ভিশন ২০৪৯ বাস্তবায়নে চিরস্থায়ী ক্ষমতা

আমীন কাদীর
Published : 8 July 2012, 05:20 PM
Updated : 8 July 2012, 05:20 PM

বঙ্গবন্ধুর শতমুখী স্বপ্ন, শেখ কামাল-সুলতানা কামালের ক্রীড়া জগতের স্বপ্ন, কামাল জামাল রাসেল সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন; আবুলি পদ্মা সেতুর স্বপ্ন, বঙ্গমাতা ফজিলতুন্নেসাসহ শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে জেলায়-উপজেলায়, বন্দরে-নগরে হাজারো সংকীর্তন—সংগঠনের অশেষ স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু দৌহিত্রীর অটিস্টিক স্বপ্ন, জয়ের ডিজিটাল স্বপ্ন—আওয়ামী লীগ এখন এক অফুরন্ত স্বপ্ন-সম্পদের খনি, যা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদের সঙ্গে দলটির একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অত্যাবশ্যক। দলটিকে আজীবনের জন্য ক্ষমতার চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা দরকার। শেখ হাসিনা '৯৬-২০০১ ক্ষমতা মেয়াদের শেষ দিনগুলোয় গণভবনকে চিরস্থায়ীভাবে নিয়েছিলেন। তেমনি এখন প্রয়োজন চিরস্থায়ী ক্ষমতা। নতুবা ভিশন ২১ কিংবা ভিশন ২০৪৯—অর্থাত্ দলটির একশ' বছর পূর্তিতেও এই স্বপ্নের অবসান ঘটবে না। অমাত্য-উমিচাঁদবর্গ সেই ভয়ংকর স্বপ্নই দেখিয়ে বিভ্রান্ত-পথভ্রষ্ট, বিপথগামী করছে নেত্রীকে। কিন্তু ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস—দলিল দস্তাবেজমূলে পাওয়া গণভবনও রক্ষা করা যায়নি, বরং তা নেত্রীর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। আজ জননেত্রী সেই গণতান্ত্রিক অতিথিশালার ক্ষণিকের অতিথি। জনগণ যে কোনো সময় অতিথিশালার চাবি কেড়ে নিতে পারে।

আজ আওয়ামী লীগের পাশে কেউ নেই। ঠোঁটকাটা চোখে আঙুল দাদারাও নেই যে দুঃসময়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে—নেত্রী আপনার কোথায় ভুল হচ্ছে। নেত্রী, এভাবে মসনদকে চিরস্থায়ী করা যায় না। কেউ চোখে আঙুল দাদা হতে সাহসও পাচ্ছে না। কেননা কেউ ভুলটি দেখালেই তাকে দমন করা হচ্ছে কঠিনভাবে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা যাদের বিশ্বাস করেছিলেন, কেউ বিশ্বাস রক্ষা করেননি। একই ট্রাজিক পরিণতি দেখেছি বঙ্গবন্ধু জমানাতেও। তিনি যাদের বিশ্বাস করেছিলেন, তারাই অর্থাত্ সেই আত্মীয়-অমাত্যবর্গ চরম বেইমানি করেছিল তার সঙ্গে।

বাকশাল নামের কলঙ্ক কায়েমের মাধ্যমে যারা 'শেখ বংশ'র শাসন ব্যবস্থা চালুর আড়ালে চেটেপুটে খেয়েছিল দেশকে, সেই রায় দুর্লভ উমিচাঁদ ইয়ার লতিফ-মীরজাফর-কাসিমদের কখনোই আওয়ামী লীগ নির্মোহ দৃষ্টিতে চিহ্নিত করেনি। ফলে নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবার, কিন্তু মীরজাফর-রায়দুর্লভরা ঠিকই দলের মধ্যে রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে। আওয়ামী লীগের হাতেই বারবার নিহত হয়েছে আওয়ামী লীগ, অথচ দলটি সেই অপ্রিয় ধ্রুব সত্যকে উন্মোচনই করে দেখেনি। ১৭৫৭ সালের মহা বিশ্বাসঘাতকতার দিনগুলোয় পরমাত্মীয় মীরজাফর-ঘষেটি বেগমদের বিশ্বাস করে বাঙালির স্বাধীন সূর্যকে অস্তাচলে বিসর্জন দিয়েছিলেন সিরাজ-উদদৌলা। সিরাজ শোকমহাকাব্যের লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, সিরাজ একবারই মরেছেন।

