রাষ্ট্র যখন খুনি, সরকার তখন ঘাতক

আমীন কাদীর
Published : 6 April 2012, 12:15 PM
Updated : 6 April 2012, 12:15 PM

মেহেরুন রুনি-সাগর সরওয়ার হত্যা নিয়ে 'তামাশা করছে পুলিশ!'—এটি একটি প্রিন্ট মিডিয়ার শিরোনাম। কিন্তু তামাশা পুলিশ করছে কোথায়—তারা তো সরকারের আজ্ঞাবহ আর্দালী মাত্র। তামাশায় মেতে উঠেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তার বেডরুম পাহারা সংক্রান্ত চটুল মন্তব্যের চেয়ে বড় তামাশা আর কী হতে পারে! তিনি তো সাফ জানিয়ে দিয়েছেন—বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। ঘরে ঘরে বেডরুমে তিনি পুলিশ দিতে পারবেন না। কী ভয়ঙ্কর বেপরোয়া কথা। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছেন—বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বৈকি! অনেকে সহাস্যে বলছেন, শেখ হাসিনা অমন বলেন-ই। না, এমনটি বলে বিষয়টিকে লঘু-হাস্যরসাত্মক করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান একজন প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক অবশ্য কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে তিনি চরম ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু কর্তব্য পালনের বাধ্যবাধকতা নিয়ে পরিহাস করার অধিকার তিনি রাখেন না। এটা নিয়ে তামাশা মানে তার নেয়া শপথ নিয়ে তামাশা। এ নিয়ে তামাশা মানে প্রধানমন্ত্রীর পদকে নিয়ে তামাশা। তিনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে পবিত্র শপথ নিয়ে ওই পদে বসেছেন। কোনো রাজার উত্তরাধিকার হিসেবে তাকে ধরে এনে জোর করে কেউ বসায়নি। এটা রাজা-গজাদের যুগ নয়। এটা গণতন্ত্র। এখানে নিজেকে মহারাজা-মহারাণী ভাবার সুযোগ নেই। এখানে আমলা যেমন পাবলিক সার্ভেন্ট, তিনিও তেমনি সবার চেয়ে দায়িত্বশীল পাবলিক সার্ভেন্ট। তিনি বেডরুম না রান্নাঘরে পাহারা বসাবেন, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু জনগণের জানমালের সুরক্ষার দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না।

তাছাড়া এখন তার কাছে কেউ সাগর-রুনির বেডরুমের জন্য পাহারাদার চাচ্ছে না; সারা দেশের মানুষ চাচ্ছে সাংবাদিক দম্পতি হত্যার বিচার। সেই বিচারের কী খবর! হত্যাকাণ্ডের তদন্তের নামে পুলিশ তামাশায় নেমেছে কার নির্দেশে! কেন 'জজ মিয়া'দের সন্ধান করছে গোয়েন্দারা। ফেব্রুয়ারি ২০-২৮ তারিখ পর্যন্ত কতগুলো ছিঁচকে চোর ধরে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চলল—বেডরুমের ওই ঘটনা নাকি নিছকই ডাকাতি! পুলিশ অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজের সজাগ সতর্ক দৃষ্টির কারণে কল্প-কাহিনী ফাঁদার এজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এই এজেন্ডার নেপথ্যে কে?

সাগর-রুনি হত্যার পরের দিনগুলোতে কারোরই মনে হয়নি এই হত্যায় সরকারের রাঘব বোয়ালরা জড়িত থাকতে পারে। এই হত্যাকাণ্ড ইস্যুটি যে এত দ্রুত সরকারের কাঁধে বোতলবন্দি দৈত্যের মতো চেপে বসবে, তাও তখন মনে হয়নি। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অবাক করে ওই বিস্ময়কর মন্তব্য করে যখন দায়-দায়িত্ব এড়াতে চাইলেন—রাতারাতি চিত্র পাল্টে যাচ্ছে।

