বড়’র পিরিতি বালির বাঁধ

আমীন কাদীর
Published : 16 May 2012, 03:26 PM
Updated : 16 May 2012, 03:26 PM

কথায় বলে, বড়'র পিরিতি বালির বাঁধ। অর্থাত্ যতই ভালোবাসাবাসি কর না কেন, দিন ফুরালে বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায়। সামান্য একটুও ঢেউ ধসিয়ে দিতে পারে বালির প্রেম। কথাটা এতদিন রূপকার্থে শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে নিষ্ঠুর-নির্মমতার সঙ্গে এমন প্রেমভঙ্গের ঘটনা ঘটতে পারে—তার প্রমাণ এবারই পেলাম। হিলারি ক্লিনটন এখন আয়রন লেডি। একই সঙ্গে সুপার পাওয়ার ওম্যান। সেই আগের লাভার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের লাভলি লেডি আর নন। এখন তিনি মার্কিনিদের ওয়ার্ল্ড অর্ডারের মোক্ষম স্বার্থের প্রশ্নে কখনও ফটোসেশনে হাস্যময়ী, লাস্যময়ী। আবার স্বার্থের আবেদনটুকু আদায় হতেই অন্য চেহারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি-কূটনীতির ধারাটাই এমন। তাদের অভিধানে বিশ্বস্ততা-নিখাদ বন্ধুতা বলে কোনো শব্দ নেই। তাদের কাছে বিশ্বস্ততা মানেই মার্কিন স্বার্থ। তাদের কাছে বন্ধুতা-মিত্রতা, সহযোগিতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসা, হাসিখুশি ফটোসেশন—সবকিছুর একটাই অর্থ; তা হলো মার্কিন স্বার্থ। আর সেটি আদায় হলেই তাদের আসল চেহারা প্রকাশ পায়। এর প্রমাণ ইরাক, আফগানিস্তান-আরব বিশ্বে আমরা দেখেছি।

ড্রিম লেডি হিলারি ক্লিনটন কী অনবদ্যভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই চেহারাটাকে তুলে ধরলেন। ৫ মে'র হাসিনা-হিলারি-দীপু মনি ফটোসেশন দেখে আপ্লুত হয়েছিলাম মহাজোট সরকার খোদ মার্কিনিদের পাকাপোক্ত হাত করে ফেলেছে। ভেবেছিলাম— এই হাসি আগামী নির্বাচনে মহাজোটের বিরাট বিজয় পর্যন্ত ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে থাকবে।

কিন্তু ৬ মে আমরা কী দেখলাম! অনাবিল হাস্যলাস্যময় ফটোসেশনের ফটো ফ্রেমটা অটুট থাকলেও রাতারাতি ভেতরের ছবিটা বদলে গেছে। আগের ফ্রেমে হিলারির সঙ্গে ছিলেন দুজন কীর্তিমতী নারী—হাসিনা ও দীপু মনি। পরদিন সে জায়গাটা দখল করে নিলেন দু'জন কীর্তিমান পুরুষ। ফ্রেমে এবার অক্ষয় হয়ে ক্যামেরাবন্দি হলেন ড. ইউনূস এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অংশীদারি সংলাপের অঙ্গীকারনামার দিনে হিলারি ছিলেন সংযত। সরকারপন্থী ইস্যুগুলোতে কথা বলার ক্ষেত্রে ছিলেন সতর্ক। পরদিন হিলারিকে আর যেন চেনাই যাচ্ছিল না। ৬ মে আমিনুল হত্যা ইস্যুতে শক্ত ভাষায় বললেন—পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত অপরিহার্য। তা না হলে এ ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন ক্রেতাদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে।

সাদামাটা ভাষায় পরিষ্কার হুমকি।

কূটনীতির রেওয়াজি প্রটোকলে আমরা দেখি, সফরের গোড়াতে লাল্লুপাঞ্জুদের সঙ্গে বৈঠক-টৈঠক হয়। আর সফর শেষ হয় হাই প্রফাইল হাই ভোল্টেজ বৈঠকের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভিভিআইপি। দীপু মনি, ড. ইউনূস, স্যার আবেদ—এরাও মস্ত ভিআইপি। কেউই তুচ্ছ নন। হিলারি ভিভিআইপি বৈঠক সেরে নিয়েছিলেন আগেই। পরদিন সৌজন্য বৈঠক করলেন নোবেল লরিয়েট ও ব্রিটিশ রাণীর খেতাবপ্রাপ্ত স্যারের সঙ্গে। এই বৈঠকে ড. ইউনূস ও স্যার আবেদ হিলারির কাছে মত দিলেন—সংঘাত এড়াতে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। হিলারিও ঈঙ্গ-মার্কিন বন্ধুদের মূল্যবান মতে একরকম সায় দিলেন। বললেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র জরুরি এবং সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

