চটকানা মন্ত্রীর চড় এবং দুর্নীতির পাঁচ গভর্নর

আমীন কাদীর
Published : 7 Sept 2012, 02:24 PM
Updated : 7 Sept 2012, 02:24 PM

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েক বছর ওবায়দুল কাদেরের কথার কথক নৃত্য আমরা দেখেছি; এবার শুরু হয়েছে তার দুর্নীতিবিরোধী চটকানা-চড়-থাপড়ের ভাঁড়ামি। তিনি দারুণ মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছেন। গটগট করে রেলস্টেশনে হাঁটছেন। ছুটছেন। রেলের কালো বেড়ালের পেছনে কোমরে বেল্ট বেঁধে দৌড়ে চলেছেন। মনের সুখে তিনি সবাইকে কথার চাবুক দিয়ে চাবকাচ্ছেন। তার এই দুর্নীতিবিরোধী জেহাদের দৌড় বুঝতে অবশ্য কারও বাকি নেই। এরই মধ্যে তিনি চটকানা মন্ত্রী হিসেবে দুর্দান্ত খ্যাতি জুটিয়ে নিয়েছেন। পত্রপত্রিকায় দেখেছি তার নাম শুনলেই রেলওয়ের সুইপার, টিকিট চেকার, স্টেশন মাস্টারসহ ছোট-বড় নানা কিসিমের কর্তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন — কখন আবার মন্ত্রীর চড়-চটকানা খেতে হয়। এক চটকানা দিয়েই ওবায়দুল কাদের সুপার হিট। পয়লা সেপ্টেম্বরের কাণ্ড। ঈশ্বরদী জংশনে টর্নেডো সফরে গিয়েছিলেন। কালো বেড়াল না হোক, একটা কালো মুরগি তিনি দৌড়ে-ছুটে ধরবেনই। পেয়েও গেলেন নন্দ ঘোষ বলরাম দাসকে। ব্যাটা বলরাম ভীষণ নচ্ছার। রেলওয়ে দুর্নীতির গডফাদার। এই ব্যাটার জন্যই মহাজোটের দুর্নীতিবিরোধী মহাযুদ্ধ মাঠে মারা যেতে চলেছে। দুর্নীতির এই বরপুত্রকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে পারেন না ওবায়দুল। হাতে নাতেই তাকে ধরলেন। টপ অব টপ দুর্নীতিবাজ বলরাম তখন কী করছিল! বেচারা দাস। রেলওয়ের দাসানুদাস। তার কত্ত বড় সাহস! খোদ জেহাদি মন্ত্রী যেখানে প্লাটফর্মে চড়-থাপ্পড় নিয়ে দুর্নীতির রাঘব বোয়াল ধরতে ছুটে এসেছেন, ঠিক তখনই কিনা সে টিকিট না কাটা যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা-৩০ টাকা আদায় করে বাংলাদেশের ইমেজ সারা দুনিয়ার কাছে কলঙ্কিত করে চলছিল। একজন ধুরন্ধর মন্ত্রী এমন ক্রিমিনালকে কেমন করে ছেড়ে দেন। ততক্ষণে তার মাথায় রক্ত ওঠার জোগাড়। তিনি স্পটেই দ্রুত বিচার সেরে ফেললেন। কষে চটকানা দিলেন বলরামকে। হারামজাদা, আর কখনও ২০-৩০ টাকা ঘুষ খাবি! মাত্র ২০-৩০ টাকা ঘুষ খাওয়া খুবই বেইজ্জতি কারবার। এটা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। এই ডিজিটাল দুর্নীতির মহাজমানায় ৩০ টাকা উেকাচ খুবই অন্যায়। খুবই অশোভন। একটা চটকানা কেন, ওকে ১০টা থাপ্পড় দেয়া দরকার। যে জমানায় কালো বেড়াল রেলমন্ত্রীর এপিএস ৭০ লাখ টাকা ব্যাগে ভরে ঘুরে বেড়ায়, সেই সোনালি যুগে ব্যাটা বলরাম ঘুষের নামে একরকম ভিক্ষা করে ফিরছিল। ওকে চটকানা দিয়ে ওবায়দুল ঠিক কাজটাই করেছেন।

