সমঅধিকার, স্বাধীনতা, প্রতারণা। শব্দগুল অনেক মারাত্মক তাই না ? আসলে সমঅধিকার বলতে আমরা কি বুঝি? প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা কাকে বলে? আর প্রতারণাই বা কি? আমি নিশ্চয় এসবের সংজ্ঞা দেবার জন্য এই লিখাটি লিখছি না। পাঠক একটু কষ্ট করে এসবের প্রকৃত সংজ্ঞা জেনে নিবেন। আমি শুধু এই কয়েকটা শব্দ নিয়ে একটু সমালোচনা করতে চাই, দেশের সমালোচিত খবরকে পাশে রেখে।
প্রতারণা দিয়েই শুরু করা যাক। আপনি যদি কাউকে বিয়ে করতে চেয়ে কোন কারণে বিয়ে না করেন, তাহলে কি আপনি প্রতারক? বিয়ে… ব্যাপারটা আবারও চিন্তা করেন। এইটা বিয়ে। ছেলে খেলা না বা প্রেমও না। ভাল লাগছে না, আর প্রেম করলাম না। অথবা এই খেলাটা মজার না, এইটা আর খেলব না। আসলে বিয়েটা কি সেইরকম কিছু?
৫/৬ বছর বা তারও বেশি প্রেমের সম্পর্ক থাকা সত্যেও অনেকেই মনের মানুষ ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করছে। কিন্তু কেন? তাঁরাও চেয়েছিল প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে সংসার করতে। মনে হয় দু’জনের একজন চায়নি অথবা অন্য কোন সমস্যা ছিল। তাই বলে কি তাদের একজন প্রতারক আর একজন প্রতারিত? প্রেম করার সময় আমরা আমাদের বেশিরভাগ ভাল সময়গুলো একে অন্যের সাথে অতিবাহিত করে থাকি। একসাথে কিছুদিন থাকতে শুরু করলেই না আমরা বুঝতে পারি আমাদের মাঝে কতটা মিল আর কতটা অমিল। মিল আর অমিল বের করার সুযোগ যদি কারও থাকে, সে নিশ্চয় এসব ব্যাপার মাথাই রেখেই বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
এবার বলি এখনকার শীর্ষ সংবাদ হ্যাপী-রুবেলের ব্যাপারে। আমরা অনেকেই মনে করছি হ্যাপী প্রতারণার শিকার, আবার অনেকেই মনে করছি রুবেল ষড়যন্ত্রের শিকার। আবার অনেকই এসবের উল্টোটা ভাবছি। আমরা যে যেটাই ভাবি না কেন তাতে মনে হয়না সমস্যার সমাধান হবে। আমার মনে হয়েছে আমার কয়েকটা বিষয় সমালোচনা করা উচিত। আমি ঠিক সেটাই করছি।
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষ (১৮+) নিজ নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। যদি তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই তার জন্যই ভাল। আর যদি তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেন, সেই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল তাকেই গুনতে হবে। তাহলে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ যদি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর প্রেমে পড়েন, তার মানে তারা জেনে বুঝে একে অন্যের প্রেমে পড়েছে। আর যখন কোন যুগল একে অন্যের প্রতি প্রেম বধ করে তখন একজন আর একজনকে সর্বদায় বিস্মিত করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে ফুল উপহার দেওয়া, রেস্তোরায় খেতে যাওয়া, গাড়ী রেখে প্রেমিকার মান ভাঙ্গানোর জন্য রিক্সা চালানো। এসব প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। কে কাকে আগে পছন্দ করেছে, কে কাকে আগে আমি তোমাকে ভালবাসি বলেছে, কে আগে চুমু খেয়েছে এসব কিন্তু প্রশ্নাতীত। যেই আগে পছন্দ করুক না কেন, এক জন আগে করে থাকলে অন্য জন নিশ্চয় তাতে সাঁয় দিয়েছে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নারী একে অন্যের প্রেমে পড়েছে, প্রেম করেছে, শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে। অবাক হবার কিছু নেই, প্রেমের সম্পর্কে শারীরিক সম্পর্কও সেই সম্পর্কের একটা অপরিহার্য অংশ।
প্রেম করার সময় দিনের পর দিন, শুটিং এর কথা বলে রাত্রি যাপন এইসব প্রেমেরই অংশ। দুজনের সন্মতিতেই চলছিল সবকিছু। এটাতো প্রেম, বিয়ে না। রুবেল কোন কারণে বিয়েতে রাজি হয়নি। ব্যাস, তখনি তা হয়ে গেল ধর্ষণ। এতদিন যে শারীরিক সম্পর্ক প্রেমের মধুচন্দ্রিমা ছিল, বিয়ে না করতে চাওয়াতে সেটা হয়ে গেল ধর্ষণ। আসলে একেই কি ধর্ষণ বলে ?