হিলারির এই ঐতিহাসিক ঢাকা সফরের চূড়ান্ত মুহূর্তে আবেদ-ইউনূসের সঙ্গে সৌহার্দ্য বৈঠক খুবই তাত্পর্যবহ। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এবং তাদের এদেশীয় বিশ্বস্ত মিত্রদের বৈঠকের ভাষায় এটা বুঝতে কারও অসুবিধার কথা নয়—টেকসই গণতন্ত্রের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকেই টেকসই মনে করছেন। এটা মহাজোট সরকারের গালে চপেটাঘাত ছাড়া কিছু নয়।

তারা তাদের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের জন্য যে কর্মপরিকল্পনার 'ছক' করে রেখেছেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন বলে কিছু নেই। আছে আওয়ামী লীগের 'নিরপেক্ষ ভোট কারচুপিবিহীন' মহাজোট সরকারের অধীনে মহান নির্বাচন। বিরোধী দল তাতে এলে তো ভালো। না এলে আরও ভালো। না এলে নির্বাচন সর্বাঙ্গীণ নিরপেক্ষ-সুষ্ঠু-অবাধ করা সম্ভব হবে। পড়ন্ত বেলার এই মরন্ত সরকার এই আশাতেই হিলারিকে এমন আটঘাট বেঁধে ডেকে এনেছিল—অংশীদারির রাখীবন্ধন পরিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে- মার্কিনিরা তাদের সব কর্মপরিকল্পনাতে মধুর সমর্থন দেবে।

এজন্য মহাজোট কোন কাজটা বাকি রেখেছে! গুম, খুন, মানবাধিকার নিয়ে বিএনপি খুব লাফাচ্ছিল। ইলিয়াস গুম ইস্যুতে দিনের পর দিন হরতাল-আন্দোলন-সংগ্রাম করে দেশের সর্বব্যাপী গুম-গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করেছিল। দেশে স্বাভাবিক জীবন ও মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই—জননিরাপত্তা স্বাধীনতা-উত্তরকালে সবচেয়ে হুমকির সম্মুখীন—বিএনপি সেটি অংশীদারি আলিঙ্গনের মধুর মুহূর্তে হিলারির সামনে তুলে ধরতে পারে—তা ঠেকাতে এবং হিলারির সফর মসৃণ ও ফুল বিছানো করতে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের জেলে পুরে, হুলিয়া জারি করে কবরস্থানের শান্তি কায়েম করেছিল মহাজোট।

কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই! যা আশা করা হয়েছিল তাতে দেখছি গুড়ে বালি। হিলারি-অংশীদারির অঙ্গিকার আদায় করতে এসেছিলেন সেটি যেমন খুব সহজেই আদায় করলেন, পাশাপাশি এই বার্তাও পৌঁছে দিলেন—দাসখত দিয়ে যতই গাঁটছড়া বাঁধার উষ্ণ চেষ্টা করা হোক না কেন, আমেরিকার ওপর ভরসা নেই। আমেরিকাকে বিশ্বাস নেই। স্বার্থ হাসিল হলে তারা ঠোঁট ওল্টাতে মোটেই দ্বিধা করে না। দেরিও করে না। এক্ষেত্রে তাদের লাজশরমের বালাইও নেই। এক্ষেত্রে চীনের কথা একটু বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি। চীনের পিরিতি কিন্তু বালির বাঁধ নয়। চীন কোনো দেশের সঙ্গে হুটহাট বালি-প্রেম যেমন করে না, তেমনি ঐতিহ্যগতভাবেই তারা যুগ যুগ ধরে বিশ্বস্ততা-বন্ধুতা-সহযোগিতা রক্ষা করে। চীনের ঈমান এতটাই মজবুত, কথায় কথায় বেঈমানী তাদের ধাতে নেই।

আরেকটি অদ্ভুত, বিচিত্র ও মহামূর্খ আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছিল মহাজোটের বুদ্ধিধর থিংকট্যাঙ্কের পক্ষ থেকে। যেটা শুনে আমার মতো মূর্খেরও হাসি পাচ্ছিল। মহাজোট সরকারের কীর্তিমতীরা আশা করছিলেন, হিলারির সঙ্গে তারা অংশীদারিত্বের এমন রাখীবন্ধন বেঁধেছেন যে, হিলারি নাকি কলকাতা সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত অমীমাংসিত ইস্যুতে ঢাকার জন্য তদবির করবেন। তিস্তার পানি পাইয়ে দেবেন। কী হাস্যকর আশাবাদ!