এখন মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে—হত্যার নেপথ্যে ভয়ঙ্কর কোনো রহস্য রয়েছে। কানাঘুষায় অনেক কথা শোনা যাচ্ছিল। চটুল কিছু গল্প মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। মেহেরুন রুনির নিষ্কলুষ ব্যক্তিগত জীবনেও কলঙ্ক লেপনের অপচেষ্টা চলেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে—এসবই ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। লাশকে কলঙ্কিত করে আসল রহস্যকে ধামাচাপা দেয়ার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। নিজের পাতা জালে সরকার নিজেই ফেঁসে যাচ্ছে। লাশ-লাঞ্ছনার ষড়যন্ত্রের পর এখন ডাকাতির গল্প ফাঁদার চেষ্টা চলছে। সরকারের এখন খারাপ দিন। এসব গালগপ্প ফেঁদে কোনো লাভ নেই। মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। বিষয়টি গড়িয়েছে রাজনীতির মাঠেও। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ২৭ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটে বলেছেন, সাগর-রুনি সরকারের দুর্নীতির কথা জানতেন। তাদের কাছে সেই দুর্নীতির গোপনীয় তথ্য ছিল। যা প্রকাশ হলে বিদেশিরা জানতে পারত। আর এ জন্যই খুন করা হয়েছে তাদের। সত্যি বলতে কী খালেদা জিয়া নতুন কিছু বলেননি। তিনি লোক মুখে চালু কথা-কাহিনীই জনসভায় জনতার সামনে তুলে ধরেছেন। গত কিছুদিন ধরে হত্যার এই নেপথ্য রহস্য নিয়ে নানা কথা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের হাতে এখন অনেক রকম মিডিয়া। সংবাদপত্র, টিভি তো আছেই। ইন্টারনেট আছে, ফেসবুক আছে। আর তার চেয়েও শক্তিশালী মিডিয়া হলো সাধারণ মানুষের মুখ ও কান। খালেদা যা বলেছেন; তিনি বলার অনেক আগেই তা ইতোমধ্যে মুখে মুখে সারাদেশবাসী জেনে গেছেন। এসব কথার সত্য-মিথ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষ ভাবছে না। তারা সরল সমীকরণে বিশ্বাসী। যখন দেখে কোনো হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার লুকোচুরি করে; টালবাহানা করে; পুলিশ কর্তা ও পুলিশ মন্ত্রী আগডুম বাগডুম বলে; তখন সহজে ধরে নেয়—কাজটা নিশ্চয়ই সরকারের সোনার ছেলেরা করেছে। নইলে খুনিদের ধরতে এতো গড়িমসি কেন! বিএনপি আমলেও এমনটা ভেবেছে। এখনও তেমনটাই ভাবছে। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জন্য বিশেষ কোনো ছাড় নেই। পুলিশের দালাল-সরকার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের জন্য বড় জ্বালা। তারা ডাকাতির ঘটনা ফাঁদতে গিয়েও ফাঁদতে পারছে না। তাদের পেটের ষড়যন্ত্র আরেক দল ফাঁস করে দিচ্ছে। সাগর-রুনির বাড়িতে ডাকাতিই যদি হবে, তবে কী ডাকাতি করতে এসেছিল ডাকাতচক্র। এরা যে অতি উঁচুমানের ডাকাত দেখছি, তারা নিয়ে গেছে সাগরের ল্যাপটপ, মোবাইল আর কম্পিউটারের ডিস্ক। যে ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছে সাগর-রুনি—ওই ডাকাতরা আইটি এক্সপার্ট। টাকা-পয়সা, সোনা-দানা নয়; তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ডাকাতরা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে সেসব দুর্নীতির গোপন তথ্য—যা সাগর সারওয়ার জানতেন এবং সংরক্ষণ করেছিলেন ল্যাপটপে সিডিতে।

ব্রাদার ঝানু গোয়েন্দা—তোমরা 'জজ মিয়া'কে ধরতে পার; ছিঁচকে নেশাখোরদের ধরে পিটিয়ে চোর সাজাতে পার, খুনি বানাতে পার—এবার দেখি কেমন তোমাদের কর্ম নৈপুণ্য? তোমরা কি পারবে এই আইটি বিশেষজ্ঞ উঁচুদরের ডাকাতদের ধরতে? মানুষ চাঁদে গেল। আর তোমরা ছিঁচকে নেশাখোরদের নিয়েই পড়ে রইলে।