ওই পয়লা সেপ্টেম্বরেই ওবায়দুল কাছের সিরাজগঞ্জ স্টেশনেও গিয়েছিলেন। ঈশ্বরদীতে তিনি হাতে মেরেছেন; সিরাজগঞ্জে গিয়ে মুখখানা খুলে বাণী মোবারক জাতির সামনে হাজির করলেন। বললেন, সোনালী ব্যাংক বা হলমার্ক দুর্নীতি নিয়ে দেশের মানুষ এখন মাথা ঘামায় না। মানুষ এখন খোঁজে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে আছে কিনা। উজির বাহাদুরের কথা শুনে হাসব না কাঁদব—বুঝতে পারছি না। এটা তালবেতাল না টালমাটাল বাতচিত্! হলমার্কের দুর্নীতি কোনো ব্যাপারই নয়? ব্যাপার হলো গিয়ে দুর্নীতির দাসানুদাস বলরাম দাসের ২০-৩০ টাকার হাতটান? এজন্যই তো বলছিলাম, এই ব্যাটা বলরামই হচ্ছে বাংলাদেশের গডফাদার অব করাপশন। বদমাশটা তৃণমূলে ২০-৩০ টাকা খায় বলেই তানভীর- মোদাচ্ছের-সুভাষণ গং এই গরিব রাষ্ট্রটাকে চটকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। টাইট দিতে হবে তাই বলরামদের। দেশের মানুষ খালি তাদের দুর্নীতি নিয়েই ভাবছে। আর তাই ওবায়দুলের চটকানা কাণ্ডের পর সারাদেশে তোলপাড়। কবিরা লিখে চলেছেন কবিতা। ব্লগাররা লিখছেন ব্লগ। ফেসবুকাররা দিচ্ছেন স্ট্যাটাস। দেশের এক খ্যতিমান কবির অন্যরকম কবিতা এখানে না বললেই নয়। ৩০ হাজার কোটি টাকা মেরে খেলে মহান দেশপ্রেমিক / ৩ হাজার কোটি মারলে মহান ব্যবসায়ী / ৩০০ কোটি টাকা মারলে উজিরে আলার উপদেষ্টা / ৩০ কোটি টাকা মেরে খেয়ে উজিরে খামোকা / ৩ কোটি টাকা মারলে এপিএস / আর ৩০ টাকা খেলে মিনিস্টারের থাপ্পড়।

কবিতাটা ভালো করে পড়ুন। মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করুন। ৩০ কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি—সবই মহানদের কায়কারবার। এগুলোকে দুর্নীতি বলা ঠিক নয়। এগুলো নিয়ে দেশের মানুষ নাকি কোনো কিছুই ভাবছে না। তারা কেবল ভাবছে বলরামের ৩০ টাকার দুর্নীতি নিয়ে। মন্ত্রী ওবায়দুল সেটা জানেন বলে তিনি ঠিকই বলবাবুকে স্পট-পানিশমেন্ট দিয়ে দেশ, জাতি ও মহাজোট সরকারকে মহা কলঙ্কের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। পরদিন ২ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল তার চটকানা-রঙ্গের কোমল ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার আপন ভাইও যদি বলরামের মতো ঘুষ খেত, তিনি তাকেও চড়-থাপ্পড় দিতেন। মন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি তৃণমূল দুর্নীতির ব্র্যান্ড আইটেম বলরামকে আপন করে নিয়েছেন। ভাইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। এইসব বেইজ্জতি কাণ্ডকারখানার জন্য ছোট ভাইকে কীভাবে শাসন করতে হয়, তার নজির তিনি রেখেছেন। আর চড়- থাপ্পড় দিতে হলে ওই ৩০ টাকার বলরামদের দিয়েই জনগণের সামনে হিরো সাজতে হয়। কেননা তাদের চটকানার দৌড় ওই ২০-৩০ টাকা পর্যন্তই। তার ওপরের সবাই তো মহান দেশপ্রেমিক। ৩০ হাজার কোটি টাকা মেরেছেন মহাজোট সরকার ও শেখ পরিবারের কুটুম্ব-উজির; স্বয়ং উজিরে আলা দেশ-বিদেশে ছুটে বেড়িয়ে তাকে মহান দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়ে চলেছেন। কে জানে কবে দেখা যাবে—কোনো জরিপ সংস্থা এপার বাংলা ওপার বাংলা ব্যাপক জরিপ চালিয়ে এই ৩০ হাজার কোটি টাকা মারনেঅলাকে হাজার বছরের সেরা বাঙালি বা হাজার বছরের সেরা দেশপ্রেমিক বলে আখ্যা দিয়ে বসবে। আর আমরা মিডিয়াঅলারা সেটা নিয়ে আনন্দময় হৈচৈ জুড়ে দেব।

মহাজোট সরকারের দুর্নীতির পাঁচ পাণ্ডব এখন দেশে-বিদেশে তাদের দেশপ্রেমমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য হিরোর মর্যাদা পাচ্ছেন। হিরো না বলে উপায় কী! স্বয়ং উজিরে আজমই যে তাদের দেশপ্রেমিক বলে মুখে তুবড়ি ছোটাচ্ছেন।

