বাংলাদেশ কারাগার-অনিয়ম (পর্ব – এক)

ঘৃতকুমারী
Published : 14 Dec 2014, 10:37 AM
Updated : 14 Dec 2014, 10:37 AM


বাংলাদেশ কারা ব্যবস্থাপনা প্রশাসনিক অনিয়ম পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কারা ব্যবস্থাপনার ইতিহাস খুজে পাওয়া যায় বহু প্রাচীন কাল হতে। আনুমানিক ৮ আট হাজার বছর পূর্বেকার। বাংলাদেশে কারা ব্যাবস্থাপনার উদ্ভব হয়। সম্ভবত ১৭৭২ সালে বৃটিশ গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেসটিংস্ এই উপমহাদেশে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত সৃষ্টির মাধ্যমে কারাগার প্রতিষ্টা করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশ জেল নামে কারা ব্যাবস্থাপনার অবতারনা হয়। যদিও স্বাধীনতার পরও আজ অব্দী বৃটিশ প্রনীত ১৮৬৪ সালের বেঙ্গল জেল কোর্ড অনুসরন করেই চলছে বাংলাদেশ জেল। ২০০৪-২০০৫ সালে কারা বিধীর কিছু সংস্কার করা হয়। স্বাধীনতার পর ৪টি কেন্দ্রীয় কারাগার ১৭টি জেলা কারাগারে ও ৪৩টি উপকারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল এর কার্যক্রম শুরু হয়।বর্তমান কারা অধীদপ্তর বাংলাদেশ সরকারের স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে পরিচালিত। আই,জি(প্রিজন) এর অধীনে আনুমানিক সাড়ে আট হাজার জনবল নিয়ে ৭২ হাজার হাজতী ও কয়েদী বন্দিকে নিয়ন্ত্রন করছেন কারা অধিদপ্তর। তার মধ্যে রয়েছে ১১টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার। কেন্দ্রীয় কারাগারগুলো হলো (১) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (২) কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ (৩) কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ (৪) ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার (৫) যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার (৬) বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার, (৭) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার (৮) কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার (৯) সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার (১০) রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার (১১) রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার। দেশের ৬টি বিভাগের জন্য ৪জন উপ-মহা পরিদর্শক (ডি,আই জি-প্রিজন) রয়েছে তা'হলো(১) ঢাকা বিভাগ (২) চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ, (৩) রাজশাহী বিভাগ,(৪) খুলনা ও বরিশাল বিভাগ। এই ছয়টি বিভাগের জন্য সর্বমোট ৪জন ডি,আই,জি প্রিজন কাজ করে যাচ্ছেন। তারা তাদের বিভাগের অধীনে কারাগারগুলোর অপারেটিং কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিভাগের অধীনে রয়েছে ৩টা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ১৬টি জেলা কারাগার। কেন্দ্রীয় কারাগারগুলো হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার,কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২,ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ১৬টি জেলা কারাগার। ঢাকা বিভাগীয় কারাগার গুলোতে মোট বন্দি ধারন ক্ষমতা হলো ৮২৬৪ জন। সেখানে অবস্থান করছেন ২৫৪৯২ জন। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধীনে রয়েছে ৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার (১) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার (২) কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার (৩) সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ১২টি জেলা কারাগার। এই বিভাগের অধীনে ১৫টি কারাগারের ধারন ক্ষমতা হলো ৭১৮৩ জন,সেখানে বন্দি অবস্থান করেন ১৯,৭৩৪ জন। রাজশাহী বিভাগের অধীনে রয়েছে ২টা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ১৩টি জেলা কারাগার। কেন্দ্রীয় কারাগারগুলো হলো (১) রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ও রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার। মোট ১৬টি কারাগারের ধারন ক্ষমতা হলো ৫,৫৫১ জন; বর্তমানে সেই জায়গায় অবস্থান করেন ১৩,১৮৫ জন।
খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধীনে রয়েছে ২টা কেন্দ্রীয় কারাগার যথা (১) যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ও বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ১৪টি জেলা কারাগার। এই বিভাগের ১৬টি কারাগারে সর্বমোট ধারন ক্ষমতা হলো ৫,৯৯৮ জন,বর্তমানে অবস্থান করছেন ১২৯১৬ জন।