আচ্ছা, আমি যদি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে বলি, “আপনাকে আমার অনেক ভাল লাগে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।” কিছু দিন পরে আমাদের মাঝে খুব ভাল একটু সম্পর্ক হল, প্রেমই বলতে পারেন। শারীরিক সম্পর্কও হল। কিন্তু আরও কিছু দিন পরে সেই সুন্দরী আমাকে কোন কারণে বিয়ে করতে চাইলো না। সে আমাকে অনেক কারণের মাঝে ২টি কারণ জানালো যে, আমি ধূমপান করি, আমি মদ্যপ, আর আমাকে নাকি তার আগের মত ভাল লাগছে না, তাই এই রকম একটা মানুষের সাথে সে সারাজীবন কাটাতে চায়না। এখন আমার কি করা উচিত? থানাই গিয়ে সেই সুন্দরীর নামে মামলা করা? অমুক আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে ধর্ষণ করেছে!! হাস্যকর না ব্যাপারটা?
রুবেল বিয়েতে রাজি না হওয়াতে তাদের মাঝের শারীরিক সম্পর্কটার নাম নাকি ধর্ষণ? ঐ শারীরিক সম্পর্কটাতে কি হ্যাপীর সম্মতি ছিল না? অনেকে বলবেন হ্যাপী বিশ্বাস করেছিল যে, রুবেল তাকে বিয়ে করবে তাই সে শারীরিক সম্পর্কটা করেছে। যদি তাই হয় তাহলে এটার নাম ধর্ষণ হয় কি করে? রুবেল হয়তো সত্যি সত্যি চেয়েছিল হ্যাপীকে বিয়ে করতে, কিন্তু সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে হ্যাপীর কিছু ব্যাপার রুবেলের ভালো নাও লাগতে পারে। তখন রুবেল তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেই পারে। এটা হ্যাপীর ক্ষেত্রেও হতে পারতো। তাহলে এটাকে কি আমরা প্রতারণা বলব? এ ধরনের ব্যাপার শুধু রুবেল অথবা হ্যাপীর মতো তারকাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এ কথাগুলো আপনার আমার প্রতিটি মানুষের সাথে যুক্ত। যদি ধর্মের দিক থেকে চিন্তা করি তাহলে ইসলাম ধর্ম মতে, একজন বেগানা পুরুষ কখনই একজন বেগানা নারীর সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে পারবে না। রাত্রি যাপন বা শারীরিক সম্পর্ক এগুলো অনেক দূরের ব্যাপার । তারা যদি ধর্ম মেনেই চলতো তাহলে কিঘটনা এতদূর যেত?
এবার আসুন স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। প্রাশ্চাত্য বা ইউরোপের মানুষগুলো মনে হয় আমাদের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন তাই না? তারা বিয়ে করার আগেই ৩/৪ সন্তানের জনক/জননী হয়ে যাচ্ছে। যেভাবেই নিননা কেন, এখানে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। কারণগুলো নিয়ে আর একদিন আলোচনা করা যাবে। ওরা আসলেই স্বাধীন। মন যদি কিছু না চায়, তারা সহজে তা করেনা। বিয়ে না করে সন্তাত নেওয়াটা, অনেক কারণের মাঝে স্বাধীন চিন্তাধারা একটি। ২/৩ বছর সংসার করার পর অন্য কাওকে ভাল লেগে গেলে, অন্য কারও সাথে সম্পর্ক তৈরি হলে কি করবেন? আসলেই তো !! হতেই পারে। এইটাই কি স্বাধীনতা না?
আমাদের সমাজ ব্যবস্থা সেরকম না। তাহলে আমাদেরকে আমাদের সামাজিক অবস্থার মাঝেই থাকা উচিত। যদি ইউরোপিয়ান সমাজ অনুসরণ করেন, তা হলে পুরোপুরি করুন। না পারলে নিজেদের সমাজ অনুসরণ করুন। প্রেম চলাকালীন সব ঠিক আছে, প্রেম কোন কারণে না থাকলে প্রেমিক/প্রেমিকার নামে মামলা করা উচিত কি? “সে আমার সাথে ৫ বছর সব ধরনের সম্পর্ক রাখার পর এখন আমাকে বিয়ে করতে চায় না, আমি এর বিচার চাই।” এমন করা আমাদের সভা পাবে কি?
