মার শালারে… ধর শালারে…

আমীন কাদীর
Published : 15 Nov 2012, 07:54 PM
Updated : 15 Nov 2012, 07:54 PM

কলাম লেখার ভাষা পাল্টে ফেলতে হবে দেখছি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! ক্ষমা চেয়েই বলছি—আগের সেই উতুপুতু রাবীন্দ্রিক ভাষায় আর কলাম লিখলে চলবে না। প্রমিত ভাষা বাদ। ভদ্র ভাষা বাদ। এখন জোরালো মাস্তানি ভাষার দরকার। লেখার ভাষায় মাস্তানি দম থাকা দরকার। গালি দিতে হবে কলামে। হারামজাদা-টারামজাদা মার্কা ভাষার প্রয়োগ করতেই হবে। কবি রফিক আজাদ পথ দেখিয়ে গেছেন সেই কবে। বলেছিলেন—ভাত দে হারামজাদা! নইলে মানচিত্র খাব। এখন আর কবিদের যুগ নয়। এখন মারদাঙ্গা মারকুটে মারঙ্গম শাজাহান খান সাহেবের কাছে নতুন ভাষার পাঠ শেখার পালা।

প্রিয় গোলাম মাওলা রনি এরই মধ্যে মারমার কাটকাট কলাম লিখে চারদিকে হই-হট্টগোল ফেলে দিয়েছেন। তার লেখা হিট। ভাবছি শাজাহান খান সাহেবকে দিয়ে সম্পাদক সাহেবরা কলাম লেখাচ্ছেন না কেন! ভাবুন একবার! কী এক খান বোমব্লাস্টিং লেখা তার মুখ দিয়ে বেরুবে। তাকে কলম দিয়ে লিখতে বললে কিন্তু চলবে না। তাকে বলতে হবে—স্যার আপনি মুখে বলুন। আমরাই লিখে নিচ্ছি। দেখা যাবে চলতি কলাম লেখক সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা আর কিছু লিখতে সাহস পাচ্ছেন না। টকশোতে শাজাহানের কী দমদার ভাষা! হারামজাদা তোর চোখ তুলে নেব। এমন বিপ্লবী বজ্রকণ্ঠী ভাষা প্রয়োগ করতে বুকের পাটা লাগে। শাজাহান খানের একাধিক একান্ত ভক্ত আমাকে বেশ হুকুমের সুরেই বলছেন, কী সব আগডুম-বাগডুম লিখেন। ওইসব কেউ পড়ে নাকি! আলতু-ফালতু লেখা। আপনাদের লেখা এখন কেউ বাথরুমেও ফ্লাশ করে না। পারলে খান সাহেবের মতো সাহসী কথা লিখবেন। যাকে হারামজাদা বলার তাকে হারামজাদা বলবেন। যার চোখ তুলে নেয়ার ইচ্ছা হবে, তাকে চোখ তোলার হুমকি দেবেন। দেখবেন আপনার কলাম কী গতিশীল হয়। লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। পারলে লিখেন। নইলে লেখা ছেড়ে দিন।

খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছি এই কথাবার্তা শুনে। বুঝতে পারছি, ভাষা পাল্টাতে না পারলে আর লিখে ভাত নেই। এমনিতেই আমরা লেখক-সাংবাদিকরা আক্ষরিক অর্থেই পেটে পাথর বেঁধে চলি। সংসার চলে না… চলে না… সংসার চলে না। তারপর এই নয়া চ্যালেঞ্জ। আমরা এবার যাই কোথায়? অনেক ভাবলাম। চিন্তা করলাম লেখা থামিয়ে দিই। আগডুম-বাগডুম ঘোড়ার ডিম আর লিখব না। কিন্তু সমস্যা হলো টুকটাক লেখা লেখি ছাড়া আর যে কোনো কাজ জানিই না। গুণ্ডামি জানি না। পাণ্ডামি জানি না। কাউকে চোখ তোলার হুমকি দিতে জানি না। কাউকে হারামজাদা শুয়ারের বাচ্চা বলতে জানি না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পারিবারিক সাইনবোর্ড নেই। সে অর্থে যোগ্যতা নেই। চাঁদাবাজি জানি না। তোলাবাজি জানি না। কমিশন খেতে জানি না। মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাও নেই। লাঠিবাজি জানি না। ঠিকাদারি জানি না। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে জানি না। রাস্তা-ঘাটে ছিনতাই করতে জানি না। ব্যাংকের টাকা লুট করতে জানি না। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ খুন করতে জানি না। তাহলে তো আমার জন্য বিকল্প কোনো ক্যারিয়ারের সুযোগই নেই। মন্ত্রী, নেতা, পাতিনেতা হয়ে যে একটু করে খাব, তারও উপায় নেই।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ আশার আলো দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, মন্ত্রী হওয়া বেশ সহজ। একটু জবরদস্ত তেলবাজি করতে পারলেই হলো। কিন্তু পরে দেখলাম অত সহজ নয়। শুধু তেলবাজিতে হবে না। গুণ্ডামি-পাণ্ডামিতে দম থাকতে হবে। সোনালী ব্যাংক লুট করতে জানতে হবে। টকশোতে গিয়ে অন্য বক্তার চোখ তোলার জন্য আঙুলকে ছুরি বানিয়ে এগিয়ে যেতে জানতে হবে। কিন্তু হায় হায়! এসব তো আমি কিছুই জানি না! আখেরে আমার হবে কী! যা একটু লিখে খেতে জানতাম তাও পড়েছে হুমকির মুখে। আমার বাম রাজনীতিবিদ বন্ধু থিওরি সাজিয়েই বললেন—ভাষা না পাল্টালে উপায় নেই। কেউ তোমার লেখা আর পড়বে না। টিভি টকশো এসে প্রিন্ট মিডিয়ার বারোটা বাজাচ্ছে। টিভিতে সবকিছু লাইভ যেমন দেখা যায়, গালিগালাজ শোনা যায়—প্রিন্ট মিডিয়ায় তার ছিটেফোঁটা স্বাদও পাওয়া যায় না। তোমরা এভাবে বোরকা পরে থাকলে চলবে না। ঘোমটা খোল। মন্ত্রী, নেতা-পাতি নেতা, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় কলাম লিখ। নইলে ভবিষ্যত্ অন্ধকার। চারদিকে মার শালারে… ধর শালারে… আওয়াজ-কুচকাওয়াজ বাড়ছে।

শেখ হাসিনার কথার ঝড়ঝাঁপটায় আওয়ামী লীগ থেকে খসে পড়তে চলেছেন কিংবা এরই মধ্যে খসে গেছেন, তারা বলতে ছাড়ছেন না—শেখ পরিবারের এখন উচিত নতুন ধারার একটা দৈনিক বের করা। যেখানে কাউকে কিছু লিখতে হবে না। শুধু আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-পাতি মন্ত্রী আর হানিফ-কামরুল প্রতিদিন যা বলছেন তার রেকর্ড ভাষ্য লিখে শুধু ছাপাবে। তাতেই মারমার-কাটকাট হবে। ওই কাগজ না পড়ে পাবলিকের পেটের ভাতই হজম হবে না। বিরোধী দলকে নতুন করে কিছু বলে ভয় দেখাতে হবে না। ওই কাগজের প্রিন্ট এডিশন দেখালেই তারা পালিয়ে বাঁচার পথ পাবে না। আর আওয়ামী লীগের যারা প্রবীণ বুড়ো হাবড়া নেতা, তারা তো গর্তে গিয়ে লুকাবেন। আর ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি পড়বেন। গর্ত থেকে তারা জানতে চাইবেন গোপন মোবাইলে—তাদেরকে হানিফ মোহাম্মদ নতুন কোনো ব্যাট পেটাই করেছে কি-না।