৬৬টি কারাগারের ধারন ক্ষমতা হলো ২৭,৯৬১ জন; বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছেন ৭১,৩২৭ জন। পুরুষ বন্দির সংখ্যা ৬৯,০৭১ জন মহিলা বন্দিও সংখ্যা ২,২৫৬ জন। উপরের পরিসংখ্যান থেকে এটা পরিষ্কার ভাবেই বলা যায় ধারন ক্ষমতার চাইতে প্রায় ৩ গুণ বেশী বন্দিকে কারাগারে রাখা হয়। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে ধারন ক্ষমতার ৫/৬ গুন বেশী বন্দি রাখা হয়। মহা পরিদর্শক (প্রিজন) সংক্ষেপে বলা হয় আই,জি (প্রিজন)। তিনি সাধারনতঃ সেনাবাহিনী মেডিক্যাল কোর হতে ডেপুটেশনে ৩ বছরের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। অতি সম্প্রতিকালে সেনাবাহিনীর ইনফেন্ট্রী কোর হতে এই পদে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আইজি প্রিজনের সহযোগী হচ্ছেন এডিসনাল আই,জি (প্রিজন); তিনি সেনাবাহিনীর কর্নেল পদ মর্যাদায় হয়ে থাকেন। সাধারনত সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোর হতে নিযুক্ত হন। ৪ জন বিভাগীয় উপ-মহা পরিদর্শক অর্থাৎ ডি,আই,জি প্রিজন রয়েছেন ফিল্ড অপারেশনের দায়িত্বে। তারা বিভাগের অধীনে প্রতিটি জেলের দৈনন্দিন কাজ পর্যবেক্ষন,পর্যালোচনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাদের বিভিন্ন স্তরের সহযোগীদের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন সিনিয়র সুপার,একজন ডেপুটি সুপার, একজন জেলর, কমপক্ষে ৪জন ডেপুটি জেলর থাকেন। জেলা কারাগারগুলোতে ১জন সুপার, ১জন জেলর কোন কোন ক্ষেত্রে ২জন ডেপুটি জেলর তা না হলে স্বাভাবিক ভাবে ১জন ডেপুটি জেলর নিযুক্ত হন। এরা কারা অধীদপ্তরের অধীনে কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচিত হন।
প্রতি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২জন সুবেদার,কমপক্ষে ২০/৩০ জন জমাদার ও আনুপাতিক কারারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন। জেলা কারাগারগুলোতে ১জন সুবেদার ৬ থেকে ৮ জন জমাদার,আনুপাতিক হারে কারারক্ষী থাকেন। দেশে সর্বমোট আনুমানিক ১০,০০০ জন কারারক্ষী রয়েছে। তবে বাংলাদেশের জেল বাহিনী দেশের রেগুলার বাহিনী নয়। কারা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে নিয়োগ,পদন্নোতি,বদলী ও শাস্তি নিয়ে রয়েছে বিশাল দুর্নীতির নেট ওয়ার্ক। যা হলো নিম্নরুপ :
১.কারা অধিদপ্তরের অধীনে সাব-জেলার বর্তমান ডেপুটি জেলার নিয়োগ প্রদান করা হয়, এই সমস্ত ডেপুটি জেলার নিযুক্তির ক্ষেত্রে একদিকে রাজনৈতিক ও অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রভাব থাকে। নতুবা প্রতিটি সরকারের আমলে সরকার দলীয় অযোগ্য প্রার্থীদের এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
২. যাদের সরকারী দলের দাপট নেই, তাদেরকে বিভিন্ন অংকের টাকার বিনিময়ে সাব জেলর বর্তমানে ডেপুটি জেলর পদে নিযুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পর হতে অঙ্কের বিষয়টি ১০ হাজার টাকা হতে বাড়তে বাড়তে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উঠে এসেছে।
৩.একজন জেলর বা সুপার হতে হলে তাকে মন্ত্রনালয় হতে শুরু করে তার উর্ধ্বতন সকল কর্তৃপক্ষকে খুশি করতে কমপক্ষে ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়।
৪.সিনিয়র সুপার/সুপার ও জেলরকে ভাল জেলে (যেখানে বদলী হলে প্রচুর অবৈধ উপার্জন করা যাবে) বদলী হতে হলে স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও আই,জি প্রিজন সহ সকলকে খুশী করতে হয় অর্থের বিনিময়ে;তার পরিমান নিদেন পক্ষে ৫ লক্ষ টাকা।
৫.ডেপুটি জেলর হতে জেলর পদে পদোন্নতি পেতে স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।
৬.সিনিয়র সুপার/সুপার ও জেলার যদি কোন অপরাধ করেন এবং সাময়িক ভাবে বরখাস্ত হন;তা থেকে মুক্তি পেতে হলে টাকা খরচ করে মন্ত্রনালয়ের কর্তৃপক্ষকে খুশী করতে হয়।
৭.কারারক্ষী নিযুক্ত হয় টাকার বিনিময়ে। টাকার বিনিময়ে কারারক্ষী পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সর্বশেষ রেট উঠে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। যার ফলে ফেরিওয়ালা ,রিক্সাওয়ালা অশিক্ষিত কুশিক্ষিত এমনকি দাগী অপরাধীরাও এই বাহিনীতে নিযুক্ত হয়েছে তার প্রমান রয়েছে ভুরি ভুরি। যদিও বর্তমানে কারা রক্ষীতে শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা সুযোগ পাচ্ছে,তবুও ঘুষের অঙ্কটা যথারীতি প্রদানের রীতি চালু রয়েছে।
৮.কোন সিনিয়র সুপার যদি আইন বহির্ভূত কাজ করেন তাকে শাস্তি প্রদান; এমন কি কোনরূপ নোটিশ প্রদানের ক্ষমতা আইজি প্রিজনকে দেয়া হয়নি। সিনিয়র সুপার/সুপারদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রনালয়কে। যার ফলে সিনিয়র সুপার/সুপার পিছন দরজা দিয়ে স্ব-রাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ফেলে তার কৃত অপরাধ হতে পার পেয়ে যায় অনায়াসে।
৯.জেল কোডে কারা কর্তব্যের অবহেলায় জড়িতদের শাস্তির কথা উল্লেখ করেছে যে, এভাবে যদি দায়িত্ব পালন কালে ঘুমানো অবস্থায় পাওয়া যায় তাহলেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে, কিন্তু দুর্নীতির দায়ে কোন জেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অভিযুক্ত হলে সেই দায়ে গ্রেপ্তার করে জেলে প্রেরণের কোন বিধান রাখা হয়নি। কারা প্রশাসনের নিয়োগ,পদোন্নতি ,ভাল জেলে বদলী শাস্তি মওকুফের ব্যাপারে দুর্নীতি এমন জঘন্য রূপ নিয়েছে যে, তার দু'একটি ঘটনা…………………..চলবে
পোস্টটি পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে at news bd এখানে ।