথা। প্রশ্ন হচ্ছে অতীত থেকে কি আমরা আদৌ শিখি? বিজ্ঞজনেরা যা বলেন, তা হতাশ হবার মতো। তাই তো যুদ্ধ দেখি বারবার। বিশ্ব মানবতা আর মানবাধিকারের স্বার্থে এখন শান্তির ডাক দেওয়ার সময়। সভ্য সমাজ গণতন্ত্রের কথা বলে প্রতিনিয়ত। সেই গণতন্ত্রের প্রশ্নেই কি শান্তির ডাক দেওয়া উচিত নয়? বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ ইউক্রেইন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তারা শান্তির পক্ষে। এটাই যদি গণতন্ত্র না হয়, তবে কিসে হবে গণতন্ত্র? তাহলে কোথায় সভ্য সমাজের গণতন্ত্র? বিশ্ব গণতন্ত্রের স্বার্থে এখনই বন্ধ হোক যুদ্ধ।