নিজে না লিখতে পারি আমি অন্তত কল্পনা করে দিব্য চোখে দেখতে পারি, সেই কাগজে গালিগালাজ চোখ তোলা মন্ত্রীর কলামে কী লেখা হয়েছে। তার কলামের শিরোনাম হবে—চোখ গালাইয়া দিমু; এসিড ঢাইলা দিমু।

হালার পুত টকশোতে কীভাবে কথা বলতে হয় জানস না। তোর আমি চোখ তুইলা নিমু। তোর চোখে এসিড ঢাইলা দিমু। তাতেও যদি ভয় না পাস; তারপরও যদি আবার আওয়াজ করস—তোর কইলজা খুইলা কচকচাইয়া খামু। তুই আমারে চিনস্ না। আমারে এলাকায় চোখতোলা মাড়কশা বলে জানে। কতজনের জান কবচ করছি জানস না। মন্ত্রী হইছি বইলা ট্রেনিং জমা দেই নাই। পাবলিকরে কেমনে টাইট দিতে হয় সেইটা আমার জানা আছে। কিছু হালার পুত সম্বাদিক আমার ভাষা লইয়া খুব লাফালাফি করতে আছে। শালাগো পাখা গজাইছে। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। ওগো জয়নাল হাজারীর মতো ড্রিল মেশিন দিয়া শাস্তি দিমু। যে হাত দিয়া লেখালেখি করে সেই হাত ফুটা কইরা দিমু। তারপর কোন হাত দিয়া লেখে দেখুম। যে হালার পুত সম্বাদিকরা মধ্যরাতে সরকারের ঘরে সিঁদ কাটে, তাগো মুখে সেলাই কইরা দিমু। হালাগো ফটফটানি কমবে। আরেকবার ক্ষমতায় যাইয়া লই। তারপর দেখামু চোখ গালান কারে কয়। যেমন কুকুর তেমন মুগুর দরকার রনি মিয়া। এই বাঙালি হালাগো যত ভয় দেখাবা তত টাইট থাকবে। কিসের কী বীরের জাত! এগো যত মারবা তত তোমারে সালাম দেবে। কিছু হালার পুত সম্বাদিক আমার শ্রমিক ভাইগো লইয়া খালি উল্টাপাল্টা লেখে। এইগুলারে বাসের চাকার নিচে চাপা দিয়া মারমু। ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু। তারপরও যদি সামলানো না যায়, গুম কইরা দিমু। রাস্তায় মানুষ মরবেই। ওরা রাস্তায় বাইর হয় কেন! বাস চাপা পড়ে মৃত্যু কোনো মৃত্যু না। এটা হলো সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। ঘরে ঘরে রাত্তিরবেলা ঢুইকা জন্মদান ঠেকানো যাবে না। তাই এই বিকল্প পদ্ধতিকে সরকারের উচিত বিশেষ কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা দেয়া। জনসংখ্যা কমানোর কাজে বাস চালকদের কাজে লাগানো উচিত।

চোখ তোলা মন্ত্রীর হয়ে আর লিখতে পারছি না। বেচারার চিন্তা-চেতনার গতি-প্রকৃতি সারাক্ষণ রক্তারক্তিকেন্দ্রিক থাকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এবার দেখি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কলামে কী লিখবেন। তার ভাষা হবে প্রমিত। কিন্তু তার হুমকি-ধমকি হবে শাণিত; ক্ষুরধার ছুরিকার মতো। ধারণা করতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়, তার লেখার শিরোনাম হবে—পুলিশ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ এক মায়ের পেটের ভাই।