তাদের দেশপ্রেমের কী অসাধারণ সব নমুনা! একজন দেশপ্রেমিক মন্ত্রী লন্ডন-আমেরিকার চাঁদার বাক্সে হাজার হাজার কোটি টাকা মজুত করতে গিয়ে আস্ত একটা পদ্মা সেতুর সম্ভাবনার কবর দিয়ে ছাড়লেন। দেশপ্রেমিক তিন মন্ত্রী-উপদেষ্টা রেন্টাল বিদ্যুতের ভাঁওতাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। অর্থনীতি এখন লণ্ডভণ্ড। কালোবেড়াল দেশপ্রেমিক রেলওয়েকে ঢেলে সাজাবার ভান-ভণ্ডামি করে বস্তা বস্তা টাকা কামাতে গিয়ে বমাল ধরা খেয়ে উজিরে খামোকা। তার ওজারতির মেয়াদের শেষ নেই। দেশখেকো এমন মহান দেশপ্রেমিকদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

দেশের সর্ববৃহত্ ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে তানভীর নামের এক রাহু একাই গিলে ফেলেছিল। তার সঙ্গেও ছিল প্রধানমন্ত্রী কথিত দেশপ্রেমিক গং। তারই এক অতি গুণধর উপদেষ্টা। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের ছাত্রলীগার পরিচালকবৃন্দ। হায়েনার মতো সোনালী ব্যাংক ভোজ-উত্সবের এরা টাকাখেকো। হলমার্ক নামে এক প্যান্ডোরা-ব্র্যান্ডের নামে এরা আস্ত একটি ব্যাংককে চুষে আমের আঁটি বানিয়ে ফেলেছিল। তারপরও তারা ধোয়া তুলসী পাতা। তাদের কোনো দোষ নেই। তাদের নিয়ে টুঁ শব্দটিও বলা যাবে না।

হলমার্ক ২০-৩০ টাকা মারেনি। কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকা মেরেছে এই উপদেষ্টা-লুটেরা চক্র।

অথচ সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক মহা কেলেঙ্কারিকে খুব বড় দুর্নীতি বলতে নারাজ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, সরকার প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। এটা বড় ধরনের কোনো সঙ্কট নয়। সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে বেশি প্রচারণা চালিয়ে দেশের ক্ষতি করছে। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অর্থমন্ত্রী হলমার্ক ও সোনালী ব্যাংকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছেন, এটা এখন পরিষ্কার। তিনি ইংরাজি- বাংলা মিশিয়ে লম্বা-চওড়া কথা বলতে বড় ভালোবাসেন। এবার তিনি বড় দুর্নীতি-ছোট দুর্নীতির সংজ্ঞা নিয়ে লাইফ ডিকশনারি খুলে বসেছেন। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিও খোদ অর্থমন্ত্রীর কাছে দুর্নীতি বলে মনে হচ্ছে না। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়ে সোনালি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কত বড় সাহস বিবিঅলাদের। অর্থমন্ত্রী সাফ রায় দিয়েছেন—হলমার্ক নিয়ে কথা বলা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ নয়। এ বিষয়ে কথা যত কম হবে ততই মঙ্গল।

এভাবেই দেশখানা এখন চলছে। মাজাভাঙা সোনার বাংলাদেশ! এখানে এখন আর চোরকে চোর বলা যাবে না। বলতে হবে দেশপ্রেমিক। ডাকাতকে ডাকাত বলা যাবে না। বলতে হবে মহান দেশপ্রেমিক। লুটেরাদের আর লুটেরা বলা যাবে না। বলতে হবে হাজার বছরের সেরা দেশপ্রেমিক। দেশে এখন বলরামদের ৩০ টাকার দুর্নীতি স্পট শাস্তিযোগ্য মহা অপরাধ হলেও চার হাজার কোটির লুটপাট কোনো ব্যাপারই নয়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এই সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। দেশপ্রেমের এখন সংজ্ঞাই হচ্ছে লুটেপুটে টাকা বানাও। পিস্তলবাজি করে ব্যাংক লুট করতে যেয়ো না। ছলে-বলে-কৌশলে লুট করো। ব্যাংকের ভল্ট ভাঙো। হলমার্ক, রেন্টাল, শেয়ারবাজারের নামে দেশটাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানাও। লুটপাট এখন দেশপ্রেমেরই অঙ্গ। লুটপাটের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে একেকজন গভর্নরও নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে রেন্টাল বিদ্যুত্, স্টেট-ব্যাংকিং, শেয়ারবাজার, পদ্মাসেতু, রেলওয়ে, সড়ক যোগাযোগ ইত্যাদি প্রদেশ-পরগনার গভর্নররা নিজ গুণে আপন কর্মনৈপুণ্যে মিডিয়ায় দারুণ আলোচিত। সবাই তাদের চেনে। সবাই এখন হিরো। এদের নেপথ্যে আরও তিন-চারজন মেগা-গভর্নর রয়েছেন। দেশবাসী অচিরেই তাদের সম্যক চিনে নেবেন, সেটা হলফ করেই বলা যায়।