পদ্মা সেতু চাঁদা বিপ্লবের প্রথম শহীদ

আমীন কাদীর
Published : 22 July 2012, 03:06 PM
Updated : 22 July 2012, 03:06 PM

উদ্ভট উত্কট সব কাণ্ড চলছে দেশজুড়ে। মহাজোট সরকারের নৌকা এখন টুটাফাটা ডুবন্ত তরী। আকণ্ঠ দুর্নীতির বেনোজলে এটি পরিত্যক্ত প্রায়। দুর্নীতির সব রকম খোয়াখেয়ি-চাঁদাবাজি শেষে এখন সর্বশেষ—

পবিত্র দেশপ্রেমের নামে লুটপাটের কেয়ামতি আয়োজন চলছে। গুণীজনেরা বলে থাকেন, যখন দেশপ্রেম, বিশ্বাস ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে তখনই দেখা দেয় মহাধ্বংস। হ্যাঁ, এবার দেশপ্রেমের ঢোল বাজিয়ে চলছে দুর্নীতির জয়োল্লাস। জয় দুর্নীতি, জয়। জয় দুর্নীতির জয়। যে কোনো সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতির দুষ্ট ছোবল থাকবেই। কিন্তু এইভাবে দুর্নীতির জয়জয়কার বাংলাদেশের মানুষ আর কখনও দেখেনি। পৃথিবীবাসী কখনও দেখেনি। এর আগে বিদ্যুতের নামে লুটপাট হয়েছে। টেন্ডারবাজি-উন্নয়ন কাজের নামে লুটপাট হয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেমের নাম ভাঙিয়ে সর্বগ্রাসী লুটপাট এই প্রথম।

ধিক্কার জানাই—ঘৃণার স্তম্ভে লাল অক্ষরে এই কথাটি লিখে রাখতে চাই—মহান মুক্তিযুদ্ধকে পর্যন্ত এই দুর্নীতির জোট সরকার তাদের লুটের হাতিয়ার বানাতে চাইছে। কী দর্পিত স্পর্ধায় তারা বলছে, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, এখন একটা সেতু বানাতে পারব না, সে কী কথা!

পদ্মা সেতু নামক মুলো ঝুলিয়ে দুর্নীতির উত্সব করতে এরা মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়, লাখো প্রাণের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছে না। সরকারের কত বড় অধঃপতন হলে এরকম মতলববাজি, ধান্দাবাজি সম্ভব—সেটাই এখন দেখছেন দেশবাসী।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ধুয়া তুলে দেশজুড়ে ভয়ংকর এক চাঁদাবাজির সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছে শেখ হাসিনার সরকার—তার প্রমাণ এরই মধ্যে ঢের মিলছে।

এই অপকর্মের পরিণাম কী, সেটির প্রমাণও পাচ্ছি। পদ্মা সেতুর নামে এরই মধ্যে চাঁদাবাজির অদম্য লড়াইয়ে নেমেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। প্রধানমন্ত্রী মহা ঘটা করে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু তৈরির ডামাডোল তুলতেই রাজশাহীর তরুণতুর্কি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা রাবি ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় শুরু করে মহা সমারোহে। কিন্তু চাঁদাবাজির অনিবার্য অনুষঙ্গ হলো এর ভাগাভাগি নিয়ে দলাদলি-কোন্দল। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপই নেমে পড়ে তাদের প্রিয় নেত্রীর পবিত্র ব্রত সাধনে। সাংগঠনিক নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তারা অমান্য করে কেমনে!

রাজশাহী শহরের কাছে একটি মৃতপ্রায় পদ্মা থাকলেও প্রস্তাবিত আসল পদ্মা সেতু সেখান থেকে কয়েকশ' কিলোমিটার দূরে। তাতে কি! পদ্মা সেতুর বেদিতে প্রথম বীর-শহীদানের ঘটনা ঘটল সেখানেই। প্রধানমন্ত্রী যে নয়া যুদ্ধ ও নয়া বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন, তাতে প্রথম রক্ত দিয়ে শামিল হলো রাবির এক ক্যাডার। জানা যায়, ব্যাপক আড়ম্বরপূর্ণ চাঁদাবাজির হরিলুট শুরু হলেও তথাকথিত 'জয় পদ্মা সেতু' ফান্ডে জমা পড়ছিল অতি সামান্য। বাকিটা নেতা-ক্যাডারদের পকেটে যাচ্ছিল। এ নিয়ে মাদার বকশ হলে দু'গ্রুপ চাঁদা সন্ত্রাসীর মধ্যে সংঘাতের শুরু। একটি গ্রুপ কোনো চান্দা-বাক্স ছাড়াই ১২০০ টাকা তুলে ৩০০ টাকা জমা দেয়। আর যায় কোথায়! প্রথমে কথা কাটাকাটি, গালাগাল। তারপর একে অপরের আবাসিক কক্ষে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংঘর্ষের হিংস্রতা ও বন্যতার নানা দৃষ্টান্ত সবারই জানা; থেঁতলে কুপিয়ে মারা, রগ কাটা, চাঁদাবাজির এই মহতী উত্সবে সেই চিরাচরিত অভ্যাস বাদ যাবে কেন! এবারও চাঁদা সন্ত্রাসীদের খোয়াখেয়িতে হাসুয়া, হকিস্টিক, রামদা, পিস্তল—সবকিছুই ব্যবহার করা হয়েছে। গুলি, ককটেল বাদ যায়নি। আর এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের অনিবার্য পরিণামে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেল এক তাজা তরুণ। দরিদ্র পরিবারের বড় সন্তান সোহেল রানা নামের ছেলেটি নষ্ট ছাত্র রাজনীতির নীল বিষে দংশিত হয়ে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে ছাত্রলীগেরই কর্মী।