নয়াদিল্লি এবং মনমোহন সিং একজন রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীর গোস্বা, গোয়ার্তুমি ও একদেশদর্শীর নাম ভাঙিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য পানি থেকে সুকৌশলে বঞ্চিত রেখেছে—দিল্লি-কলকাতার এই অভ্যন্তরীণ চালবাজির মধ্যে কেন নাক গলাবেন হিলারি। তিস্তার পানিতে মার্কিনিদের স্বার্থ কী! বরং এই পানি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সাপে-নেউলে সম্পর্কটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি উপভোগ্য।

আমরা কিসের ভিত্তিতে অমন আশায় বুক বেঁধেছিলাম! মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসালিশের রায়কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সমুদ্র জয় বলে চালানো কোনো এডুকেটেড ডিপ্লোমেসি নয়—এটা বাঙাল কূটনামি। হিলারি তো বাঙাল নন। অর্ধ শিক্ষিতও নন। কূটনীতি কাকে বলে, কি ও কত প্রকার—সেটা তার কাছে শেখা যেতে পারে। তিনি কূটনামি করতে এখানে আসেননি। মার্কিন স্বার্থ নিয়ে মার্কিন জনগণের সঙ্গে তিনি কূটনামি ও তামাশা করেন না। নিজ দেশের জনগণকে তিনি বোকা বানানোর খেলা খেলেন না। পৃথিবীর যেখানেই যান, মার্কিন স্বার্থ আদায় করে ছাড়েন। এটাই তার চাকরি। এটাই তার রাজনীতি। এই চাকরি বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে সম্পন্ন করে স্বপ্ন দেখেন একদিন তার দেশের জনগণ তাকে প্রথম নারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বানাবে। তিনি জনপ্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বউ ছিলেন- সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে মার্কিন ফার্স্ট পারসন হওয়া তার অধিকার- এমন স্বপ্ন দেখেন না। এজন্য দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ জয়-কলকাতা জয়ের তুবড়ি ছুটিয়ে সংবর্ধনাও নেবেন না। লক্ষ্য করে দেখুন, মহাজোটের মহামন্ত্রীদের কী হাস্যকর গুড হিউমারে তিনি রাখলেন। এমনকি তিস্তার পানি পাইয়ে দেবেন—এমন গুজব ছড়িয়ে দিয়ে তার প্রোপাগান্ডা পার্টি বেকুব-গর্দভ বানিয়ে ছাড়ল বাংলাদেশের ধুরন্ধর কূটনামিবিদদের।

৭ মে রাতে আমরা বাংলাদেশের বেকুব মিডিয়ার খবরে জানতে পারলাম, তিস্তা নিয়ে হিলারি-মমতা কথা হয়নি। অনেক কথা হয়েছে দুই নারীতে। হাতে হাত মিলিয়ে হাসি উল্লসিত ফটোসেশনও করেছেন। তাতে রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরত্ব ছিল। অন্ধ আবেগের আতিশয্য ছিল না। হিলারির সঙ্গে হাত মেলানো মমতার হাসিমুখ দেখে মনে হয়নি, আহা এ নারীজন্ম সার্থক হলো। মনে হয়নি— আহা- হিলারির কাছে কলকাতাকে বন্ধক দিলাম।

তিস্তা নিয়ে টুঁ শব্দটি হয়নি। কেন হবে? তিস্তা হচ্ছে মমতা-মনমোহন বনাম ঢাকার বিবদমান ইস্যু। সেখানে হিলারি কে? তিস্তা উপমহাদেশের নদী না নারী—এ নিয়েও তার কোনো ধারণা থাকার কথা নয়।
হায়রে আমরা কী বেকুব বাঙাল—মার্কিনিদের দুধসাদা মুখের পাশে আমাদের তামাটে মুখটা ক্যামেরার ফ্রেমে বাঁধা পড়লেই ভাবি—আহা! ক্ষমতার ২৫ বছরমেয়াদি পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ধন্য হলো এই নারীজীবন।

মার্কিনিরা সেই '৬৯ সালে চাঁদে গেল! আর আমরা এখনও চাঁদের বুড়ির চড়কা কাটা গালগল্পেই পড়ে আছি। ওরা চাঁদে যাবে, মঙ্গলে যাবে আর আমরা যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের বোকা বানানোর মূর্খ তামাশায় মেতে থাকব।