শেক্সপিয়রের ভাষ্যমতে, বীরের মৃত্যু একবারই ঘটে। কাপুরুষদের বারবার। সিরাজ একবার ট্র্যাজিক মৃত্যুবরণ করে মহাকালের পাতায় অনন্তকালের মহাবীর হিসেবে অক্ষয় হয়ে আছেন।
অন্যদিকে পলাশীর প্রান্তরে তত্কালীন নবাবি রাজশক্তিরও চিরকবর ঘটেছে। মীরজাফররা তা রক্ষা করতে পারেনি। ২৩ জুন এসবের স্মারক। প্রায় ২০০ বছর পর একই দিনে আধুনিক বাঙালির গণতান্ত্রিক স্বপ্নের অভ্যুদয় ঘটলেও সেই দলটি উল্টো বংশীয় নবাবির কবলে ধংসের মুখে পড়েছে একাধিকবার। দলটি মরতে মরতে বেঁচে গেছে আল্লাহর অসীম কৃপায়। গণতন্ত্রে বংশতন্ত্র—নবাবির স্থান নেই। আর এ কারণেই যারা দলটির বংশতন্ত্রের মীরজাফর-ঘষেটি বেগম—তাদের খুঁজে বের করা ও মূল্যায়ন প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বোঝা নন, তিনি সুযোগ্য উত্তরাধিকারী নেত্রী। জয়ও বোঝা হবেন না, যদি তিনি যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন। সুযোগ্যরা কখনোই দেশ, দল, দশের বোঝা নন। কিন্তু নিষ্ঠুর সত্যটি না বলে পারছি না—বঙ্গবন্ধু ও তার মেয়ে শেখ হাসিনার জন্য দুর্ভার, দুর্বহ, দুর্নিষ্কৃতিযোগ্য হিমালয় পর্বতমালাসম দুষ্কৃতির বোঝা হলো গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, গৌরনদীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সুবিশাল শেখ বংশ। মাননীয় নেত্রী মাঝেমধ্যে অত্যন্ত সঠিকভাবেই 'রক্ত বীজের ঝাড়' কথাটি নানা প্রসঙ্গে উপমা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