নিজস্ব অর্থায়নে যদি পদ্মা সেতু করা যায়, অবশ্যই তা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এই জিগির তুলে চাঁদাবাজি-হত্যাবাজি কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। এখন এই লাশের দায় কে নেবে? এবারও কি মহাজোট নেত্রী তার দুর্বার কণ্ঠে এই খুনের দায় বিশ্বব্যাংকের কাঁধে চাপিয়ে দেবেন? তিনি নিজেই বা কীভাবে এই চাঁদাবাজির রক্তপাতের দায়দায়িত্ব এড়াবেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এই আপন রক্ত পানের দৃষ্টান্তটি লক্ষ্য করুন। প্রধানমন্ত্রী তার পদ্মা তহবিল সংগ্রহে বিপ্লবের ঘোষণা দিলেন মাত্র। এরই মধ্যে সারাদেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চাঁদাবাজির জোয়ার জেগেছে। কী কঠিন অবস্থা! জুলাইয়ের মাঝামাঝি মন্ত্রীরা সদলবলে ঘোষণা দিলেন, পদ্মা চাঁদা তহবিলে এক মাসের বেতন দেবেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এ কে আজাদ চৌধুরী এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বজনপ্রীতি অনিয়মের বরপুত্র ভিসি প্রমুখও ঘোষণা দিলেন, তারাও লাখ লাখ টাকা চাঁদা দেবেন। ভিসিরা কোথায় পাবেন এই লাখ লাখ টাকা। তারাও দেখা যাচ্ছে নেমে পড়েছেন চাঁদাবাজির মচ্ছবে।

স্বেচ্ছায় দেয়া তথাকথিত চাঁদা সংগ্রহে দুটি ব্যাংক হিসাব খোলা হবে বলে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রাক্কালেই এই রক্তপাত। এই খুনোখুনি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ ভঙ্গিতে জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুটি অ্যাকাউন্টের একটি দেশীয় মুদ্রা ও অন্যটি বৈদেশিক মুদ্রার জন্য খোলা হচ্ছে। ধারণা করতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মার্কা সর্বাত্মক চাঁদাবাজি শুধু দেশেই নয়, বিদেশে প্রবাসীদের মাঝেও শুরু হয়েছে।

এই স্বেচ্ছায় দেয়া চাঁদার হিসাব দুটিতে কেমন অর্থ জমা পড়বে? রাজশাহীর বিপ্লবীদের মাইলস্টোন দৃষ্টান্ত বলছে, প্রতি ১২০০ টাকার চাঁদায় বড় জোর ৩০০ টাকা। অর্থাত্ ২৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশই আদায়কারীদের পকেটে।

ওহে গোপালগঞ্জের কিশোরী স্কুল ছাত্রী—তোমার উদ্দেশে এবার লিখছি। হ্যালো, তুমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পদ্মা সেতু বানাতে চেয়েছ। প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলে তুমি। সাধু-উদ্দেশ্য। অজস্র ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার মতো যদি সারাদেশের কোটি ছাত্রছাত্রী টিফিনের টাকা দিতে চায়, তাহলে ভালো একটা অ্যামাউন্ট হবে। কিন্তু তুমি কত টাকা দিতে পারবে। তোমার আব্বা তোমাকে কয় টাকা টিফিন খরচ দেয়। ১০ টাকা না ১২ টাকা? আচ্ছা ১০ টাকাই ধরি। তোমাকে জানিয়ে রাখা ভালো, তুমি ১০ টাকা দিলে আমরা কিন্তু পাব আড়াই টাকা। বাকি সাড়ে ৭ টাকাই খেয়ে নেবে চাঁদাবাজদের সিস্টেম। তোমার কাছে এরই মধ্যে ইনশাল্লাহ ছাত্রলীগের চাঁদার বাক্স পৌঁছে যাবে। তুমি পারলে ১০-১২ বছরের টিফিনের টাকা একসঙ্গে দিও। তাহলে মোটামুটি উপকার হবে আমাদের। নইলে মাত্র ২ টাকা ৫০ পয়সায় পদ্মা সেতু চাঁদাবাজির একটা লিফলেট ছাপানোর খরচও উঠবে না।

মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনি কী বলছেন! আপনি কি পারবেন এ রকম আড়াই টাকা সঞ্চয় করে করে পদ্মা ব্রিজ খাড়া করতে! অবশ্য আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলাই বেকার কি বাত? পুরো মহাজোট মন্ত্রিসভা যাচ্ছে একদিকে, আপনি একা আরেক দিকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যা বলে সারা বাংলাদেশ মাথায় করে তুলেছেন, আপনি ঠিক তার উল্টোটি বলছেন।

প্রধানমন্ত্রী খেদিয়ে-ঝেটিয়ে দিলেন যে বিশ্বব্যাংককে, আর আপনি বলছেন, সেই বিশ্বব্যাংককে খারাপ কিছু বলা যাবে না। ওদের বৈরী করা যাবে না। আপনার কিসের এত বিশ্বব্যাংক-প্রেম! সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, বিরোধী দল বিশ্বব্যাংকের দালাল। আপনি তো দেখছি উপর্যুপরি দালাল। প্রধানমন্ত্রী পরিবার ও সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে যারা দুর্নীতির আঙুল তুলেছে, সেই মহাজোট শত্রুদের আপনি মিত্র। যে ব্যাংকটির দুঃখজনক বেইমানিতে আস্ত একটা দল ও সরকার ভিক্ষার ঝুলি হাতে সারাদেশে নেমে পড়েছে—উপুড় করে দে মা, লুটেপুটে খাই; গান গাইতে গাইতে। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা এক টকশোতে পরিষ্কার আশঙ্কার কথা জানালেন—পথে পথে গাড়ি আটকে, লোকজনকে আটকে পদ্মা সেতু টোলবাজি শুরু হয় কিনা। রাস্তায়-রাস্তায় মোড়ে-মোড়ে আসন্ন নির্বাচনের নামে গঠন হতে চলেছে পদ্মা সেতু চাঁদালীগের কমিটি। আসছে ঈদের চাঁদ কী ভাগ্য নিয়ে আসছে কে জানে!

চাঁদালীগ হিসেবে আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ৬২ বছর পুরনো। রাজনীতি করে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে সংসার চালানো যে সম্ভব, সেটি দলটির মহান নেতারা এমনভাবে সুপ্রমাণ করেছেন—চাঁদা এখন দলটির ঐতিহ্যের স্মারক ও অধিকারে পরিণত হয়েছে। একসময় পাকিস্তানি কুখ্যাত ২২ পরিবারের অন্যতম হারুন পরিবারের চাঁদায় চলেছে দলটির শীর্ষস্থানীয় সংসার—সে ইতিহাস ভুলে যাননি অনেকেই।

এই ভয়ংকর চাঁদাবাজি এতদিন অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলছিল। চাঁদা ও কমিশনের টাকায় শীর্ষ পরিবারগুলো বিদেশে বাড়ি, গাড়ি, প্রাসাদ, শপিং মল ব্যবসার মালিক হলেও চাঁদাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। এবার লাজশরমের বালাই নেই। চাঁদাবাজিকে নেকাব পরাতে আর রাজি নয় দলটি। এবার খুল্লাম খুল্লা খেমটা নাচ।

আওয়ামী লীগের গলাবাজির আরেক ব্রান্ডেড ভয়েস—প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বেশ আদর-সোহাগ করে সম্প্রতি বলেছেন, 'তোমরা কিছুটা আহাম্মক আছ। ধান্ধাবাজি কর। দুই টাকা পাইলেই টেন্ডারবাজি কর। ধান্দাবাজি ছাইড়া দাও। সামান্য প্রলোভনে পা দিও না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে শেখ হাসিনার রাজনীতি করো।'
উপদেষ্টা মহোদয় সব সময় সরকারের সুরেলা পল্লীগীতিই গেয়ে থাকেন। তার কথায় মেসেজ পরিষ্কার। এখন দুই টাকার টেন্ডারবাজির দিন শেষ। এই সামান্য প্রলোভনে পড়ে থাকা নিতান্তই আহাম্মুুকি। নিজস্ব চাঁদাবাজিতে পদ্মা সেতু গড়ার নতুন রাজনীতির ডাক দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। দুই টাকা, পাঁচ টাকা নয়, ২৪ হাজার কোটি থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল কর্মকাণ্ড এখন আওয়ামী লীগের একক উদ্যোগেই হবে। এখন এই খাতে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি করে টাকা বানানোর দিন। মরা পদ্মার তীরে রাজশাহীতে উদ্বোধন হয়েছে সেই বিপ্লবের। এই চাঁদা বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সবাইকে। পদ্মা সেতুর নামে আখের গুছিয়ে নাও। নির্বাচনী খরচপাতি ওঠাও। দেশীয় অর্থায়নেই আগামী নির্বাচনের খাই-খরচা তুলতে হবে। যে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, সেই টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে ভোটের ভেল্কিবাজিতে বিনিয়োগ করা হবে—ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের কোনো আহাম্মক যেন এমন মূর্খ ধারণা না করে।