বাংলাদেশ কারাগার-অনিয়ম (পর্ব – চার)

ঘৃতকুমারী
Published : 1 Jan 2015, 11:27 AM
Updated : 1 Jan 2015, 11:27 AM

থানা পুলিশের হেফাজতে কয়েক দিনের ধকল দৈহিক ক্লান্তির ভার বইবার শক্তি হারিয়ে ফেলে প্রতিটি বন্দি। পরিশ্রান্ত শরীর ঘুমে অচেতন বন্দি; শুরু হয় পাহারা ও ফালতুদের চুরি করার মহোৎসব। নবাগতদের পায়ের জুতা থেকে শুরু করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয় ২/৩ ঘন্টার মধ্যে। এছাড়া রয়েছে পৈশাশ্চিক মনোবৃত্তির লালসা পূরনের আস্ফালন। ইনচার্জ পাহারা, পাহারারা আগেই দেখে রাখেন কোন কোন বন্দির বয়স কম; রাতের আঁধারে সমকামি লালসা পূর্ণ করার দানবীয় তান্ডবতায় নেমে পড়ে। এমন একটি ঘটনার বর্ণনা না দিলে বোধ হয় বিবেক সম্মত মানুষরা জানবেনা কত নিকৃষ্টতম স্থান হলো জেলখানা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলের মধ্যে সেরা জেল। ২০০৪ সালের মার্চ মাস ২৮/২৯ তারিখ হবে; আমদানী নবাগত বন্দি এসেছে আনুমানিক ২৮০জন। কয়েদী বন্দি সি, আই,ডি ওস্তাগার করিম লক আপ নিয়েছে আমদানীতে। জেলের সবাই জানে করিমের মাঝে সমকামিতার মনোবৃত্তি রয়েছে। সেই রাতে নবাগতদের মধ্যে ঢাকার একটি বে-সরকারী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র এসেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ফাগুনের হাওয়া আর জোস্না রাতের মাধুরীতে জেগে ওঠে করিমের মাঝে নর পৌশাচিকতা; ঝাপিয়ে পড়ে শিক্ষাত্রী ডাক্তার বন্দির উপর। মুখ চেপে ধরে করিমের তান্ডবতার লালসা মিটিয়ে ফেলে। ভদ্রলোকের সন্তান; ডাক্তারী পড়–য়া বন্দির মুখে কোন শব্দ নেই। লজ্জায় মারা যায় যায়; তবে পাশে শোয়া দু'একজন এই দৃশ্য দেখেছিল বলে সকলেই  ঘটনা জানতে পারে। ২/৩ দিন পর মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে যায় সেই ডাক্তারী   পড়–য়া বন্দি।রাতের ঘুম শেষ হতে না হতেই শুরু হয় ভোরের ডাক; গুনতি দিতে হবে। জেলর ফাইল, ডাক্তার ফাইল, সাহেব ফাইল এর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। কয়েক দিনের অমানবিক ধকলের পর পরিশ্রান্ত শরীর মন চায় আরো একটুখানি ঘুমিয়ে নিতে। তা হবার সুযোগ নেই ফালতু, পাহারাদারের হাক ডাক, চর-থাপ্পর মা-মাশি তুলে গালাগালি একে বারে রাতের আকাশে নব-কোলাহল সৃষ্টি হয়ে যায়। রাত ৪-০০ টায় চার জন করে ফাইল করে বসানো হয়। এরই মধ্যে সকলেই মিলে ছুটে যায় টয়লেটের দিকে। প্রায় তিনশত লোকের জন্য ২/১ টি টয়লেট ভেবে দেখুন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাড়ায়। সে অবস্থায় যদি চার চার লাইন হয়ে বসার জন্য বলা হয় তাহলে বন্দিদের শ্যাম রাখি না কুল রাখির মতো অবস্থা হয়ে যায়। একটুখানি দেরি হলেতো রক্ষা নেই চর-থাপ্পর। যদি এদিক সেদিক হয়ে যায়  সেক্ষেত্রে লাটি পেটা, কোমরের পেট্রী-খুলে পেটানোর মতো ঘটনা ঘটে। গোনা শেষ হলে জেলার ফাইলের জন্য যেতে হয় কেইস টেবিলে।কেইস টেবিল থরে থরে ভলিয়ম বুক। নতুন টিস্যূ বক্সকে কিনা হয়েছে আমদানী কেইস টেবিল রাইটারের টাকায়। কেইস টেবিল এর চারদিকে দাড়ানো রাইটার, সুবেদার, জামাদার ও রক্ষীগণ। কেইস টেবিল থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে বসতে হয় বন্দিদের চার চার অথবা পাঁচ পাঁচ করে। তারপর বসে বিভিন্ন জেলা হতে আগত সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীগন। সর্বশেষে বসে যে সমস্ত পুরাতন বন্দি জেলের অভ্যন্তরে অপরাধ করেছে তাদের বিচারের জন্য জেলার ফাইল