২.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লাগামহীন বক্তব্য নিয়ে এসব তিক্ত কথা বলে খারাপও লাগছে। তিনি আছেন নানা ঝামেলার মধ্যে। অত্যন্ত তুচ্ছ হয়েও তার প্রতি সহানুভূতিও জাগছে। তিনি কিছুতেই তার কথা বলার জিহ্বাকে সম্বরণ করতে পারছেন না। এ নিয়ে অতীতে তাকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। তির্যক কথা তার খুব প্রিয় নেশা। যাকে তিনি স্নেহ করেন, তাকে নিয়েও টিটকারি দেন তিনি। এটা একজন স্নেহময়ী বড় বোনের ক্ষেত্রে হয়তো মানা যায়—কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য মানানসই নয়। প্রধানমন্ত্রীকে একটা দেশ-রাষ্ট্রের বৃহত্তম সংসার চালাতে হয়। দেশটাকে নিজের ঘরের ড্রইংরুম ভাবা তার ঠিক নয়। সুধা সদনের ড্রইংরুমে যে কথা বলা যায়; রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন—গণভবনে বসে সে কথা বলা যায় না। এই পার্থক্যটুকু তাকে বুঝতে হবে। কথাগুলো সবিনয়ে বলছি।

২৬ ফেব্রুয়ারি গণভবনে তিনি মাইকের সামনেই বলেছেন—মিডিয়া যা ইচ্ছা তাই লিখছে। সত্য হোক, মিথ্যা হোক- স্বাধীনতা পেয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখছে। কখনও কখনও একটু বেশিই লিখছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই কথার মধ্যে বেশ খানিকটা প্রশ্রয় আছে। মিডিয়ার যাচ্ছেতাই লেখা তিনি বুঝি বেশ উপভোগ করছেন।

উপভোগ তো তিনি করবেনই। কেননা মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে চলছে—মিডিয়া সে পথে হাঁটবেই। মিডিয়া সমাজ-সংসার, সরকার-রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী যা ইচ্ছাতাই বলেন; সে দেশের মিডিয়া পর্দানশীন হতে পারে না। মিডিয়ার কাছ থেকে যদি তিনি সরকারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা চান, তবে তাকেও ইতিবাচক হতে হবে। তাকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। যা মনে আসে তা বলার প্রবণতা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। ইদানীং মিডিয়া তো কিছু লেখে না। শেখ হাসিনা যা বলেন; তার হবুগবু মন্ত্রীরা যা বলেন, তাই পরিবেশন করে। নিজেদের ফালতু বাতচিতেই ঘায়েল হচ্ছে সরকার। মিডিয়া এখানে আগ বাড়িয়ে কিছু করছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। মিডিয়া তার বরাতেই হুবহু তার বাণী মোবারক ছেপেছে। যা ইচ্ছাতাই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংই বললেন। মিডিয়া তা প্রচার করেছে মাত্র। হ্যাঁ, তার কথার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভয়াবহ। মানুষের মুখে মুখে তার কথা। তিনি জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে হাস্য-পরিহাস করেছেন, বাদশাহী মেজাজে রসিকতা করেছেন; জনগণ তাতে প্রবল নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। তারা হিসাব করছে শেখ হাসিনাকে ভোট দিয়ে কী পেলাম! খুন হয়েও তার কাছ থেকে টিটকারি শুনতে হবে।