বলার অপেক্ষাই রাখে না, এখন আর মান্ধাতা আমলের আইন-শৃঙ্খলা থিওরি দিয়ে চলবে না। এখন শুধু পুলিশ দিয়ে হবে না। যুবলীগ-আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সংগ্রামী ত্যাগী অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের পুলিশের মর্যাদা দেয়ার সময় এসেছে। এখন ক্যাডার মানেই পুলিশ। এখন যুবলীগ-ছাত্রলীগকে প্যারা পুলিশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্যারা মিলিটারি যদি হতে পারে, প্যারা মিলিশিয়া যদি হতে পারে—তবে অবশ্যই প্যারা পুলিশ গঠন করা যেতে পারে। এটা সময়ের অনিবার্য দাবি। ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গবন্ধু আমলে ছাত্রলীগ-যুবলীগ পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল, আমাদের বীর কামাল, একাই ঢাকা শহরের দেখভাল করেছে। ঢাকা ভার্সিটির দেখভাল করেছে। ব্যাংকের ভল্টের প্রতিরক্ষা দেখেছে। সেই উত্তরাধিকার আমরা কি রক্ষা করতে পারছি? আমরা কি ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে যাইনি! যদি শেখ কামালের শিক্ষা সত্য হয়, তবে অবশ্যই ছাত্রলীগ-পুলিশ হাতে হাত বেঁধে কাজ করতে হবে। এখন থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মী মাত্রকেই পুলিশের সমান মর্যাদার বলে ধরে নিতে হবে। পুলিশের যেমন কয়েকটি অর্গান রয়েছে। ডিবি-ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ, এসবি-স্পেশাল ব্রাঞ্চ।

তেমনি সিবি-ছাত্রলীগ ব্রাঞ্চ, যেবি-যুবলীগ ব্রাঞ্চ। আর সবার ওপর থাকবে এবি-আওয়ামী লীগ ব্রাঞ্চ। এতে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ধরে রাখা আসান হবে। কেউ চাইলে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারবে না। প্রশ্ন হলো এই সিস্টেমকে কেমন করে জাস্টিফাই করা যায়। গণতন্ত্রে জনগণ ভোট দিয়ে একটি দলকে ক্ষমতায় বসায়। কেবল কয়েকজন মন্ত্রী-এমপিকে বসায় না। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগকে এভাবে পুলিশ বাহিনীতে আত্মীকরণ করা হলে তা গণতন্ত্রের মহান আদর্শকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কার হাতে কী অস্ত্র থাকবে। পুলিশের হাতে প্রচলিত অস্ত্র বা লাইসেন্স করা অস্ত্র থাকবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যাদের হাতে লাইসেন্স করা অস্ত্র দেখা যাবে তাদের জনগণ সাধারণ পেটি-পুলিশ বলে গণ্য করবে। আর যাদের হাতে অপ্রচলিত অস্ত্র—তা মান্ধাতা আমলের বা অত্যাধুনিক হতে পারে—এরা সিবি, যেবি বা এবির লোক বলে জনগণকে ধরে নিতে হবে। হকিস্টিক, ছুরি, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, চাপাতি, পিস্তল, রিভলবার, একে ফর্টি সেভেন, ইয়াবা-গাজা-হেরোইন-ফেনসিডিল, টেঁটা—এসব কিছুকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের বৈধ বহনযোগ্য অস্ত্র ও সেবন সামগ্রী হিসেবে গণ্য করা হবে।

সিবি-যেবি-এবি'র নিয়োগপত্র কে দেবেন। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক; যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের স্বাক্ষর করা পরিচয়পত্রই নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত। এতে করে সরকারের কেন্দ্রীভূত জটিল দীর্ঘমেয়াদি নিয়োগ পদ্ধতি সহজ হবে, গণমুখী হবে। পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের জন্য ছাত্রলীগ ক্যাডারদের আর বছরের পর বছর হাপিত্যেস করতে হবে না। পুলিশের এই বিশেষ বাহিনীর স্লোগান কী হবে! স্লোগান হবে—ধর শালারে, মার শালারে। এরা যখন কোনো জায়গায় অ্যাকশনে যাবে তখন জয় বঙ্গবন্ধু হুঙ্কার দিয়ে ধর শালরে মার শালারে বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

প্রিয় পাঠক, আজ এ পর্যন্তই। ভালো থাকবেন।