তার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি আমার কাছে বড় উপভোগ্য, রসোত্তীর্ণ এবং যথার্থ মনে হয়। বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান বলছে, 'রক্ত বীজের ঝাড় বা বংশ' হলো—যার বা যে বংশের বা দলের ধ্বংস নেই, বৃদ্ধি আছে। অর্থাত্ যা অবিরাম বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আমি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় অবিরাম বাড়তে থাকা যে বংশটির কথা বললাম, সেটি হলো রক্ত জীবের ঝাড়। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় আসবার পর তা অবিরাম বেড়ে চলছিল। স্পর্ধার চরম বাড়াবাড়ি করছিল। তার পরিণাম এই কথিত বংশ পদবিধারীরা ও তাদের লতাপাতার হঠাত্ গজিয়ে ওঠা আত্মীয়রা ভোগ করেনি, ট্র্যাজেডি হলো তা ভোগ করেছেন একা বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে এদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অহোরাত্র অমানুষিক পরিশ্রম করে শেখ হাসিনা '৯৬ সালে ক্ষমতায় এলেন। ক'দিন যেতে না যেতেই রক্ত বীজের আগমন। ২০০১ সালে আবার তারা দেশছাড়া। শেখ হাসিনা আবার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দলকে ক্ষমতায় আনতেই এরা জুটেছে বঙ্গবন্ধুকন্যার পিছু পিছু। ছায়ার মতো অনুসরণ করছে তাকে। শেখ হাসিনা প্রথম প্রথম অসাধারণ নৈর্ব্যক্তিকতা দেখিয়ে এদেরকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। কাজ হয়নি। ওরা নানাভাবে নানা চেহারায় জায়গা করে নিয়েছে। এই বংশধারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তাদের শালীর বেটির ভাগ্নের শালার পুত জাতীয় আত্মীয় ও কুটুম্বসহ অনেকে। এরা নানা ব্যবসা বাগিয়ে নিয়েছে। রেন্টাল বিদ্যুত্, জমির ব্যবসার আন্তর্জাতিক দালালিসহ নানা সেক্টরে দখলবাজি করেছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে একদল জ্ঞানপাপী, দুর্নীতির গলিঘুপচি আবিষ্কারকারক সাবেক সিএসপি ও বর্তমান আমলা। ওই বংশধারীদের জ্ঞানের অভাব, বুদ্ধির অভাব এরা পূরণ করেছে। আমি পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই, এইসব সিএসপি ও দুর্নীতিবাজ আমলারা আওয়ামী লীগের বন্ধু নন। এরা আওয়ামী লীগ-দ্রোহী; সরকারদ্রোহী, দেশদ্রোহী; রাষ্ট্রদ্রোহী। এরা আওয়ামী লীগ সরকারকে কখনোই সুবুদ্ধি দেয়নি। দিয়েছে দুষ্ট বুদ্ধি। এরা পরিত্রাণের পথ দেখায়নি। দেখিয়েছে অধঃপতনের পথ। আওয়ামী লীগের এই জাতশত্রুরা কোন সাহসে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের বলে দেশদ্রোহী! এই সাহস তারা কোথায় পায়? তাদের ইতিহাস কী? তাদের পুত্র-কন্যারা কোথায় থাকে, কোন দেশে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে খোঁজ নিয়ে দেখার একান্ত অনুরোধ করব—এসব সাবেক সিএসপির বংশধরেরা কোথায়, বাংলাদেশে নাকি ইউরোপ-আমেরিকায়? আরও একটি ব্যাপার খোঁজ নেয়ার অনুরোধ করি—বর্তমানের অনেক আমলা কানাডায় আমেরিকায় ইউরোপে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। কানাডায় বাড়ি করেছে। চুপি চুপি গিয়ে নাগরিকত্ব, রেসিডেন্টশিপ বাগিয়ে রেখেছে। কারও কারও স্ত্রী-সন্তান সেখানে অবস্থান করছে। এরা দ্বৈত নাগরিক। দেশ, সরকার, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের এই কার্যক্রম সরকারি চাকরিবিধির চরম লঙ্ঘন। সংবিধানের লঙ্ঘন। এদের কোনো অবস্থাতেই চাকরি থাকার কথা নয়। এরা রাষ্ট্রকে কী সেবা দেবে—এরা আওয়ামী লীগ সমর্থক আমলা সেজে দেশ ও দলের বারোটা বাজাচ্ছে। এরা দলকে কী আনুগত্য দেবে? কত বড় দুঃসাহস—এরা আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে সবক দেয়! নিজেরা অন্য রাষ্ট্রের গোপন চোরাই নাগরিক হয়ে আমাদের বলে দেশদ্রোহী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এদের চিহ্নিত করুন। খুঁজে বের করুন। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোয় এখন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী শাখা সংগঠন রয়েছে। সেসব সংগঠনকে নির্দেশ দিন—বলুন, বিদেশে এদের বাড়ি, গাড়ি, সম্পদ ও নাগরিকত্বের সব তথ্য হাজির করতে। আশা করা যায়, এক মাসের মধ্যে সব তথ্য পাবেন। আপনার টেবিলে তথ্যের স্তূপ জমবে। আপনি নিশ্চিত থাকুন, এসব আমলারা আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বহির্বিশ্ব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেইমানি করবে না। আপনাকে ভুল তথ্য দেবে না। আপনি চাইলে সরকার সমালোচক ও নিরপেক্ষ পত্রিকাগুলোর কাছেও তথ্য চাইতে পারেন। হয়তো একটু উনিশ-বিশ হবে। কিন্তু প্রচুর খবর পাবেন। কেননা সচিবালয়ে গিয়ে দেখেছি, সেখানকার বাতাসে অনেক খবর ভেসে বেড়ায়। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো তথ্য সব যে সঠিক ও সত্য, তা নয়। কিন্তু ওইসব খবরের মধ্যে অজস্র সত্য লুকিয়ে আছে।