মানুষের মধ্যে যে এই অনাস্থা-ক্ষোভ—এগুলো মিডিয়া সৃষ্টি করেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি একটু ধৈর্য ধরে আত্মবিশ্লেষণ করেন, নিশ্চয়ই তিনি অনুধাবন করতে পারবেন—এর জন্য দায়ী তিনি স্বয়ং। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ঐতিহাসিক মহত্ কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু শত শত মানুষ খুন হচ্ছে, সে সবের বিচার হচ্ছে না। সঠিক তদন্ত হচ্ছে না। খুনিদের ফাঁসি হচ্ছে না। এই ব্যর্থতার দায়ভার কেমন করে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের হবে! উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেমন করে দায়মুক্ত হবেন? তার দায় তাকেই নিতে হবে। খামোখা এই দায় খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি তাদের তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রবল জনপ্রিয় করে তুলছেন। কেন তিনি ভুলে যাচ্ছেন সরকার তিনি চালাচ্ছেন; খালেদা নন।

এই যে কথাগুলো বললাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীও তা বুঝতে পারছেন; তারা সাহস পাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রীকে বলতে। ক্ষমতা কি তবে সত্যিই কোনো চোরাবালি, আত্মরতি, আত্মচারিতা—অহঙ্কার মানুষকে অন্ধ করে দেয়। একজন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এমনই জনবিচ্ছিন্ন, একা হয়ে পড়েন যে, সত্যকে মুখ ফুটে বলার মতো তার পাশে কেউ নেই। সুরঞ্জিত-ওবায়দুল তবু ছিটেফোঁটা ছিলেন—মন্ত্রী হওয়ার পর তারাও গুম মেরে গেলেন! ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা যে নিজের চেয়ারকে ক্রমেই শরশয্যা বানিয়ে তুলছেন; অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর শুভাকাঙ্ক্ষীরা এতই আখের গোছাতে ব্যস্ত যে—কেউ তা মুখ ফুটে বলছে না।

৩.
নিন্দুকেরা যে যাই বলুক, '৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের কিছু সুকীর্তি ছিল; নারী শিক্ষা, বয়স্ক ভাতা, বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে প্রেসিডেন্ট করার রেওয়াজ বিমুখ সাহস; কিন্তু সেসব কাজ রীতিমত পর্বত চাপা পড়েছিল—গডফাদারতন্ত্র নামের হিমালয়ের নিচে। আবু তাহের, জয়নাল হাজারী, হাসানাত, শামীম ওসমান, গোলন্দাজ, মকবুল—যেন সেই সরকারের দুষ্কীর্তির একেকটি এভারেস্ট শৃঙ্গ। চলতি মহাজোট জমানায় কথামালা আর প্রতিশ্রুতির প্রবল আস্ফাালনের মাঝে কীর্তি খুঁজে পাওয়া ভার—কিন্তু দুষ্কর্মের ভূত যেন পিছুই ছাড়ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসি বাস্তবায়ন; যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আংশিক উদ্যোগ, এছাড়া বলার মতো সরকারের কাজ কই! এই মহাজোট জমানা হতে পারত ইতিহাসের সেতু নির্মাণ জমানা। পদ্মা সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, মেট্রো রেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, কুয়াকাটায় কামাল-জামাল-রাসেল ত্রি-সেতু। কিন্তু সব কাজই যে ঝুলন্ত। দুর্নীতির ভারে ঝুলন্ত। সরকারি সুকীর্তি না থাকলেও রাষ্ট্রীয় দুষ্কীর্তি ঠিকই আছে।

আর সেই দুষ্কীর্তির ব্রান্ড অ্যামবাসাডর হলো লক্ষ্মীপুরের বিশ্বখ্যাত খুনি বিপ্লব। একটি রাষ্ট্র ও সরকারের দুষ্কর্ম কত রকম ও কী কী হতে পারে—তা বিপ্লবকে দিয়েই নির্লজ্জভাবে প্রমাণ করে চলেছে সরকার।
একজন খুনিকে রেহাই দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেপরোয়াভাবে ব্যবহারের ঘৃণ্যতম নজির স্থাপন করা হয়েছে চলতি জমানায়।

দেশ কাঁপানো নূরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি বিপ্লবকে ২০১১ সালের জুলাইতে কলমের এক খোঁচায় রেহাই দেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২তে সেই খুনি এইচএম বিপ্লবের আরও দুটি খুনের সাজা আংশিক ক্ষমা করলেন তিনি।