রুবেল আর হ্যাপীর ঘনিষ্ঠতা যে কয়দিনই বা ছিল, তাতো মনে হয় উভয়ের সন্মতিতেই ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় পর যদি দুজনের কেউ সম্পর্কটা না চায়, অন্য জনের কি উচিত হবে তাকে জোর করে ধরে রাখা? যদি কেউ একজন চলে যেতে চায় এবং ব্যাপারটা অপরজনের কাছে গুছিয়ে বলে, তখন অন্যজনের কি উচিত মামলা করা? আপনারাই একটু চিন্তা করে দেখুনতো!!
সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে আপনি যদি অনুধাবন করেন, আপনি আপনার সঙ্গীকে আর ভালবাসেন না, তাহলে আপনি কি করবেন? তাকে ত্যাগ করবেন, নাকি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্ক চালিয়ে যাবেন? যদি সত্যি কথাটা বলে আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে বিদায় নিতে চান, তাহলে কি সেটা প্রতারণা করা হবে? বেশ কিছুদিন সম্পর্ক চলার পর হ্যাপী যখন দেখল রুবেল তাকে না অন্য কাওকে ভালবাসতে চায়, ঠিক তখনই হেপীর কি ভাবা উচিত, যে তিনি প্রতারিত হচ্ছেন? ব্যাপারটা উল্টোও হতে পারতো। তখন রুবেলের চিৎকার করাটা কি শোভা পেতো? যদি আমার প্রেমিকা আমার সাথে ৫ বছর সম্পর্ক রাখার পর অনুধাবন করে যে, সে আমাকে নিয়ে না বরং অন্য একজনকে নিয়ে অনেক সুখী, তখন আমার কি উচিত আমার সাবেক প্রেমিকার নামে মামলা করা? “সে আমার সাথে ৫ বছর সব ধরনের সম্পর্ক রাখার পর এখন আমাকে বিয়ে করতে চায় না, সে আমার সাথে প্রতারণা করেছে, আমি এর বিচার চাই।” এমন করা কি আমার সভা পাবে?
মুল কথাটা কি জানেন? রুবেল-হ্যাপী যুগল, আমি-আমার প্রেমিকা অথবা যেকোনো প্রাপ্ত বয়স্ক যুগল নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে। ডিসাইড, ছুইসাইড এই ইংরেজি শব্দগুল অনেক মারাত্মক। আপনি যখন কোন বিষয়ে সিধান্ত নেন, তার মানে আপনি অনেক ব্যাপার ভেবেই সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্ত নেবার আগে অনেক ব্যাপার ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। ভবিষ্যতের কথা মাথাই রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আপনার সিদ্ধান্তের ফল যদি ভাল হয়, তাহলে আপনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। যদি আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহনে ভুল হয়, তার মানে আপনিই এর জন্য দায়ী। আপনার ভুল সিদ্ধান্তের ফল অন্য কার ঘারে চাপান ঠিক হবে না। সেটা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।
প্রাকৃতিক নিয়মে গাছে বেল ধরবেই, সেই বেল বড় হবে। বেলটি সুস্বাদু হতে পারে আবার পঁচাও হতে পারে। কিন্তু বেল খাওয়ার আগে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি এই বেল খাবেন, কি খাবেন না? বেল খাবার পর যদি কেউ হজম করতে না পারে সেটা বেল এর সমস্যা না, অবশই সেটা খাদকের।
সুকান্ত কুমার সাহা বলেছেনঃ
দোষ বেলের না; দোষ মাথার! আবার দোষ মাথার না; দোষ হলো যে মাথাকে ন্যাড়া করেছে! – এভাবে যুক্তি দিয়ে আরও অনেক কিছুই বলা যায়। দেশীয় প্রবাদটা হল- বেল পাকলে কাকের কি?
ঠিক এভাবেই হ্যাপির আর রুবেলের ঘটনাটাও প্যাঁচানো যায়! মোদ্দাকথা হলো- রুবেল, হ্যাপির সাথে সহবাস করেছে এবং পরে তাকে ছেড়ে দিয়েছে আরও ভাল বা নতুন কাউকে পেয়ে; আর হ্যাপি সেটাকে ‘বিনা যুদ্ধে ছাড়িবো না সূচ্যগ্র মেদিনী’ পণে রুবেলের নামে ‘ধর্ষণ মামলা’ করে দিয়েছে। এর মধ্যে কে কাকে কি প্রতিশ্রুতি কি দিয়েছিল, সে কথা কেউ সঠিক করে বলতে পারবে না; কারণ ভালবাসায় হয় না এমন কোন ঘটনা পৃথিবীতে নাই!