করার লক্ষে। জেলার সাহেব আসেন অনেকটা রাজা বাদশার কায়দায়। দু'পাশে বরকন্দাজের অভাব নেই। জেলার আসার সাথে যখন বলা হবে বন্দিগণ সাবধান তখন সকলে এক সাথে দাড়িয়ে বলবে "আসসালামু আলাইকুম" যখন বলা হবে "যেমন  ছিলে তেমন" তখন সবাই আবার মাটিতে বসে যাবে। জেলার সাহেব আসার সাথে সাথে শিখানো বুলি কাজ হয়। বড় বড় ভলিয়ম সই করেই শুরু হয় নবাগত বন্দিদের ফাইল। চীফ রাইটার নাম ডাকে বন্দি দাঁড়ায় তাকে দেখে জেলার সই করে। বন্দি ভিতরে যায় ভিতরে গিয়ে আবার লাইনে বসে সকালের নাস্তার জন্য। এবার ৪: ৪ লাইন করে বসতে হয়।রুটি খাওয়ার জন্য লাইনে বসে অপেক্ষা করতে হয়। আসে রুটি, আটার রুটি হলেও মনে হবে চামড়ার তৈরী। তাও আবার এমনভাবে পোড়া তাতে পূর্ণিমার চাঁদ না দেখা গেলেও এটা বোঝা যাবে সমস্ত জেলখানার খাদ্য ভান্ডার সর্বশ্রান্ত হয়ে গেছে। সাথে যে আখের গুড় দেয়া হয় তা দেখলে পেটের ভিতরে যা আছে তাও বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। পেটে ক্ষুধার যন্ত্রনায় কোন ভাবে টেনে হিচড়ে একাকার করে ফেলে; মনে পড়ে যায় প্রতিদিন রাস্তার ধারে ডাস্টবিনের পাশের কুকুরগুলো কয়েকটি হাড় নিয়ে যেভাবে টানা হ্যাচড়া করে তার দৃশ্য।রুটির পর্ব শেষ হতে না হতেই ডাক্তার ফাইল আবার চার চার জন করে আমদানী লক আপের বাইরে বসানো হয়। দু'একজন এদিক সেদিক ঘুরা ফেরা করে কৌতুহলবসত; খোঁজাখোঁজি করে ধরে এনে বেধরক পিটায় রাইটার, পাহারা এবং কয়েদী মিলে। ডাক্তার সাহেব এক নজর দেখে  টিকেট সই করে আমদানীতে পাঠিয়ে দেন নবাগতকে। সেখানে নবাগতদের বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আসা রাইটার ও পাহারাগণ। টাকা-পয়সা, লেন-দেন ঠিক করে আমদানী রাইটারের নিকট যথাযথ বুকিং দেন রাইটার ও পাহারাগণ।সকাল ৯.০০ টার সময় সাহেব ফাইল? কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোতে সিনিয়র সুপারের পক্ষে ডেপুটি সুপার সাহেব ফাইল করেন। জেলা কারাগারগুলোতে সাহেব ফাইলে করেন স্বয়ং সুপার। সুপার ফাইলের জন্য পুণরায় ৪: ৪ জন করে বন্দিদের বসানো হয় কেইস টেবিলে। এবার শুরু অবৈধ অর্থ লেনদেন পালা। যদি ভাল থাকতে চায় তবে বন্দিকে টাকা খরচ করে নিজের পছন্দমত ওয়ার্ড পাহারা, রাইটার, ইনচার্জ পাহারা এলাকায় ওয়ার্ড পাশ করিয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ওয়ার্ডে যেতে হলে ১০০০/- টাকা, সেলে যেতে হলে ৬০০০/- টাকা হতে ১০,০০০/- টাকা পর্যন্ত রেট রয়েছে। সেই মূহুর্তে যা দিতে পারে দিবে, বাকী টাকা ১ সপ্তাহের মধ্যে দেখায় আত্মীয় স্বজন এলে দিয়ে দিতে হবে।  তবে ওয়ার্ড রাইটার ও পাহারাদের নিজের পক্ষে হতে আমদানী রাইটারকে টাকা দিয়েই মক্কেল নিতে হবে। সেই টাকা হতে ২৫%- কেটে রেখে বাকী টাকা সুবেদার সাহেবকে দেয়া হয়। যেই সমস্ত বন্দি টাকা পয়সা দিতে পারে না, তাদের নামের অদ্যাক্ষর দেখে ওয়ার্ড দেওয়া হয় এবং জঘন্যতম জায়গায়।আমদানীর ধকল শেষ করে টাকা-পয়সা যা ছিল তা সর্বশান্ত হয়ে মারধর চর-থাপ্পর, অশ্লীল ভাষা, মানসিক নির্যাতনে বিধ্বস্থ হয়ে নবাগত বন্দিগণ দিন পেরিয়ে বিকেলে চলে যায় তাদের জন্য নির্ধারিত গন্তব্যে। মনে হয় এক অচিনপূরী, এ যেন এক ভীন গ্রহ। এখানকার মানুষগুলোর আচার-আচরণ যেন অদ্ভুত, অপরিচিত। অসহায় হয়ে পড়ে প্রতিটি বন্দি। দিশেহারার মতো ছটফট করতে থাকে আপনজনের দেখা পাওয়ার জন্য।

বাংলাদেশ কারাগার-অনিয়ম (পর্ব -তিন) পড়তে বিডি নিউজ এখানে  অথবা at news bd এখানে ক্লিক করুন ।