রুনি-সাগরের হত্যাকারীকে ধরতে পারে না যে রাষ্ট্র ও সরকার—শত শত খুনের বিচার যে দেশে হয় না—সেই রাষ্ট্রের কর্ণধার কেন খুনিকে রেহাই দেয়ার খেলায় মেতে উঠলেন। দেশ কি তবে খুনিদের অভয়ারণ্য হতে চলেছে। এখানে খুনের বিচার হবে না। খুনের বিচার চাইলে প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে তা নিয়ে টিটকারি দেবেন। হাসবেন। পরিহাস করবেন। আর যদি বিরল ক্ষেত্রে কোনো খুনের বিচার হয়ে যায়—খুনি দণ্ড পায়, তখন রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। বাহ! খুনিকে না ধরা; তদন্ত-তামাশার নামে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা—পাশাপাশি চূড়ান্ত বিচারে দণ্ডিত খুনিকে ছেড়ে দেয়ার কার্যক্রম—যুগপত্ একই সঙ্গে চলতে থাকবে। খুনখারাবি নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকার কেন এই তামাশায় মেতে উঠল! মহাজোট সরকার কেন ঘাতক সরকারের উপাধি পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে—ভাবতে ভয় হয়, এসব আলামত আগামীতে খুন হত্যার হোলিখেলার অশনি সঙ্কেত কিনা! তারা ক্ষমতাদর্পী ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জনগণকে ভয় দেখাতে চায় কিনা—সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির দরবারে ক্ষুদ্র কয়েকটি কথা নিবেদন করছি। তাহের পুত্র বিপ্লবকে তিনি ক্ষমা করে দিলেও সে খুনি। কেননা নিম্নআদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট—সর্বত্রই সে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত খুনি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যেভাবে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছে, এটাই ছিল তার একমাত্র নিয়তি। রাষ্ট্রপতি সেই আইনের স্বাভাবিক চাকাকে উল্টে দিলেন। এই ক্ষমার মাধ্যমে তিনি বিপ্লবের খুনের দায় ও পাপ—সবকিছু রাষ্ট্রের কাঁধে অবলীলায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এই পাপ এখন রাষ্ট্রের; সরকারের এই কাজের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রকে কলঙ্কিত করেছেন। ইতিহাসে এই নজির কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আর ওই পাপ-কাজের ভার আগামীতে বছরের পর বছর বহন করতে হবে দুর্ভাগা এই দেশকে। প্রিয় রাষ্ট্রপতি, নেতানেত্রীরা মানুষের জানমাল নিয়ে, নিরাপত্তা নিয়ে তামাশা করে করুক; আপনি আওয়ামী লীগের লোক হলেও দেশের অভিভাবক, আপনি রাষ্ট্রের আইন-আদালত, বিচার-ব্যবস্থাকে, তামাশাকে প্রশ্রয় দিতে পারেন না। আপনাকে হতে হবে ন্যায়পালক। ন্যায়-নীতিদণ্ড আপনার হাতে লাঞ্ছিত হলে মানুষের ভরসা হবে ভূলুণ্ঠিত। অপরিণামদর্শী নেতানেত্রীরা রাষ্ট্রপতি পদের সাংবিধানিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে খুনিকে ক্ষমা করতে আপনাকে বাধ্য করে এই রাষ্ট্রের গায়ে দিতে চায় খুনির সিলমোহর; খুনি-হত্যাকারীদের পালাবার পথ করে দিয়ে সরকার যদি হয়ে পড়ে ঘাতক-বন্ধু—এই বালখিল্য তামাশা-বৌচি খেলাকে আপনি কোনোভাবেই স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে পারেন না। রাষ্ট্রকে খুনি হওয়া থেকে, সরকারকে ঘাতক হওয়া থেকে রক্ষা করা আপনার কর্তব্য। স্নেহের আতিশয্যে বার্ধক্যের দুর্বলতায় এই কর্তব্য পালনে অবহেলার কোনো সুযোগ আপনার নেই।